চিৎ হয়ে ট্রলারে শুয়ে ছিলাম। খোলা সমুদ্রে একদম সরাসরি সূর্যের আলো থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা হিসেবে মুখের উপর জ্যাকেটটা দেয়া। কে বুঝেছিল শৈত্য প্রবাহের এই সময়ে এমন গনগনে সূর্য তার প্রখর রোদে পুড়িয়ে দেবে! ট্রলারে শুয়েই নীল আকাশ দেখছি, নীল সমুদ্র দেখছি। কোনো কূল-কিনারা নেই সাগরের, যেদিকে তাকাই নীল আর নীল! মাঝে মাঝে কিছু মাছ ধরার ট্রলার ভেসে যাচ্ছে, তার ফাঁকে ফাঁকে উড়ছে গাংচিল। অদ্ভুত মোহনীয় দৃশ্য! খোলা সাগরে ট্রলারে চেপে আমরা ১২ জন যাচ্ছি সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
আগের রাতে ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বাসে উঠে রওনা দিয়েছিলাম। ভোরেই পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার। নাস্তা সেরে কলাতলী সৈকতে গিয়ে সমুদ্র-দর্শন করে নিলাম। সমুদ্রের সৌন্দর্য বরাবরই অমলিন, যতবারই তাকে দেখি সেই একই ভালো লাগা কাজ করে। সৈকতে কিছুটা সময় কাটিয়ে সিএনজি ভাড়া করে ট্রলার ঘাটে চলে গেলাম। ট্রলার আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল, গিয়ে উঠে পড়লাম আর রওনা দিলাম সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে।
কক্সবাজার থেকে ৭-৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী উপজেলায় সোনাদিয়া দ্বীপটি। পর্যটকে ভরা সমুদ্র সৈকতে সাগরের প্রকৃত রূপটা কোথায় যেন ঢাকা পড়ে যায়। তাই নিরিবিলিতে সমুদ্রের গর্জন শুনতে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়া। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার দুয়েক লোকের বাস ৯ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপে।
এখানে গভীর সমুদ্র বন্দর বানানোর পরিকল্পনা আছে সরকারের। এই দ্বীপে প্রজননের সময় অনেক কচ্ছপ দেখা যায়। আসে অনেক নাম না জানা অতিথি পাখিও। তবে সবসময়ই দেখা যায় অনেক লাল কাঁকড়া। দ্বীপের লোকজনের পেশা মাছ ধরা, শুটকি বানানো, লবণ চাষ ও মহিষ পালন। এখনও পর্যটন স্থান হয়ে ওঠেনি, ফলে মানুষের আনাগোনা নেই তেমন, সেই সাথে নেই পর্যটক-বান্ধব থাকার ব্যবস্থা বা খুব উন্নত খাবারদাবার। তাই খাবারের জোগাড়ও সাথে করেই কিছুটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দ্বীপের একজন বাসিন্দার বাসাতেই খাবার রান্নার ব্যবস্থা হলো, কারণ সমুদ্রের পাড়ে এই শীতের ঠান্ডা বাতাসে আগুন জ্বালানো ও তাতে রান্না করা খুব সহজ বিষয় মনে হচ্ছিল না।
ট্রলার এসে তীরে ভীড়ল। তীর থেকেই একনজর দেখে নিলাম দ্বীপটা। অনেকখানি জুড়ে শুধু বালু আর বালু, এরপর সাড়ি বাঁধা ঝাউ গাছ। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! ট্রলার থেকে ব্যাগ, তাবু সব নামিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে সৈকতে একটা দৌড় দিলাম মনের আনন্দে। সাথের সবার অবস্থাও আমার মতোই। সমুদ্রের পাড়ে খানিকক্ষণ হাঁটলাম, দেখলাম লাল কাঁকড়াও। তবে মানুষ দেখে ভয়ে বালুতে ঢুকে ছিল প্রায় সবই, দুই-একটা অতি সাহসী কাঁকড়া দেখতে এসেছিল বোধহয় কে এসেছে তাদের দ্বীপে! সূর্য ততক্ষণে একদম মাথার উপরে। রোদে পুড়তে পুড়তে তাবু খাটানো হলো। ধূ ধূ বালুচরে সারবাঁধা ৭টি তাবু।
সবকিছু গোছগাছ করে দ্বীপটা কিছুটা ঘুরে দেখলাম। তাবু যেখানে ফেলা হয়েছিল তার পেছনে একটু দূরেই ঝাউবন। ঝাউবনের শীতল ছায়ার আবেশে ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে।
কিন্তু এখন ঘুমোলে তো হবে না, আগে পেটপূজো করা চাই! খবর এলো, রান্না হয়েছে। এই দ্বীপে টিউবওয়েল আছে, আছে মাটির নীচে মিঠা পানি। খাবার খাওয়ার সময় মনে হলো অমৃত খাচ্ছি! সাধারণ আলু ভর্তা আর মুরগীর ঝোলে যে এত স্বাদ থাকতে পারে জানতাম না! খাওয়ার পর দ্বীপের পেছন দিকটা একটু ঘুরে দেখলাম। বেশ নিরিবিলি জায়গাটা, সামনে অনেকটা জায়গায় ঘের দিয়ে লবণ বানানো হচ্ছে। সেন্ট মার্টিনের মতো অত নারিকেল গাছ নেই অবশ্য, তবে নাম না জানা অনেক গাছপালা আছে। একদম ছবির মতো ছোট্ট সুন্দর দ্বীপ।
ঘুরে ঘুরে আবার তাঁবুর কাছে ফিরে যাওয়া। রোদ পড়ে এসেছে, সৈকতে হাঁটতে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া। ততক্ষণে ভাটার টানে পানি নেমে গেছে অনেকখানি, নরম বালুতে পা দেবে যায়। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো হারিয়ে গেছি কোথাও, অপার্থিব কোনো এক জগতে। এই তীব্র নির্জনতা শুধু অনুভব করার বিষয়!
