যারা পাহাড়-ঝর্ণা, খাল-বিল ঘুরতে ভালোবাসেন, তারা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির পর যে নামটি বলে থাকেন সেটি সিলেট। পার্বত্য জেলা তিনটি থেকে সিলেট যেদিক থেকে আলাদা তা হলো, এখানে রয়েছে প্রচুর খাল-বিল ও হাওড়-বাওড়। সিলেটের যে জিনিসটি দেশের অন্য যেকোনো জেলার সাথে তুলনা করার মতো নয় সেটি হচ্ছে এখানকার চা বাগান।
একসময়ে আসামের সাথে যুক্ত সিলেট বাংলাদেশের হয়ে গেলেও এখানকার চা বাগানগুলো কিন্তু হারিয়ে যায়নি। এই চা বাগানগুলো যেমন সিলেটকে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর করে তুলেছে, ঠিক তেমনি এগুলো সিলেটের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর সিলেট শহরটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ৩৬০ আউলিয়ার দেশ খ্যাত সিলেটের আয়তন ৩,৪৫২.০৭ বর্গ কি.মি.। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় (খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়), পূর্বে ভারতের আসাম (কাছার ও করিমগঞ্জ জেলা), দক্ষিণে মৌলভীবাজার এবং পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। সিলেটের এমন বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক সীমানার কারণেই হয়তো চা বাগান, পাহাড়-টিলা, হাওড়-বাওড় আর ঝর্ণার এত সুন্দর সমন্বয় গড়ে উঠেছে এখানে।
রাজধানী ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেন দুটোতেই যাওয়া যায় সিলেটে। ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাতে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লাগে। ঢাকা থেকে সিলেটে যায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, পাহাড়িকা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস ও সুরমা মেইল। শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এনাসহ আরো কিছু বাস রয়েছে সিলেট যাওয়ার। এগুলো সিলেটের কদমতলী বাস স্ট্যান্ডে থামে। বাসে যেতে সাধারণত পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগলেও, যানজট ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে বেশি সময় লাগতে পারে। যারা নিয়মিত ট্রেনে করে সিলেট রুটে যান, তাদের হয়তো কিছু মনে হবে না। কিন্তু নতুন যারা যাচ্ছেন তারা ট্রেনে পাবেন কিছুটা রোলার কোস্টারের স্বাদ। রোলার কোস্টারের মতো কোনো উঁচু পাহাড় থেকে ট্রেন খাদে নেমে পড়ে ব্যাপারটা এমন নয়, তবে প্রতিনিয়ত বাম্পিং (উপরে নিচে দোলা) করতে থাকে। আর এর গতি এমনই যে কিছু না ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আপনি যদি রক বা মেটাল মিউজিকের শ্রোতা হন, তাহলে এ পরিস্থিতিকে উপভোগ্য করে তুলতে পারেন কানে হেডফোন গুঁজে এ ধারার গান শুনতে শুনতে।
সিলেট শহরে থাকা খাওয়ার কোনো ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে এখানে অনেক থাকা ও খাওয়ার হোটেল গড়ে উঠেছে। প্রায় পুরো শহরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক হোটেল। সিলেটে হোটেল ব্যবসা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা গ্রুপ ট্যুরে যাবেন তারা হোটেল রুম বুকিং দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে নেবেন এক ঘরে কতজন থাকতে পারবেন, কেননা কিছু কিছু হোটেলে এক রুমে দুজনের বেশি মানুষকে থাকতে দেওয়া হয় না।
সিলেটে রোদ যেমন চড়া হয়, তেমনি সারাদিন ধরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হতে পারে। তাই ছাতা, রেইনকোট, পলিথিন, অতিরিক্ত কাপড়-চোপড় ইত্যাদি সাথে রাখতে হবে। এমন হতে পারে যে আপনি ভেজা কাপড় নিয়ে হোটেলে ফিরলেন এবং পরদিন সকালে উঠে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
সিলেটে ঘুরতে চাইলে শহর দিয়ে শুরু করা যায় কারণ শহরেই রয়েছে বেশ কিছু ঘোরার জায়গা।
ক্বীন ব্রিজ
সিলেটে ঘোরাঘুরি করতে হবে একটু পরিকল্পনা করে, কারণ এখানে দেখার মতো জায়গাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর কিছু আছে শহরে, কিছু এর আশেপাশে, আর কিছু শহরের বাইরে। সিলেট শহরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ক্বীন ব্রিজ। সুরমা নদীর উপর ঐতিহ্যবাহী এ ব্রীজটি শহরের প্রবেশদ্বার। ব্রীজটির নির্মাণশৈলী ও গড়ন দেখে যে কেউ বলে দিতে পারে এটি ব্রিটিশ আমলের নিদর্শন। ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর উপর ট্রেন চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয় ব্রীজটি। আর এর নামকরণ করা হয় আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল ক্বীনের নামে। এখন অবশ্য এটি দিয়ে গাড়ি চলাচল করে।
আলী আমজাদের ঘড়ি
“চাদনী ঘাটের সিড়ি
আলী আমজাদের ঘড়ি
বন্ধু বাবুর দাড়ি
আর জিতু মিয়ার বাড়ি”
