শহরের যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ভ্রমণে যাব। আমরা ছিলাম দু’জন, তাই ভাবলাম- কোনো ভ্রমণদলের সাথে যুক্ত হয়ে গমনে যাওয়ার। ভ্রমণের দল খোঁজার জন্য বেছে নিলাম জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ভ্রমণভিত্তিক গ্রুপ ও পেজগুলোকে। ক্ষণিকের ভেতর পেয়েও গেলাম একটি ভ্রমণ দলকে। লাল পাহাড়ের দেশ রাঙামাটি নিয়ে তাদের একটি ভ্রমণ ইভেন্ট ছিল। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বুকিং করে চূড়ান্ত করে নিলাম। যা-ই হোক, অতঃপর আমাদের ভ্রমণ শুরু…।
দিনটি ছিল ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২; রোজ বৃহস্পতিবার। রাত ১০টা নাগাদ আমাদের রিজার্ভ করা পরিবহনটি ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সবাই একসাথে না হওয়ায় গাড়ি ছাড়তে প্রায় দেড় ঘন্টা দেরি হয়। ঘড়ি বলছে রাত ১১টা বেজে ২৭ মিনিট; চালকের প্রস্তুতি দেখে বুঝতে পারছি- গাড়ি ছাড়বে ছাড়বে, আসনে বসে আঁচ করতে পারলাম- বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। এরই মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিল। সৃষ্টিকর্তার নামে আমরা চললাম; গন্তব্য লাল পাহাড়ের দেশ।
বসে আছি সিটে, চলছে গাড়ি; মনে হচ্ছে, অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে মেঘগুলোর জমে থাকা অভিমান রূপ নিয়েছে বৃষ্টিতে। এরই মাঝে আমাদের সাথে থাকা কিছু ভাই যেন হয়ে উঠলেন সাময়িক সঙ্গীতশিল্পী। তাদের কভার করা গান শুনে মনে হচ্ছে- কেউ নবীন প্রেমিক, কেউ প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থ, কেউ বা চিরকুমার! মেঘনা নদীর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম- মেঘগুলোর জমে থাকা অভিমান বোধহয় কমেছে, তাই বুঝি এখন বৃষ্টি নেই। তাহলে কী হয়েছে? গাড়িতে বসে তো আমাদের আনন্দের কমতি নেই! কারণ, শিল্পীরা যে থেমে থেমে একের পর এক গান গেয়েই যাচ্ছে।
এদিকে সময় বলছে রাত ১টা বেজে ২০ মিনিট। কেউ চোখের পাতা নামিয়ে প্রিয়জন বা পরিবারের কথা ভাবছে, কেউ বা সারাদিনের ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তা কীভাবে হয়? ঐদিকে কুমিল্লার কালাকচুয়া আমাদের স্বাগত জানিয়ে খন্দকার ফুড গ্যালারি অ্যান্ড চাইনিজ বাংলা রেস্তোরাঁ যে অপেক্ষা করছে! হ্যাঁ, যাত্রাবিরতিতে স্থির হয়ে গেল বাসটি। সময় ২০ মিনিট, এক এক করে সবাই নেমে ফ্রেশ হয়ে কেউ খেয়ে নিচ্ছে, কেউ বা রেস্তোরাঁর আশপাশ ঘুরে দেখছে। সময় ঘনিয়ে এসেছে; উঠে পড়লাম বাসে, চলছে গাড়ি। এবার আর গান হচ্ছে না। শিল্পীরা সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘন্টা দেড়েক পর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আগে শেষবারের মতো খুবই স্বল্প সময়ের যাত্রাবিরতি। নাহ, এবার আর খাবার নয়, প্রাকৃতিক কার্য সেরে নেওয়ার সুযোগ! আবারও চলল গাড়ি। সীতাকুণ্ডে প্রবেশ করে কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি থেকে চোখে পড়ল ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার অংশবিশেষে। একপলক দেখে ওই স্থানকে পেছনে ফেলে চললাম সামনের দিকে।
ফজরের আজানের সময় হয়েছে। জানালা দিয়ে দেখছি হাটহাজারী, রাউজান অতিক্রম করে রাঙামাটি জেলা আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। দুই দফায় চেকপোস্টে নাম দিয়ে পৌঁছে গিয়েছি রাঙামাটি শহরে। রাঙামাটির আনাচে-কানাচে প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে আদিবাসীদের বসবাস। ঘড়ির অ্যালার্ম টুং টুং করে বলছে, “সকাল ৬টা বেজে ৩০ মিনিট!” শহরে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম।
