রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সাধারণ মানুষ সাধারণত কখনোই খুব বেশি কিছু আশা করে না। যদিও বা করে থাকে তবে ফলাফল হিসেবে সর্বদাই হতে হয় হতাশ। তবে এক্ষেত্রে শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি ছিলেন ব্যতিক্রম। স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিচল থাকা সু চি একসময় হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ধৈর্যশীল, সংগ্রামী এবং অনমনীয় এক ব্যক্তিত্ব, ছিলেন মিয়ানমারবাসীর অনুপ্রেরণার অন্যতম এক উৎস।
সেসময় মিয়ানমারের সামরিক একনায়কতন্ত্রের হাত থেকে সু চি’র মুক্তির জন্য এবং একইসাথে মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবাদিক সহ কাজ করেছিলেন অনেকে। মুক্তির গান গাওয়া এই মানুষগুলোই উল্লাস করেছেন ১৯৯১ সালে সু চি’র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাবার খবরে। তারা নেচেছিলেন ২০১০ সালে সু চি’র গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তির আনন্দে, বিজয় উদযাপন করেছিলেন ২০১৫ সালে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে তার বিজয়ে। এই বিজয় অর্জনের পথে তাকে সহ্য করতে হয়েছে নানা লাঞ্ছনা-বঞ্ছনা। কখনো তাকে করা হয়েছিল জনবিচ্ছিন্ন, কখনো করা হয়েছিল শারীরিক আক্রমণ, এমনকি তার পারিবারিক জীবনকেও করে তোলা হয়েছিল দুর্বিষহ। এতকিছুর ভেতরে থেকেও নিজের অবিচল অবস্থান সু চি’কে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য এক উচ্চতায়, যা এখনো ইতিহাসের পাতায় রয়েছে জাজ্বল্যমান অবস্থায়।
রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সু চি
বিগত বছরগুলো জুড়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের সাথে যে ধরণের আচরণ করে আসছে তা যেকোনো মানদণ্ডেই অত্যন্ত অপ্রীতিকর। জাতিসংঘের দেয়া ২০১২ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে পৃথিবীর সবচাইতে নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০১৫ সালে সু চি ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন তো ঘটেইনি, উল্টো দিনকেদিন অবস্থার অবনতি ঘটছে।
গণহত্যা প্রতিরোধ এবং শাস্তি বিষয়ক সম্মেলনে (Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide) পাঁচটি ধারা বর্ণনা করা হয়। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে, সম্পূর্ণ অথবা আংশিক, জাতীয়, জাতিগত, ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ যেকোনো একটি কারণে অত্যাচার করা হলেই তা গণহত্যা হিসেবে গণ্য হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে উপরোক্ত ধারাগুলোর চারটিই ধারাবাহিক বিরতির মাধ্যমে অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং পরিকল্পিতভাবে তাদের ওপর প্রয়োগ করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং সু চি ক্ষমতা গ্রহণের পরও তা বলবৎ রয়েছে।
যদিও এটি জানা কথা যে, মিয়ানমারে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা। তবে সু চি কখনোই তাদের ওপর কোনো প্রকার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেননি। তার কার্যক্ষমতা সীমাবদ্ধ হলেও এই নৃশংসতা বন্ধে যে ধরণের ব্যবহারিক এবং আইনী ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করতে পারতেন, তার কোনো উদ্যোগই তিনি গ্রহণ করেননি। যে বিষয়ে তার সবচেয়ে বেশি কথা বলার ছিল, সে বিষয়েই তিনি হয়ে গেলেন নীরবতার প্রতিমা। রোহিঙ্গা নির্যাতনের তথ্য সমৃদ্ধ সকল প্রমাণাদি অস্বীকার করার পাশাপাশি তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন সকল প্রকার মানবিক সাহায্যের ওপর।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার করা (UN human rights report) একটি রিপোর্টে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের মারাত্মক ভয়ংকর চিত্র স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এতে উঠে এসেছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নারী এবং কিশোরীদের গণধর্ষণের বিবরণী যাদের অনেকেই পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেছে। রোহিঙ্গা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের তাদের পরিবারের সামনেই জিভ টেনে ছিঁড়ে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিক্ষক, গুরুজনদেরকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে যাতে করে এদের সাথে সাথে এদের সংস্কৃতিও একেবারে নিষ্পেষিত হয়ে যায়। হেলিকপ্টার থেকে বৃষ্টির মতো গোলা-বারুদ বর্ষণ করা হয়েছে তাদের ওপর, উপায় না পেয়ে অনেকে ঘরের ভেতর আশ্রয় নিলে জীবন্তই পুড়ে মরতে হয়েছে তাদের। ইচ্ছাকৃতভাবে পোড়ানো হয়েছে তাদের ফসল, মেরে ফেলা হয়েছে গবাদি পশু, উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদেরই ঘর-বাড়ি থেকে। এমনকি তাদের বাড়ির আশেপাশের গাছপালাও এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যেন তারা ফিরে আসলেও নিজের বাড়ি-ঘর আর চিনতে না পারে। এছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ আরও হাজার হাজার রিপোর্টে প্রায় একই ধরণের নৃশংসতার চিত্র দেখতে পাওয়া গেছে, যা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর এই সকল কর্মকাণ্ড রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের মাটি থেকে নির্মূল করারই একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।