সিলেটের উপকথায় যে বিখ্যাত আলী আমজাদের ঘড়ির কথা বলা হয়েছে সেটি দেখতে পাওয়া যাবে ক্বীন ব্রীজের উপর দিয়ে যাওয়ার সময়েই। ১৮৭৪ সালে সিলেটে লর্ড নর্থব্রুক-এর সফর উপলক্ষে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিম পাশার জমিদার আলী আমজাদ নিজ খরচে সুরমা নদীর তীরে এটি নির্মাণ করেন।
জিতু মিয়া বাড়ি
এ বাড়িটি নগরীর একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। এটি শেখঘাটে কাজীর বাজার দক্ষিণ সড়কে অবস্থিত। ১ দশমিক ৩৬৫ একর জমির উপর নির্মিত এ বাড়িটি। খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া, যিনি জিতু মিয়া নামে পরিচিত, তিনি এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হলে বর্তমান স্থানে বাড়িটি স্থানান্তরিত হয়।
মণিপুরী রাজবাড়ি ও মণিপুরী মিউজিয়াম
মণিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষ সিলেটে বহু আগে থেকেই বসবাস করে আসছে। শহরের মির্জাজাঙ্গাল ও লামাবাজার এলাকার মাঝামাঝি অবস্থিত এ রাজবাড়িটি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছে রাজবাড়ির এক-তৃতীয়াংশ, যা টিকে আছে তা-ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। বর্তমানে মণিপুরী ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর পরিবারের লোকেরা বংশ পরম্পরায় এখানে বসবাস করছে। এখানে দেখতে পাওয়া যাবে মণিপুরী রাজার রেখে যাওয়া একটি এক মণ ওজনের ঘণ্টা।
মণিপুরী কৃষ্টি সংস্কৃতি, ইতিহাস- ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি মণিপুরী মিউজিয়াম। এটি অবস্থিত সুবিদবাজারে।
মিউজিয়াম অব রাজাস
শহরের জিন্দাবাজারে অবস্থিত এ জাদুঘরটি। মরমী কবি হাছন রাজা ও তার পারিবারিক স্মৃতি ধরে রাখতে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে হাছন রাজার গানের পাণ্ডুলিপি, পোষাক, ব্রিটিশ সরকারের দেয়া খান বাহাদুর মেডেলসহ দেখার আছে আরো অনেক কিছু।
ওসমানী মিউজিয়াম
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কমান্ডার জেনারেল এম এ জি ওসমানীর স্মরণে এ জাদুঘরটি নির্মিত হয়েছে। এটি শহরের নাইয়রপুল এলাকার নুর মঞ্জিলে অবস্থিত। এই নুর মঞ্জিল হচ্ছে বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণী ওসমানীর পৈতৃক নিবাস।
গৌড় গোবিন্দ দুর্গ
এটি হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের দুর্গ, যা হযরত শাহজালাল (রহ.) ইসলাম প্রচার করতে আসার সময় ধ্বংস করেন। এটি সিলেট রেলস্টেশনের কাছে বর্তুখোলায় অবস্থিত।
হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার শরীফ
এটি একেবারেই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এ জায়গাটি চেনে না সিলেটে এমন কোনো মানুষ নেই। তাই এটি খুঁজে পাওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। বলা যায়, এটি না থাকলে সিলেট শহর বর্তমান অবস্থায় আসতো না। এর কারণেই সিলেট শহর এত বিখ্যাত। সিলেটে গেলে পর্যটকরা অন্তত একবার হলেও এ মাজার ঘুরে আসেন। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতি বছর দলে দলে মানুষ বাস ভাড়া করে আসে শুধু মাজার জিয়ারত করতে।
হযরত শাহজালাল (রহ.) ১৩০৩ সালে সিলেটে আসেন। তিনি ছিলেন আরবের ইয়েমেনের অধিবাসী। কথিত আছে, হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মামার দেওয়া মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল আছে বলে এখানে আস্তানা করেন শাহজালাল (রহ.)।
মাজারের ভেতরে দরগা চত্ত্বরে ১৪০০ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’ (বাংলায় লেখা সিলেটের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ) থেকে জানা যায়, শাহজালাল (রহ.) এক ছোট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর তাঁকে সেখানেই দাফন করা হয়।
সিলেটবাসীর কাছে এ এক পবিত্র স্থান। এ জায়গাটির জন্য যে সিলেটের মানুষের কত ভক্তি আর ভালোবাসা তা এখানে আসলেই বুঝতে পারবেন। মাজারের একটি পুকুরে রয়েছে গজার মাছ। এই মাছগুলোকে পবিত্র ভাবা হয় এবং দর্শনার্থীরা এগুলোকে খেতে দিয়ে থাকেন, যা মাজারের ভিতরেই বিক্রি হয়। ২০০৩ সালে বিষ প্রয়োগে প্রায় সাতশ’র বেশি মাছ মরে পুকুরটি মাছশূন্য হয়ে গিয়েছিল। ২০০৪ সালে পুকুরে আবার গজার মাছ ছাড়া হয়। এখানে আরো দেখতে পাওয়া যায় বিশেষ জালালী কবুতর, দিল্লির নিজামউদ্দীন আউলিয়া (রহ.) শাহজালাল (রহ.)-কে উপহার দিয়েছিলেন। এখানে রয়েছে একটি পানির কূপ। সিলেটে মানুষের তৎকালীন পানযোগ্য পানির অভাব দূর করতে এ কূপ খনন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে শাহজালাল (রহ.) এ কূপ খননের ব্যবস্থা করেন। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে, এর সাথে সংযোগ আছে মক্কার যমযম কূপের। বিশাল তিনটি হাড়ি রয়েছে যেগুলোতে একসময় রান্না হত।
চলবে…
ফিচার ইমেজ © আখতার হোসেইন