১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির মিউনিখে তুষারঝরা এক দুপুর। যুগোস্লোভাকিয়া থেকে ইংল্যান্ডে যাবার পথে প্লেনের জ্বালানি নেবার পর মিউনিখ থেকে ম্যানচেস্টারে যাত্রা শুরু করবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দল। তৃতীয়বারের চেষ্টায় প্লেনটি যখন টেকঅফ করতে যায় তখন রানওয়ে থেকে আছড়ে পড়ে বিমানবন্দরের সামান্য বাইরে একটি ঘরের উপর। ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলের খেলোয়াড়, কোচসহ কয়েকজন সমর্থক ও সাংবাদিক। ঘটনার পরপরই শুরু হয় তদন্ত, কিন্তু সেই তদন্তেও বেশ কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। চলুন জেনে নেয়া যাক মর্মান্তিক এ ঘটনার পেছনের কিছু কথা ও সেই তদন্তের গল্প।
পেছনের গল্প
১৯৫৫ সালে ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোকে নিয়ে শুরু হয় ইউরোপিয়ান কাপ, যার আজকের রূপ চ্যাম্পিয়ানস লীগ। শুরু থেকেই ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলোকে খেলতে বাধা দেয় ‘ইংলিশ ফুটবলের স্বার্থে’। কিন্তু ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে অনেকটা জোর করেই স্যার ম্যাট বাসবির অধীনে ইউরোপিয়ান কাপে প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে অংশগ্রহণ করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সাফল্য আসতেও দেরি করেনি, কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়ার ‘রেড স্টার বেলগ্রেড’ দলকে হারিয়ে জায়গা করে নেয় সেমিফাইনালে।
সেসময় ইউনাইটেডের যে বিমান ছিল, তাতে করে সরাসরি যুগোস্লাভিয়া থেকে ম্যানচেস্টারে যাবার উপায় ছিল না। জনি বেরি পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলায় বেলগ্রেড থেকে বিমানযাত্রা শুরু করে এক ঘন্টা দেরিতে। এরপর জ্বালানি নেবার জন্য পশ্চিম জার্মানির মিউনিখের মিউনিখ-রিয়েম বিমানবন্দরে বিরতি নেন পাইলট জেমস থেইন। কো-পাইলট হিসেবে তার সাথে ছিলেন কেনেথ রেমেন্ট। তারা দু’জনই রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।
দুপুর দুটো উনিশ মিনিটে মিউনিখ থেকে ম্যানচেস্টারে যাবার জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পায় প্লেনটি। বরফাচ্ছন্ন রানওয়েতে যাত্রা শুরু করলেও ক্যাপ্টেন থেইন বাম ইঞ্জিনে কিছু সমস্যা লক্ষ্য করায় টেকঅফ বাতিল করেন। তিন মিনিট পর দ্বিতীয় চেষ্টাতেও যখন সমস্যা দেখা দেয় তখন আবারো বাতিল করেন টেকঅফ। দ্বিতীয়বার বাতিলের পর প্লেনের যাত্রীরা বিমানবন্দরের লাউঞ্জে চলে যান।
দুর্ঘটনা
