সরকারি হাসপাতালগুলোতে আপনি হয়তো কিছু অল্পবয়সী ছেলেদের দেখে থাকবেন। হাসপাতাল করিডোরে আপন মনে হাঁটাহাঁটি করছে। বয়স ৭, ৮ বা ৯ এর ঘরে। এর বেশিও হতে পারে। প্রথম দেখায় ছেলেটির যে বৈশিষ্ট্যটি আপনার চোখে ধরা দেবে, তা হলো ছেলেটির পেটের অস্বাভাবিকতা। ‘কুয়াশিওরকর’ নামক একটি রোগেও বাচ্চাদের পেটের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, তবে সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষজনদের নিয়ে গড়ে উঠা বস্তি এলাকাসমূহে আপনি কুয়াশিওরকরে আক্রান্ত ছোট বাচ্চা দেখতে পাবেন।
থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত তাদের দেহের একটি নরম অঙ্গ আকারে বড় হয়ে যায়। অঙ্গটি হলো প্লীহা বা স্প্লীন। প্লীহা আমাদের শরীরে রক্ত উৎপাদনে সহায়তা করে। ছোট একটি অঙ্গ, পাকস্থলীর বাম পাশে অবস্থান করে থাকে। স্বাভাবিকের তুলনায় আকারে প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ একটি লক্ষণ। এছাড়াও যকৃৎ অর্থাৎ লিভারও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আকারে বড় হয়ে যায়। এসকল কারণ মিলিয়েই পেটের গড়নে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। থ্যালাসেমিয়ার একজন রোগীকে একটু ভালোমতো লক্ষ্য করলে সহজেই চেনা যায়। বয়সের তুলনায় পেটের অস্বাভাবিকতার সাথে উচ্চতাও স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়ে থাকে তাদের।
আপনি কোনো মধ্যবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধকে থ্যালাসেমিয়ার রোগী হিসেবে দেখবেন না। প্রাণীর দেহে রক্তের মাধ্যমে দেহের সমস্ত কার্যাবলী আবর্তিত হয়। থ্যালাসেমিয়ার আক্রমণটা আসে সেই রক্তেই। সাধারণত ১৫-২০ বছর পর্যন্ত একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগী বেঁচে থাকে। রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে ক্রিয়ায় নানারকম জটিলতা শুরু হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৩০ বছর বয়স পর্যন্তও বেঁচে থাকতে দেখা যায়।
এ রোগের ভয়াবহতার কারণ কী? এটি একটি জিনগত রোগ। বংশাণুক্রমে ছড়ায় এটি। এর কারণ হিসেবে অ্যানিমিয়ার ব্যাখ্যা দেয়া যায়। অ্যানিমিয়ার ব্যাপারে যথাসময়ে বলা হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগটি হবার পর শরীরে অ্যানিমিয়া পেয়ে থাকি আমরা। থ্যালাসেমিয়া যেহেতু একটি বংশানুক্রমিক রোগ, তাই এর আদ্যোপান্ত বুঝতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে মানুষের ক্যারিওটাইপ আর জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্পর্কে। পাশাপাশি গ্রেগর জোহান মেন্ডেল কর্তৃক প্রদত্ত বংশগতির সূত্র সম্পর্কেও সমূহ ধারণা থাকতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত একজন মানুষের শরীরকে তার জিনোম বাধ্য করে অল্প পরিমাণে লোহিত কণিকা তৈরি করতে। লোহিত কণিকা আমাদের রক্তের একটি উপাদান। এই লোহিত কণিকা রক্তের অন্যান্য সকল উপাদানের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। লোহিত রক্ত কণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন নামক এক বিশেষ প্রোটিন। হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো অক্সিজেন আর কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহণ করা। কারো থ্যালাসেমিয়া হলে হিমোগ্লোবিনের এসব কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়।
