চারদিকে নির্জনতা ভর করেছে, নৌকার বৈঠার শব্দ কান অব্দি পৌঁছায় শুধু। প্রকৃতি তার মায়াবী রূপের সবটাই যেন ঢেলে দিয়েছে এখানে, সেই রূপে বিমোহিত হয়ে এগিয়ে যাওয়া সবুজের বনে।
বলছি বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন রাতারগুলের কথা। রাতারগুল সিলেটে অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক পর্যটনস্থল।
একটুখানি পরিচয়
রাতারগুল মূলত ‘ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরস্টে’ বা জলাবন, এমন বন বাংলাদেশ আর কোথাও দেখা যায় না। ‘বাংলার অ্যামাজন’ নামেও পরিচিতি পেয়েছে এ বন। সিলেটের সীমান্তর্বতী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এ বনের দূরত্ব সিলেট শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার। বনটির আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর অঞ্চলকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সরকারি তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি, এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আছে দুটি। একটা শ্রীলংকায়, আর অন্যটি রাতারগুল।
রাতারগুলে রাতাগাছ (বৈজ্ঞানিক নাম- Schumannianthus dichotomus) নামে একধরনের উদ্ভিদের দেখা মেলে। স্থানীয় ভাষায় এটি মুর্তা নামে পরিচিত। এ গাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। রাতারগুলে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম- Millettia pinnata)।
রাতারগুলের দুই রূপ
রাতারগুলে বছরে দু’রকম রূপের দেখা মেলে। বছরের একটা সময় (চার থেকে সাত মাস) এ বনের গাছগাছালির বেশিরভাগ অংশই পানির নিচে থাকে। সেসময় এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। মূলত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের বর্ষা মৌসুমে রাতারগুলে এ রূপ দেখা যায়। তখন ছোট ডিঙি নৌকায় করে বনটি ঘুরতে হয়। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা নিস্তব্ধ এ বনের প্রকৃতিকে করে তোলে আরও রঙিন। রাতারগুলের অনিন্দ্যসুন্দর এই রূপটাই পর্যটকদের টেনে নিয়ে আসে দূর-দূরান্ত থেকে।
বর্ষা মৌসুম শেষে বনের পানি কমে যায়। পানির উচ্চতা তখন ১০ ফুটের মতো থাকে। ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে চলা পথ আর পানি জমে থাকে বন বিভাগের খননকৃত বিলগুলোতে। তখন এটি দেখতে আর দশটা বনের মতোই মনে হয়, যেন পাতাঝরা শুষ্ক এক ডাঙা। এই সময়ে জলজ প্রাণীকূলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খনন করা বড় বড় ডোবাগুলোতে।
রাতারগুল বনের ভেতরে পাখির আবাসস্থল হিসেবে ৩.৬ বর্গ কিলোমিটারের একটি বড় লেক খনন করা হয়েছে। শীতে এ জলাশয়ে বসে নানা পাখির মিলনমেলা।
পথের গল্প
২০১৯ সালের জুলাই মাসের শেষে এক ভরা বর্ষার মৌসুৃমে রাতারগুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড ট্যুরের অংশ হিসেবে। দিনভর রাতারগুলের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার গল্পটা বলতে চাই এবার।
সিলেট শহর থেকে রাতারগুলে যাওয়ার অনেক পথ আছে৷ সহজ দুটি পথের একটি হচ্ছে সিলেট শহরের পাশেই খাদিম চা বাগান আর খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা বা জিপ নিয়ে আসতে হবে শ্রীঙ্গি ব্রিজ। সেখান থেকে রাতারগুল। অন্য পথটি হচ্ছে সিলেট-জাফলংয়ের গাড়িতে চড়ে নামতে হবে সারিঘাট। সেখান থেকে সিএনজিতে করে গোয়াইনঘাট বাজার হয়ে তারপর রাতারগুল।