সেদিনের প্লেনটি ছিল ‘এলিজাবেথিয়ান’ শ্রেণীর এয়ারস্পীড অ্যাম্বাসেডার। এ ধরণের প্লেনের জ্বালানির কারণে একটি সাধারণ সমস্যা ছিল, যে কারণে প্লেনের গতির সমস্যা হতো। যাত্রীরা লাউঞ্জে চলে গেলে ক্যাপ্টেন বিমানবন্দরের প্রকৌশলীর সাথে পরামর্শ করেন। সেসময় ভারি তুষারপাত শুরু হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। একটি সময় এমন মনে হয় সেদিন হয়তো আর যাওয়াই যাবে না।
অন্যদিকে লীগের খেলার কারণে তাড়া ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলের, তাই ক্যাপ্টেন থেইন দেরি করতে রাজি ছিলেন না। পনের মিনিট পরেই ডেকে পাঠান সকল যাত্রীকে। তৃতীয়বারের মতো টেকঅফের জন্য প্রস্তুতি নেন ক্যাপ্টেন। দুপুর তিনটার দিকে তৃতীয়বারের মতো টেকঅফ শুরু করে প্লেনটি। এক পর্যায়ে প্লেনটি অর্জন করে ‘ভি-১’ গতি। ভি-১ গতি হচ্ছে সে গতি যা পার করলে কোনো প্লেন আকাশে না উঠে আর নিরাপদভাবে থামতে পারবে না। ভি-১ এর পরেই হচ্ছে ভি-২ গতি যখন প্লেনটি নিরাপদে আকাশে উঠতে পারবে। কিন্তু ভি-২ গতি অর্জনের আগেই বরফাচ্ছন্ন রানওয়েতে পিছলে যেতে থাকে প্লেনের চাকা। ঘণ্টা প্রতি ১৭০ মাইল গতি হঠাৎ করে নেমে আসে ১০০ মাইলে। পাইলটদের হাতে সময় ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু কিছুই করতে পারেননি তারা। রানওয়ে থেকে ছিটকে প্লেনটি আছড়ে পড়ে বিমানবন্দরের সামনের একটি ঘরে।
দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন ২১ জন, পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরো দুজন। এদের মধ্যে ছিলেন কো-পাইলট রেমেন্ট। মারা যান ৮ জন তরুণ খেলোয়াড়, তিনজন ক্লাব স্টাফসহ সাংবাদিক এবং সমর্থক। ইংল্যান্ড এবং ইউনাইটেডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ববি চার্লটন আহত হন মারাত্মকভাবে। তবে অনেকদিন চিকিৎসার পর ফিরে এসেছিলেন মাঠে, জয় করেছেন ফুটবল। বেঁচে যাওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে জনি বেরি ও জ্যাকি ব্ল্যাঙ্কফ্ল্যাওয়ার আর কখনোই ফেরেননি ফুটবলের মাঠে। মোট ১৯ জন বেঁচে গেলেও তাদের অনেকেই আহত হন মারাত্মকভাবে। শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে অনেকেরই চলে গিয়েছিল অনেকটা সময়। আজকের লেখাটি দুর্ঘটনা নয়, বরং তার তদন্ত নিয়েই। তাই দুর্ঘটনার বিস্তারিত প্রসঙ্গে আর যাওয়া হলো না।
তদন্ত
দুর্ঘটনার পরপরই শুরু হয় তদন্ত, দুর্ঘটনা জার্মানিতে হওয়ায় জার্মান তদন্তকারীরা শুরু করে তদন্ত। মাত্র দেড় দশক আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিক্ততা তখনো ভুলে যায়নি দুই দেশের অনেকেই। শুরু থেকেই জার্মান তদন্তকারীদের মাথায় ছিল খারাপ আবহাওয়ার কারণে প্লেনের পাখায় বরফ জমে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাদের তদন্ত শুরুই হয় এ কথাটি মাথায় রেখে। দুর্ঘটনার রাতে যখন তদন্তকারীরা প্রথম প্লেনটিকে দেখার সুযোগ পান, তারা প্লেনের পাখার প্রায় পুরোটাতেই আট সেন্টিমিটার পুরু বরফের স্তর দেখতে পান!