তবে তিনি শুধুমাত্র এই নৃশংসতাকে অস্বীকার করেই থেমে থাকেননি, তার সামরিক বাহিনীকে সমালোচনার হাত থেকে বাঁচাতে রীতিমত ঢাল হয়ে কাজ করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসকে ‘রোহিঙ্গা’ টার্মটি ব্যবহার করতে নিষেধ করে তাদের পরিচয় দিতেই তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, যার মাধ্যমে সমগ্র রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই তিনি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। শতবর্ষ ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আরাকানে বাস করলেও তিনি তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এখানেই শেষ নয়, তিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের তদন্তে কাজে বাধা তো দিয়েছেনই, এমনকি সহিংসতায় আহতদের জন্য যে সকল সংস্থা খাদ্য, পানি ও ঔষধ সরবরাহ করতে এসেছে তাদের চেষ্টাকেও তিনি প্রতিহত করেছেন। এ সকল সংস্থার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের সাহায্য করার অভিযোগ তুলে তাদেরকে বিতাড়িত করেছেন।
এ কথা সত্য যে, রোহিঙ্গারা এখন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। গত আগস্টে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির আক্রমণে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্যের মৃত্যুর পরপরই সাম্প্রতিক এই গণহত্যার সূত্রপাত হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে উক্ত বিদ্রোহের সাথে জড়িত সন্দেহে সমগ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপরই হামলা চালানো হয়েছে। যদিও সু চিঁ তার নোবেল বিজয়ী বক্তব্যে বলেছিলেন, “যেখানেই নির্যাতন উপেক্ষিত হয়, সেখানেই সংঘর্ষের বীজ বপিত হয়”, হয়তো সে কারণেই সংঘর্ষের বীজ গোঁড়াসহ উপড়ে ফেলার উন্মাদনায় মত্ত হয়েছেন তিনি।
নোবেল পুরস্কার প্রসঙ্গ
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’র এই ধরণের পৈশাচিক আচরণের কারণে অনেকেই তার শান্তিতে পাওয়া নোবেল পুরস্কারটি বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন। অনলাইনে এক পিটিশনের মাধ্যমে প্রায় তিন লাখ ৬৫ হাজার মানুষ সু চি’র নোবেল পুরস্কার বাতিলের দাবিতে আবেদন করেছিলেন। পিটিশনে আবেদনের কারণ হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’র নীরবতাকেই দায়ী করে পুরস্কার বাতিলের দাবি জানানো হয়। হতাশাজনক হলেও সত্য, অং সান সু চি’র শান্তিতে পাওয়া নোবেল পুরস্কারটি বাতিল করছে না নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির ওলাভ জোলস্তাভ এ ব্যপারে পরিস্কার করে বলেছেন যে, একবার পুরস্কার প্রদান করার পর তা আর ফিরিয়ে নেবার নিয়ম নেই।
তবে নোবেল কমিটি না পারলেও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড শহর সু চি’কে তাদের দেয়া ‘ফ্রিডম অব অক্সফোর্ড’ খেতাব প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গণতন্ত্রের পথে সু চি’র অদম্য মনোভাবের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৭ সালে সু চি’কে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। তবে সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চি’র অবস্থান অসন্তোষজনক হওয়ায় তিনি এই সম্মাননার অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন, যে কারণে তা বাতিল করা হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। এর আগে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউ কলেজ সু চি’র একটি প্রতিকৃতি সরিয়ে নেয়। ১৯৬৭ সালে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৯৩ সালে গৃহবন্দি থাকাকালীন তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয় অক্সফোর্ড। সেখানকারই মূল গেটের পাশে থাকা সু চি’র প্রতিকৃতি সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এসবের পাশাপাশি আরও বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সু চি’কে দেয়া বিভিন্ন সম্মানসূচক ডিগ্রি এবং সদস্যপদ প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে সেসকল সংস্থার কর্তৃপক্ষ।
গণতন্ত্রের পথের একজন সৈনিক একদা মন্তব্য করেছিলেন, “ক্ষমতা নয়, ভয়ই মানুষকে কলুষিত করে। ক্ষমতাসীনের ক্ষমতা হারানোর ভয়ই তাকে কলুষিত করে”। মন্তব্যকারী আর কেউ নয়, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কলুষিত হয়ে যাওয়া অং সান সু চি নিজেই। সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের মধ্যে যিনি মানুষের আশা ভরসাকে সবচাইতে নিষ্ঠুরভাবে নিষ্পেষিত করেছেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন সমগ্র মানবজাতির সাথে। তাই শান্তিতে তার নোবেল পুরস্কার বাতিল করা না গেলেও অশান্তিতে তাকে আরেকটি নোবেল পুরস্কার দেয়া এখন সময়ের দাবি!