রাতারগুলে যেখানে গাড়ি থামে, সেখান থেকে নৌকাঘাট যেতে আধা কিলোমিটার মতো পথ হেঁটে যেতে হয় অনেক সময় আবার সিএনজিও পেয়ে যেতে পারেন। গ্রাম্য পথ আর প্রকৃতির রূপ দেখতে হেঁটে যাওয়াই ভালো। আঁকাবাঁকা এ পথে দেখা মিলবে নানান স্থলজ প্রাণীর। রাতারগুলের মুগ্ধতা শুরু হবে এখান থেকেই।
নৌকার ঘাটে পৌঁছলে ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। ভাড়া নির্ধারণে সতর্ক থাকা জরুরি। একটি নৌকায় ৫-৬ জন অনায়াসে বসা যায়। ভাড়া অনেক বেশি চাইলেও দরদাম করে সেটা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। যদি আপনি দুপুরের খাবার এখানে খেতে চান, তবে নৌঘাটেই সে ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে বেশি মানুষের আয়োজনের জন্য আগে থেকেই বলে রাখতে হয়। নৌকা ভ্রমণ করে ফিরে এসে তাহলে খাবার তৈরি পাবেন।
অতঃপর দর্শন
নৌকা ঠিক করে আমাদের রাতারগুল ভ্রমণ শুরু হলো। শুরুতে বেশ খানিকটা পথ বড় বিলের মতো (এটি চেঙ্গের খাল নামে পরিচিত), উপরে খোলা আকাশ। খানিক বৃষ্টিও হয়ে গেল কিছুটা। বর্ষায় রাতারগুল ভ্রমণে সকলেই সাথে ছাতা রাখবেন, কারণ হুট করেই ক্ষণে ক্ষণে এমন বৃষ্টির দেখা মিলবে এখানে। খোলা আকাশ আর প্রশস্ত বিল পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম গাছের অরণ্যে। গাছ-গাছালির ঘন নির্জনতায় আকাশটায় হারায় মাঝে মাঝেই। রাতারগুল প্রাকৃতিক বন হলেও বন বিভাগের উদ্যোগে এখানে হিজল, বরুণ, করচ আর মুর্তাসহ বেশ কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়াও রাতারগুলের কদম, জালিবেত, অর্জুনসহ পানিসহিষ্ণু প্রায় ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। মিঠাপানির এই জলাবনে উদ্ভিদের দুটো স্তর দেখা যায়।
উপরের স্তরটি মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত, আর নিচেরটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান। এ বনে সেসব গাছই ভালো জন্মে যেগুলো পানিতে বেঁচে থাকতে পারে। কারণ সারা বছরই পানির আনাগোনা থাকে বনের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। বিশেষ করে আমরা বর্ষার মৌসুমে যাওয়ায় পানির পরিমাণ বেশিই চোখে পড়েছে। গাছ-গাছালির অনেকটা অংশই তাই পানির নিচে চলে গেছে। সোয়াম্প ফরেস্ট দেখার সৌন্দর্য এখানেই।
জীববৈচিত্র্যের আধার
বনের ভেতর দিয়ে যত এগোতে থাকি আমরা, নির্জনতা যেন তত গ্রাস করে। প্রকৃতির এ নীরবতার মাঝেই মাঝে মাঝে পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে রাতারগুলের পরিবেশ। এখানে আছে ১৭৫ প্রজাতির পাখি। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, ফিঙে, বালিহাঁস, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, চিল এবং বাজপাখি ইত্যাদি। শীতকালে অতিথি পাখিরও আনাগোনা থাকে এ বনে। রাতারগুলে সারা বছরই খুব বেশি পরিমাণে চোখে পড়বে ফড়িং। নানা প্রজাতির ফড়িং বনটিকে রঙিন করে তুলেছে।
পাখি আর পতঙ্গের ভিড়ের মাঝে হুটহাট চোখে পড়বে বানরের। এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে বেড়ানো এ বনের বানরদের চলাচলের প্রধান উপায়। কখনোবা পর্যটকদের নৌকায়ও উঠে আসে তারা। পানির রাজত্ব আছে বলে এই বনে সাপের আবাস বেশি, আছে জোঁকও; শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায় বলে স্থানীয়রা বলেন। এছাড়া রয়েছে বানর ও গুঁইসাপ। এসব ছাড়াও রাতারগুলে দেখা পাওয়া যাবে উদবিড়াল, কাঠবেড়ালি, মেছোবাঘ ইত্যাদির। রাতারগুলে উভচর প্রাণী আছে নয়টি প্রজাতির। সরীসৃপ রয়েছে ২০ প্রজাতির। আছে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