জার্মান তদন্তকারীদের কাজ সহজ করে দেয় বিমানবন্দরের এক ইউনাইটেড সমর্থকের তোলা ছবি। টেকঅফের আগে তিনি প্লেনটির একটি ছবি তুলেছিলেন। জার্মান তদন্তকারীরা সেই ছবিটি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেন টেকঅফের আগে প্লেনের পাখায় বরফ জমেছিল। প্লেনের পাখায় বরফ যেন না জমে সে জন্য ‘ডি-আইসিং’ নামে একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মাধ্যমে পাইলটরা বরফ গলিয়ে ফেলতে পারেন। প্লেনের পাখায় অতিরিক্ত বরফ জমলে প্লেনের ‘অ্যারোডায়নামিক্স’ হিসেব পাল্টে যায়। এর ফলে প্লেনটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জীবিত পাইলট থেইনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, টেকঅফের আগে তিনি দেখেছিলেন পাখার বরফ গলে পড়ছে আর তা মোটেই আট সেন্টিমিটার পুরু ছিল না। সে কারণে তিনি ডি-আইসিং করেননি। কিন্তু জার্মান তদন্তকারীরা তার এ কথাকে মেনে নেয়নি, বরং তাকেই দোষারোপ করে। থেইনের জন্য আরো একটি ব্যাপার খারাপ হয়, সেদিন প্লেনে তিনি আর তার কো-পাইলট নিজেদের জায়গা অদল-বদল করে বসেছিলেন। সাধারণত বামদিকে পাইলট এবং ডানদিকে কো-পাইলট বসার কথা থাকলেও সেদিন থেইন ও রেমেন্ট বসেছিলেন উল্টোভাবে। পাইলটরা অনেক সময় এরকম করে থাকলেও তদন্তকারীরা সেকথা মানতে ছিল নারাজ।
ফলে তদন্তকারীদের দৃষ্টিতে দোষী হন দুই পাইলট। তাদের মধ্যে রেমেন্ট মারা যাওয়াতে সন্দেহের সব তীর এসে লাগে থেইনের গায়ে। সবদিক থেকে অপমানিত হতে থাকেন তিনি। পাইলটের চাকরি হারান, সামাজিক সম্মানও হারান। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে তিনি ফিরে যান নিজের গ্রামে, শুরু করেন পোল্ট্রি ব্যবসা। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় তার আরেক লড়াই।
থেইনের একাকী লড়াই
দুর্ঘটনার শুরু থেকেই থেইন বলে আসছিলেন যে, দুর্ঘটনার জন্য রানওয়ের তুষার দায়ী। কিন্তু তদন্তকারীরা তার কথাকে আমলেই নেয়নি, কেননা একই রানওয়ের অন্য কোনো প্লেনের সমস্যা হয়নি। থেইন ব্রিটিশ এবং জার্মান সরকারের কাছে বারবার আবেদন করতে থাকেন পুনরায় তদন্ত করার জন্য। কিন্তু কেউই তার কথায় কর্ণপাত করেনি। তবে থেইন একেবারেই বসে থাকেননি। তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজেই শুরু করেন নিজেদের মতো করে তদন্ত। যোগাড় করেন দুর্ঘটনার ছবিসহ নানা তথ্য-উপাত্ত।
১৯৬৫ সালে জার্মানরা থেইনের আবেদনে সাড়া দিয়ে পুনরায় তদন্ত করতে রাজি হয়। কিন্তু তাতে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি হয় থেইনের। আগের বার দুই পাইলটকে দোষী করা হলেও এবার থেইনকেই বেশি দোষী বলা হয়। কারণ তিনি সিনিয়র পাইলট হবার পরেও নিয়মভঙ্গ করে ডানদিকে বসেছিলেন। এ ঘটনার পর থেইন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
তবে পুরো ঘটনা নতুন মোড় নেয় ১৯৬৮ সালে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর লীগের খেলা দেখতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন বলেন, থেইন খুব সম্ভবত অবিচারের শিকার হয়েছেন। তার এ কথা পরের দিন প্রায় সকল পত্রিকার শিরোনাম হয় এ উক্তি। পার্লামেন্ট থেকে পুনরায় তদন্ত শুরুর অনুমতি যোগাড় করে ব্রিটিশরা শুরু করে নিজেদের তদন্ত।
নতুন তদন্তের শুরুতেই ব্রিটিশরা বুঝতে পারে, একটি ঘাপলা আছে জার্মানদের তদন্তে। বিমানবন্দর থেকে তোলা যে ছবি দিয়ে পাখায় বরফ ছিল বলে দাবি করা হয়, সে ছবির নেগেটিভ পরীক্ষা করে ব্রিটিশরা দেখে সেটা মোটেই বরফ ছিল না, বরং আলোর প্রতিফলনের কারণে ছবিতে পাখা সাদা লাগছিল! এরপর বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলে ব্রিটিশরা আবিষ্কার করে, যেসব প্রত্যক্ষদর্শী বলেছিলেন যে তুষারের কারণে প্লেন পিছলে যাচ্ছিল কিংবা শুরুতে পাখায় বরফ দেখেনি তাদের বক্তব্য জার্মান তদন্ত রিপোর্ট থেকে উধাও করে দেয়া হয়েছে!