সূর্যাস্ত দেখে তাবুতে ফিরলাম। শীতের কাপড় জড়িয়ে নিয়ে আবার দ্বীপের ভেতর চলে গেলাম দোকানে চা পান করতে। পুরো দ্বীপ অন্ধকার, শুধু মাথার ওপর কোটি কোটি নক্ষত্র! দ্বীপের মানুষগুলোও খুব আন্তরিক। রাতে খুব যত্ন করে সামুদ্রিক মাছ রেঁধে খাওয়ালো। খাবার খেয়ে আবার রাতের সৈকতে হাঁটাহাঁটি, মাথার উপর সদ্য পূর্নিমা গত হওয়া চাঁদ আর কোটি তারার হাট-বাজার। কক্সবাজারের রাতের সৈকতে হেঁটেছি আগে, কিন্তু এমন শান্তি আর ভয়ংকর সৌন্দর্য সেখানেও পাইনি। এমন রাত ঘুমিয়ে পার করার কোনো মানে হয় না।
সিদ্ধান্ত হলো, বার-বি-কিউ করা হবে। কিন্তু এই খোলা সমুদ্র তীরে বার-বি-কিউ কি আদৌ হবে? চেষ্টা করতে দোষ কী? এই ভেবে আয়োজন শুরু। খুঁজে খুঁজে শুকনো ঝাউ এর ডালপালা নিয়ে আসা হলো। বালুতে একটু গর্ত করে আগুন জ্বালানো হলো বহু কষ্টে। এরপর মুরগী দিয়ে বসে থাকার পালা, কখন সেদ্ধ হয়! আগুনের তেজ এই বাড়ে তো এই কমে, নিয়ন্ত্রণ করাই দায়! যে জিনিসটা শেষে পাওয়া গেল তাকে বার-বি-কিউ এর বদলে মুরগী-পোড়া বললেই ভালো মানায়। তবে দেখতে যেমনই হোক, খেতে ছিল দারুণ সুস্বাদু। গল্পগুজবে কেটে গেল একটা সুন্দর রাত।
ভোর বেলার সমুদ্রের এক আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। মাইলের পর মাইল জনমানবহীন সমুদ্র, সাগর পাড়ের শীতল হাওয়া আর পায়ের নিচে শান্ত বালু।
কালকের লুকোনো কাঁকড়াগুলো আজ সৈকত ভ্রমণে বেরিয়েছে। শয়ে শয়ে লাল কাঁকড়া, কাছে যেতেই দৌড়ে গর্তে ঢুকে পড়ছে, নয়ত পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। অনেক কষ্টে একটি সাহসী কাঁকড়ার একটা ছবি তুলতে পারলাম। আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমী হন, এই দ্বীপ আপনার ভালো না লেগেই পারে না। এই নির্জন বালুচরে হেঁটেই পার করে দেয়া যায় ঘন্টার পর ঘন্টা।
নাস্তা খেয়ে ফেরার পালা। আসার আগে খুব ভালো করে সবাই দেখে নিলাম কোনো প্লাস্টিকের ব্যাগ বা নোংরা কিছু ফেলে আসলাম কিনা। ঘুরতে গিয়ে জায়গাগুলো নষ্ট যাতে না করি এটা সব ভ্রমণকারীরই মাথায় থাকা উচিৎ।
এবারের ট্রলারটা আগেরটার চেয়ে ছোট। দুলুনিতে ট্রলার একটু পরপরই এদিক সেদিক কাৎ হয়ে যায়, এই মনে হয় ডুবে গেলাম! তাতেও অবশ্য এক অন্যরকম রোমাঞ্চ। দুপুরের আগেই কক্সবাজার ফিরে বিখ্যাত ‘লইট্টা ফ্রাই’ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। কেমন করে যেন পুরো ভ্রমণটা খাবারদাবার সমৃদ্ধ একটা ভ্রমণ হয়ে গেল। অথচ যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম ক্যাম্পিং করতে যাচ্ছি, ভাতও জোটে কিনা কে জানে! খাওয়ার পাট চুকিয়ে সিদ্ধান্ত হলো প্যারাসেইলিং করার। সেই সাথে মেরিন ড্রাইভটাও দেখা হয়ে যাবে। রাস্তাটা আসলেই অনেক সুন্দর। একপাশে হিমছড়ির পাহাড় আর অন্যপাশে বিশাল সমুদ্র দেখতে দেখতে যাওয়া। প্যারাসেইলিং ব্যাপারটাও বেশ মজাদার, একদম মাঝ সমুদ্রে শূন্যে ভেসে থাকা! জীবনে একবার হলেও এই অভিজ্ঞতাটা নেয়া উচিৎ।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল, ফেরার সময়ও হয়ে এলো। অসাধারণ দুটো দিন কাটিয়ে লোকালয়ে ফেরার পালা। ভ্রমণপিপাসু মনটার খোরাক যোগাতে হয়ত কিছুদিন পরই আবার বেরিয়ে পড়বো অন্য কোনো সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে। একসময় যেন পেছনে তাকালে নিজের অসাধারণ মুহূর্তগুলো দেখে নিজের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করে, তার জন্যই এই ছোট্ট জীবনে যতটা পারা যায় সুন্দর মুহূর্ত জমিয়ে নেয়া।
ফিচার ইমেজ: ইমরান মুর্শেদ