অ্যানিমিয়াকে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। অ্যানিমিয়াও একটি রোগ, রক্তে উপস্থিত লোহিত কণিকার সংখ্যা অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয় তবে সেটিকে বলা হবে ‘অ্যানিমিয়া’। অ্যানিমিয়া অনেক কারণেই হতে পারে, কোনো শিশু যদি ইরাইথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস নিয়ে জন্মায় তাহলেও শিশুর দেহে অ্যানিমিয়া পাওয়া যাবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগটি খুবই অসহায়ের একটি রোগ। পূর্বসচেতনতা বৃদ্ধি করে কখনো এ রোগের প্রতিকার করতে পারবেন না। ডাক্তার দেখিয়ে কিংবা ওষুধ সেবন করেও এর কিছু করতে পারবেন না। এটি উত্তরাধিকারসূত্রে পর্যায়ক্রমে উত্তরপুরুষে আবর্তিত হতেই থাকে।
আপনি যদি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে ইতোমধ্যেই সেটি আপনার জ্ঞাত হবার কথা। আর যদি একজন বাহক হয়ে থাকেন, সেটি আপনার জানা নেই। এটি জানবার জন্য সবথেকে সহজ পদ্ধতি হলো আপনার বংশের ইতিহাস বের করা। বংশে কেউ কখনো এতে আক্রান্ত ছিলেন কিনা খুঁজে দেখতে হবে। যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে আপনি দুটি টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারবেন আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন নাকি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত জিন বহন করছেন।
টেস্ট দুটো হলো সিবিসি এবং হিমোগ্লোবিন টেস্ট। সিবিসি টেস্টে রক্তে উপস্থিত হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, রক্ত কণিকাগুলোর নির্দিষ্ট সংখ্যার হিসেব পাওয়া যায়। আর হিমোগ্লোবিন টেস্টে হিমোগ্লোবিন ধরন, এতে উপস্থিত আলফা ও বিটা চেইনের গঠন এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় একজন মানুষের থ্যালাসেমিয়া পজিটিভ নাকি নেগেটিভ।
যদি আপনি থ্যালাসেমিয়ার একজন বাহক হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে বিয়ে করা কিংবা সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে একজন ভালো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন দয়া করে। পরামর্শ নিয়ে সকল সিদ্ধান্ত নেয়াটাই মঙ্গলজনক। এছাড়াও সন্তান মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেও পরীক্ষা করা যায় সন্তানে থ্যালাসেমিয়া রয়েছে কিনা। মায়ের সাথে সন্তান যুক্ত থাকে প্লাসেন্টা বা অমরা দিয়ে। এর ভেতরে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড পাওয়া যায়। এ ফ্লুইড সামান্য সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, গর্ভে থাকা সন্তানে থ্যালাসেমিয়া পজিটিভ কিনা।
বাকি রইলো একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর পরিচর্যা পদ্ধতি। পরিচর্যা বিশেষ কিছু না, যেহেতু এ রোগে শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে বারবার এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরিও হচ্ছে না, সেহেতু এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন বাইরে থেকে হিমোগ্লোবিন দেয়া যায়। বাইরে থেকে শুধুমাত্র হিমোগ্লোবিন তো আর দেয়া যাবে না। দিতে হবে নতুন রক্ত। নিয়মিত রক্ত দেয়া হলে সেটি নিয়েই একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগী বেঁচে থাকতে পারে।
বলা যায়, একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীর প্রধান খাদ্যই হলো রক্ত। অন্যান্য খাবারের তুলনায় এ রক্তই তাদের বেশি প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্ত দিতে হয় একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে। বারবার রক্ত দেবার কারণে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আয়রন জমে যকৃৎ বিকল করে দিতে পারে, তাই আয়রন চিলেশনের মাধ্যমে সে আয়রন নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করতে হয়। এছাড়া জীবনযাত্রাতেও আনতে হয় বিস্তর পরিবর্তন। ওষুধ তো দূরের কথা, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া একটি সামান্য ভিটামিন সাপ্লিমেন্টও খাওয়া বারণ। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার, জিংক আর ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে।
আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের উল্লেখযোগ্য কোনো চিকিৎসা নেই। তাই সচেতনতাই আমাদের প্রধান ভরসা। বিয়ের সময় পাত্র-পাত্রী দু’জনেরই রক্ত পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। বিয়ের সময় রক্ত পরীক্ষার কথা বললে হয়তো কেউ কেউ অপমানিত বোধ করতে পারে যে, রক্ত নেয়া হচ্ছে এইডস আছে কিনা তা দেখতে। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়, রক্ত পরীক্ষাতে থ্যালাসেমিয়া সহ যেকোনো রোগের সম্পর্কে পূর্বধারণা পাওয়া যাবে। থ্যালাসেমিয়া থাকুক কিংবা যা-ই থাকুক, বিয়ের আগে সে ব্যাপারে জেনে নিয়ে উল্লেখযোগ্য সমাধান গ্রহণ করাটাই শ্রেয়।
আর যাদের থ্যালাসেমিয়া নেই এবং অন্য কোনো শারিরীক জটিলতাও নেই, তারা চেষ্টা করতে পারেন থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য কিছুটা আত্মনিয়োগ করতে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বলতে গেলে রক্তটাই প্রধান খাবার, তাই সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রচুর থ্যালাসেমিয়া রোগী প্রতিমাসে কী পরিমাণ রক্ত লাগবে।
এ দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। তাদেরকে দেখবার কেউ নেই। মানুষের এত সামর্থ্যও নেই যে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাবে, কিংবা বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থার এতটা উন্নতি হয়নি যে, এই অসহায় রোগীদের দেখবে। অসহায় এসকল রোগীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে এ দেশের বেশকিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য যে প্রতিষ্ঠানটির নাম নিতে হয় সেটি হলো ‘সন্ধানী’। সন্ধানীর প্রধান কার্যাবলীর মাঝে একটি হলো এই থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নির্দিষ্ট সময় পরপর এক ব্যাগ করে রক্ত বরাদ্দ দেয়া। বিনামূল্যের এ রক্তগুলো আসে কোথা থেকে?
সাধারণ মানুষ যদি রক্তদান করে সন্ধানীকে, এখান থেকেই থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে রক্ত দেয়া হয়। সন্ধানীর সাথে জড়িত সকল কর্মীগণ নিজ দায়িত্বে রক্ত দিয়ে থাকে, যা কোনোভাবেই থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশই রক্ত দিতে ভয় পায়, কিংবা রক্ত দেবার মাঝে নিজের কোনো স্বার্থ খুঁজে পায় না। এছাড়াও এটুকুও হয়তো একজন মানুষের জানা নেই যে, যে রক্তটুকু সে দান করবে, সেই রক্তটুকু প্রতি চার মাস পরপর নষ্ট হয়ে যায়। এ সমস্ত সচেতনতার অভাবেই সাধারণ মানুষ রক্তদান করতে চায় না। যার দরুণ প্রতিমাসে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না।
তাই আপনি যদি চান থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অবদানে কিছু করবেন, সন্ধানীর মাধ্যমে এটুকু অবদান রাখতে পারেন। পুরো বাংলাদেশে সন্ধানীর সর্বমোট ২২টি ইউনিট রয়েছে, আপনি যে শহরে থাকেন খোঁজ নিতে পারেন সেখানে সন্ধানীর অফিসের। চার মাস পর পর আপনি যদি সদলবলে কিংবা একা গিয়ে অন্তত একব্যাগ রক্ত দিয়ে আসেন, এই এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগীর এক মাস চলে যাবে।
আসুন, পরিবার-বন্ধু-আত্মীয়স্বজন সকলের মাঝে থ্যালাসেমিয়া এবং এ রোগে আক্রান্ত মানুষদের উপকার্থে রক্তদানের ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলি, নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের বাড়তি কিছুদিন সুন্দরমতো বাঁচতে সাহায্য করি।
তথ্যসূত্র
১. E. Hall, John (2016). Textbook of Medical Physiology. Issue 13. p. 449-450
২. Prof. MD. Mozammel Haque(2015). ABC of Medical Biochemistry. Issue 3. p. 436, 439
ফিচার ইমেজ- locationbd.com