ব্রিটিশরা বুঝতে পারে নিজেদের বিমানবন্দরের যেন দুর্নাম না হয় সে কারণে ইচ্ছে করে পাইলটদের দোষী করা হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাও থেইনের বক্তব্যকে সমর্থন করে। রয়্যাল এয়ারফোর্স তুষারাচ্ছন্ন রানওয়েতে এলিজাবেথিয়ান প্লেন টেকঅফের চেষ্টা করে। কিন্তু সেদিন মিউনিখের মতোই ৫ সেন্টিমিটার পুরু তুষারে ঢেকে থাকা রানওয়েতে টেকঅফ করা সম্ভব হয়নি। বরং থেইনের কথামতো হঠাৎ করে গতি ১০০ মাইল প্রতি ঘণ্টার কাছাকাছি নেমে আসে।
আরেকটি সমর্থন আসে থেইনের কেমিস্ট স্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি পরীক্ষা করে দেখেন প্লেনের আগুন নেভানোর জন্য যে ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তা সহজেই বরফকে গলিয়ে দেয়। আগুন নেভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা যে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেছিলেন তা ছিল শুধুমাত্র ইঞ্জিনের আশেপাশে। ফলে সেখানে বরফ না থাকলেও বরফ ছিল পাখার অন্যান্য জায়গায়। ১৯৫৮ সালের সে ভয়াবহ দুপুরে তাপমাত্রা ছিল অনেক কম, ভারি তুষারপাতও ছিল। আর তদন্তকারীরাও এসেছিল অনেক পরে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পাখায় তুষার জমেছিল অনেকখানি। দুর্ঘটনা ঘটে রানওয়েতে বরফ জমার কারণে- ব্রিটিশ তদন্ত শেষ হয় রানওয়ের বরফের স্তর বেশি থাকাকে দোষী করেই।
ব্রিটিশ তদন্তকারীরা শেষ পর্যন্তু বুঝতে পারেন থেইন শিকার হয়েছেন অবিচারের, ভুল বিচারের। ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেইনের উপর থাকা মিথ্যা অপবাদ সরিয়ে নেয়। তাকে দেয়া হয় দায়মুক্তি। ব্রিটিশদের নতুন তদন্তের পরেও জার্মানরা তাদের কথাতেই অনড় ছিল। তারা আজ পর্যন্ত থেইনকেই দোষী হিসেবে দেখে। দায়মুক্তি পাবার পরেও থেইন আর কখনোই উড়ার সুযোগ পাননি, ফিরে পাননি আগের সামাজিক সম্মানও। দুর্ঘটনার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আবারো ঘুরে দাঁড়ায়, পরিণত হয় ইংলিশ লীগের সবচেয়ে বেশি কাপ জেতা দল হিসেবে। কিন্তু মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থেইনের সেসব দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে থেইনের মেয়ের ভাষায়,
“মিউনিখের দুর্ঘটনা শুধু ২৩ জন মানুষের জীবনই নেয়নি। সংখ্যাটিকে ২৪ করুন, বস্তুত আমার বাবাও সেদিনের দুর্ঘটনায় মারা যান।”
ফুটনোট:
১. Air Crash Investigation: National Geographic. Season 11 Episode 05