এবার আমাদের ভ্রমণের তালিকায় থাকা দর্শনীয় স্থানগুলো এক এক করে ঘুরে দেখব। ছোট এক সংকীর্ণ পথের ভেতর দিয়ে গিয়ে উঠে পড়লাম রিজার্ভকৃত ইঞ্জিনচালিত নৌযানে। চলছে তরী; একপাশে বাঁশ আর টিন দিয়ে আদিবাসীদের একতলা-দোতলা ঘরবাড়ি, অন্যপাশে লেকের প্রবাহমান স্রোত দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আমাদের অদেখা প্রথম দর্শনীয় স্থান পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজে।
পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজ
কাপ্তাই হৃদের তীর ঘেঁষে রাঙামাটি জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে ডিসি বাংলো রোডে পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজের অবস্থান। পার্কটি রাঙামাটি জেলার এক অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। পার্কের প্রবেশপথ কৃত্রিম মুখাবরণের অভিন্নতায় নির্মাণ করা হয়েছে। প্রবেশের পর দেখা মিলবে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি’র (পুনাক) পরিচালিত প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র।
২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর পার্কটির শুভ উদ্ভোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও এনডিসি জনাব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। ২০২০ সনের ৪ মার্চ পার্কের ঝুলন্ত সেতুর শুভ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ পুলিশের রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় নিযুক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল ও বিপিএম (বার) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ছোঁয়া রয়েছে এখানে। পার্কটিতে নোঙর করা নৌযানের পাশে রয়েছে হেলানো চেয়ার, যেখানে বসে কাপ্তাই লেকের অসাধারণ মুহূর্ত উপভোগ করা যায়।
পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজটি খুব বড় নয়, তবে ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সুইমিংপুল, জেট স্কিইং, কৃত্রিম ভূতুড়ে পাহাড়ের ধাঁচে গুহা, কৃত্রিম পাহাড়ি ঝর্ণা, ঝুলন্ত সেতু, হিলভিউ পয়েন্ট, ফিশিং পিয়ার ও লেকভিউ পয়েন্ট। কিছু অর্থের বিনিময়ে কাপ্তাই হ্রদে প্যাডেল বোট ও কায়াকিংয়ের সুযোগও রয়েছে।
এছাড়া পার্কের শেষপ্রান্তে রয়েছে লাভ পয়েন্ট। এখানে আসা বেশিরভাগ দর্শনার্থীরা এই লাভ পয়েন্ট তৈরির পেছনের ইতিহাসটি পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান।
আমেরিকা প্রবাসী আলাউদ্দিন তার স্ত্রী আইরিন সুলতানা লিমাকে নিয়ে রাঙামাটি বেড়াতে আসেন ২০১৪ সনের ১৯ মার্চ। ঐ দিনই একটি ইঞ্জিন বোট নিয়ে কাপ্তাই হ্রদে নৌ-ভ্রমণকালে আকস্মিক ঝড়ে নৌকাটি দুলে উঠলে লিমা ভয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়, স্ত্রীকে বাঁচাতে আলাউদ্দিনও হ্রদের জলে লাফিয়ে পড়েন। ডুবুরীরা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের খুঁজে পায়নি। তিনদিন পর ২২ মার্চ পরস্পরকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় আলাউদ্দিন ও লিমার লাশ পানিতে ভেসে উঠে। মৃত্যুও বুঝি এই দম্পতিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। ভালোবাসার এমন বিরল দৃশ্য পার্বত্য শহর রাঙামাটির মানুষকে আপ্লুত করে। আলাউদ্দিন-লিমার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যে স্থানে তাদের মরদেহ ভেসে উঠেছিল, তার পাশেই পলওয়েল ন্যাচার পার্কে নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম লাভ পয়েন্ট। শুধু এ দম্পতিই নয়, সারা পৃথিবীর সব প্রেমিক-প্রেমিকার চিরন্তন ভালোবাসার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে নিবেদিত স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনায়।