রাতারগুলের জলবায়ু
রাতারগুলে সারাবছরই কম-বেশি বৃষ্টি হয়।
সিলেট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রাতারগুলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৪,১৬২ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুলাই মাসেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১,২৫০ মিলিমিটার, অন্যদিকে বৃষ্টিহীন সবচেয়ে শুষ্ক মাসটি ডিসেম্বর। তখন রাতারগুলে পানির দেখা পাওয়া ভার। মে এবং অক্টোবরে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩২° সেলসিয়াস, আবার জানুয়ারির শীতে এ তাপমাত্রা নেমে যায় ১২° সেলসিয়াসে।
ওয়াচ টাওয়ারে পুরো রাতারগুল
বনের ভেতরের গাছ-গাছালির অরণ্য ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা পথ পেরোলে আবার দেখা মিলবে খোলা আকাশের। তখন গাছপালার জটলার চোখে পড়বে নৌকার দুই পাশে। একটু দূরেই চোখে পড়বে বিশাল এক ওয়াচ টাওয়ার।
প্রায় ছয়তলা সমান এই টাওয়ার থেকে পুরো রাতারগুলের অপরূপ সৌন্দর্য এক নজরেই দেখা যাবে। বর্ষায় টাওয়ারে ওঠার নিচের জায়গাটাও পানিতে টইটুম্বুর থাকে। এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। টাওয়ারের সিঁড়িপথ পেরিয়ে যখন একেবারে উপরে উঠবেন, কিছুটা ক্লান্তি হয়তো ঘিরে ধরবে। তবু এরপর যা দেখবেন, তাতে হয়তো ক্লান্তি ছাপিয়ে মনে জায়গা করে নেবে অনাবিল প্রশান্তি।
প্রকৃতি এখানে কতটা সুন্দর, সবুজ আর পানির রাজ্য এখানে কতটা মিলেমিশে আছে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। টাওয়ার থেকে যতদূর চোখ যায়, ততদূরই সবুজের রাজত্ব। প্রকৃতি এখানে সৌন্দর্যের সাথে কোনো কিপ্টেমিই করেনি যেন। রাতারগুলের অন্যতম সৌন্দর্য বোধহয় এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা বনটাতেই।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে নামলেই কাছেই দেখবেন নৌকায় ভাসমান চা আর টা’য়ের ছোট্ট পসরা। নিজেদের নৌকা সেই নৌকার পাশে ভিড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে নিতে পারেন, পাওয়া যাবে ঝালমুড়িও। কিনতে পাওয়া যাবে সিলেটের বিখ্যাত চা-পাতাও। তবে এই চা-পাতা কতটা ভালো মানের হবে, সেটা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থাকেই। সাধারণত বর্ষায় এই পসরা সাজিয়ে বসেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।
এবার যে যেতে হবে
দুপুর ঘনিয়ে আসছে। আমরা তাই ভাসমান দোকানের চা আর ঝালমুড়ির স্বাদ নিয়ে ফেরার পথ ধরি। আবার জেঁকে ধরে বৃষ্টি। ছাতা মাথায় নিয়ে আরও একবার রাতারগুলে রূপে মুগ্ধ হই। গাছ-গাছালির খুব কাছ দিয়ে যখন নৌকা যায়, তখন অনেককেই দেখি গাছে চড়ে বসে। তবে মাথায় রাখা উচিত, পানি বেশি থাকায় এ সময় গাছেই সাপের দেখা মেলে। আছে জোঁকের ভয়ও। তাই সাবধান থাকা উচিত গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।
সচেতনতায় রাখায় বাঁচুক রাতারগুল
রাতারগুল অনিন্দ্যসুন্দর এক পর্যটনস্থল। প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসে। বনের জীববৈচিত্র্য আর পরিবেশ রক্ষাও তাই সবসময় হুমকিতে থাকে। বনটি রক্ষায় পর্যটকরাই সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা পালন করতে পারেন। ঘুরতে গিয়ে পানি বা গাছে খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল কিংবা যেকোনো ধরনের বর্জ্য ফেলে আসা থেকে বিরত থাকুন। জীববৈচিত্র্যকে তার মতো করে বাঁচতে দিন। আমাদের এ সম্পদ আমরাই বাঁচিয়ে রাখব আমাদের আচরণ আর সচেতনতার মাধ্যমে।