পলওয়েল পার্ক অ্যান্ড কটেজ ঘুরে উঠে পড়লাম নৌযানে। চললাম আমাদের অদেখা দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থানে। আশেপাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম রাঙামাটির জনপ্রিয় ও ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ঝুলন্ত সেতুতে।
ঝুলন্ত সেতু
প্রাকৃতিক উদ্ভিদে ঘেরা দুটি পাহাড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের উপর পুরু মজবুত তারে ঝুলে আছে সেতুটি। এই সেতুকে ঘিরে স্থানীয় আদিবাসীরা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা ক্ষুদ্র আয়োজন করে থাকে। ৩৩৫ ফুট লম্বা ঝুলন্ত সেতুটির একপাশ থেকে পাহাড়ে ওঠার পথ রয়েছে। অনেক দর্শনার্থী এই পথ বেয়ে পাহাড়ে উঠে হারিয়ে যান প্রকৃতির সান্নিধ্যে। ঝুলন্ত সেতুর দু’প্রান্ত থেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে নৌকায় চড়ে কাপ্তাই লেকের আশপাশ উপভোগ করার সুযোগও রয়েছে।
ঝুলন্ত সেতুর চারপাশ ঘুরে দেখে নৌকায় কাপ্তাই লেক ধরে সামনে কিছুদূর এগিয়ে পাথরের একটি পাহাড়ের পাশেই নৌকাটি থামল। সেখানে আমাদের দলের কয়েকজন কাপ্তাই হ্রদে অবগাহন সেরে দুপুরের খাবারের জন্য চলে গেলাম পাহাড়ের ভেতর আদিবাসীদের হোটেলে। দুপুরের খাবার সেরে পাহাড়ের উপরে ওঠা শুরু করেছি। যতই উপরে উঠি, চূড়া আর খুঁজে পাই না; চেষ্টা ছিল প্রকৃতিঘেরা পাহাড়ের শিখরে ওঠার, কিন্তু সময়ের স্বল্পতা আর নাগরিক ব্যস্ততার পিছুটানে তা হয়ে উঠল না। তাছাড়াও, চূড়ায় কোনোভাবে উঠতে পারলেও, নিচে নামার সময় অনেক হিমশিম খেতে হবে। তাই উপরে ওঠার সাহস আর হয়নি।
নৌকায় বসে বিশ্রাম নিতে নিতে কাপ্তাই লেক ধরে চলে গেলাম অদেখা তৃতীয় দর্শনীয় স্থান পাহাড়ি ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। ঝর্ণার নাম নিয়ে ভ্রমণসঙ্গীদের কাছ থেকে শুনেছি- এটি শুভলং ঝর্ণা। কিন্তু গুগল করে এর ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাইনি। পানি না থাকায় আমরা ফটোশ্যুট করে উঠে পড়ি নৌকায়। ফিরতি পথে নৌকাটি এগোচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর পৌঁছে যাই অদেখা চতুর্থ দর্শনীয় স্থান আদিবাসীদের তাঁতপল্লী বা পাহাড়ি মার্কেটে।
পাহাড়ের উপর তৈরি করা হয়েছে এই আদিবাসী তাঁতপল্লী। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম চাকমা জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজ হাতে বোনা পোশাকগুলো দর্শনার্থীদের কাছে বিক্রি করছেন। পাশাপাশি, তাদের ঘরবাড়িও দেখার সুযোগ হলো।
কিছুক্ষণ থেকে নৌকায় উঠে চললাম বৌদ্ধ মন্দির ও আদিবাসী বাজারের উদ্দ্যেশ্যে। সবুজে ঘেরা পাহাড় আর প্রবাহমান পানির স্রোত দেখতে দেখতে পৌঁছলাম সেখানে। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে বৌদ্ধ মন্দির দেখে, পায়ে হেঁটে কিছুদূর এগিয়ে আবার পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে চলে গিয়েছি আদিবাসীদের বাজারে। বাজারে চায়ের দোকানে বসে স্থানীয়দের জীবনের কিছু গল্প শুনলাম। তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে গেলাম আমাদের নৌকায়।
শেষ হলো আমাদের একদিনের রাঙামাটি ভ্রমণ। এবার ব্যস্ততম যান্ত্রিক নগরীতে ফেরার পালা। নৌযানে চড়ে কাপ্তাই হ্রদের সুন্দর মুহূর্তগুলোকে বিদায় জানিয়ে পৌঁছে গেলাম ঘাটে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় রাঙামাটি পার্কটি একঝলক দেখে বিকেলে চলে গেলাম রাঙামাটি পুলিশ সুপারের বাসভবন হয়ে শহীদ মিনারের পাশে পার্কিংয়ে থাকা আমাদের রিজার্ভ করা পরিবহনের কাছে। রাঙামাটি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পরিবহনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা রাত ৮টা নাগাদ। তাই হাতে প্রচুর সময় থাকায় আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো গাড়িতে রেখে শহীদ মিনারের কাছেই হেঁটে-বসে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেই।