ফুল এমনিতেই সুন্দর। সেই সুন্দরকেই যদি আরও সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায়, তাহলে তা কতটুকু মন হরণ করতে পারে তা চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব না! ফুলকে সাজানোর আর সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখার রাখার জন্য জাপানে বহু আগে এক প্রকার শিল্পচর্চা চালু হয়েছিলো। এই শিল্পের নাম ‘ইকেবানা’। ইকেবানা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘ফুলকে বাঁচিয়ে রাখা’। চলুন জেনে নেয়া যাক ফুল দিয়ে বানানো অসম্ভব সুন্দর এই শিল্পকলা সম্পর্কে কিছু তথ্য।
ইকেবানা কী?
ইকেবানা প্রাচীন জাপানের ফুল সাজানোর একটি শিল্প। এই শিল্পের মাধ্যমে প্রকৃতি (স্বর্গ ও পৃথিবী) এবং মানবতাকে একত্র করা হয়, যার ফলে মানবতাকে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। এই শিল্পটি ‘কাদো’ নামেও পরিচিত, যার অর্থ হলো ফুলের গতি বা দিক। এটি গতানুগতিক ধাঁচের ফুল সাজানোর পদ্ধতি থেকে একেবারেই আলাদা কিছু! নির্দিষ্ট কিছু নিয়মের ছকে বেঁধে সৃজনশীল উপায়ে ফুলের এক অপরূপ পরিবেশনা হলো এই ইকেবানা। এর উপাদানগুলো হলো- ফুল, ডালপালা, ঘাস ও লতাপাতা। আর এর সবকিছুই হয় তাজা বা প্রাকৃতিক উপাদান। এই পুরো শিল্পটির প্রাকৃতিক আকার-আকৃতি, নানান রঙের মিশেল এবং প্রতিটিতে লুক্কায়িত অর্থগুলোই হচ্ছে এর আসল সৌন্দর্য। ইকেবানা তাই হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ফুল সাজানোর চাইতেও বেশি কিছু। ইকেবানার আছে সুদৃঢ় ইতিহাস, ভাবগত অর্থ ও অনন্য সৃজনশীলতা। জাপানে ফুল সাজানোর বিষয়টিকে চিত্রকর্ম বা অন্য যেকোনো শিল্পের মতোই সমানভাবে দেখা হয়।
ইকেবানার ইতিহাস
প্রাচীন সপ্তম শতাব্দীর দিকে এই সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। তখন সেখানকার মানুষেরা বৌদ্ধ মন্দিরে অর্ঘ্য হিসেবে ফুল ব্যবহার করতো। ফুলের সাথে নানান পাতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করতো জাপানের আরেক ধরনের ধর্মীয় মতাবলম্বীরা। তারা হলেন শিন্তো ধর্মে বিশ্বাসী। শিন্তো ধর্ম অনুযায়ী, শুধুমাত্র ফুলই নয়, বরং প্রাকৃতিক সব উপাদানেরই রয়েছে সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। ১৫ শতাব্দীর দিকে ইকেবানা একটি শিল্পে পরিণত হয় যখন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা অন্যদের ফুল সাজানোর এই পদ্ধতিটির বিভিন্ন নিয়ম-কানুন শেখাতে থাকে। তাই ধীরে ধীরে পুরো জাপানে ইকেবানার অনেক স্কুল ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। আর সেই প্রতিটি স্কুলেরই ছিলো ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও একেবারে আলদা ফুল সাজানোর শৈলী। সাজানো সেই ফুলগুলো চারুকলায় স্থান করে নেয় এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলো অভিজাত ব্যক্তিদের বাড়িতে। এটা সেই সময়কার কথা যখন নাগেইরে বিভিন্ন স্বতন্ত্র শিল্প; যেমন- জাপানের চা অনুষ্ঠান (টি সেরেমনি) এবং হাইকু কবিতার সাথে সংযুক্ত ছিলো। বর্তমান সময়ের ইকেবানায় যদিও আরও নতুন নতুন পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন সংযুক্ত হচ্ছে, তবুও ইকেবানার প্রাথমিক মূলমন্ত্র কিন্তু আজও ঠিক একই রয়ে গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি এখনও পর্যন্ত ইকেবানার কাজগুলোতে লক্ষণীয়, সেগুলো হলো ঘরের বাইরে এবং ভিতরের সংযুক্তির আধ্যাত্মিক সাধনা।
ইকেবানার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
অধিকাংশ ইকেবানা অনুশীলনকারীর মতে, ইকেবানার আধ্যাত্মিক বিষয়টি উপলব্ধি করা বেশ জরুরি। একজন ব্যক্তি, যিনি ইকেবানা অনুশীলন করেন, তিনি স্বভাবত নীরব, শান্ত হয়ে যান। এই শিল্পটি ক্ষণিকের সেই সময়টিতে অনুশীলনকারীকে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে সাহায্য করে এবং প্রকৃতির এমন অনেক উপাদানকে প্রশংসা করতে সাহায্য করে যা পূর্বে তার কাছে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিলো না। এছাড়াও ইকেবানা চর্চাকারী হয়ে ওঠেন বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রতি ধৈর্যশীল ও সহনশীল। আর সেটাও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রতিই নয়, বরং মানব চরিত্রের নানান ভিন্নতার প্রতিও! ইকেবানা সবধরনের শিল্প থেকেই তার সৌন্দর্য অনুভব করতে সাহায্য করে, যেমন- ছবি আঁকা, গান ইত্যাদি। এছাড়াও ইকেবানা এর অনুশীলনকারীদের সাহায্য করে নিজের সবচাইতে ভালো দিকটি বের করে আনার ক্ষেত্রে।
ইকেবানার উৎপত্তি: ইকেনোবো
ইকেবানার সবচাইতে প্রথম দিককার কথা বলতে হলে বলতে হয় যে, কোয়োটোর রোক্কাকুডো মন্দিরের একজন পূজারীর কথা। তিনি ফুল সাজানোর বিষয়ে এতোটাই পটু ছিলেন যে, অন্যান্য পূজারীরা তার কাছ থেকে এর নিয়ম-কানুন শেখার জন্য তার খোঁজ করতেন। তিনি একটি হ্রদের পাশে থাকতেন এবং এই হ্রদের পাশে বসবাসের বিষয়টিকে জাপানিজ ভাষায় ইকেনোবো বলা হয়। তাই ইকেনোবো নামটি সেই পূজারীদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, যারা পূজার বেদি সাজানোর বিষয়টিতে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
ইকেবানার শব্দাবলী
ইকি: জাপানের একটি নান্দনিক উপাদান, যার অর্থ ‘সুনির্দিষ্ট বিশিষ্টতা’।
মোরিবানা: ফুল সাজানোর জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি যার অর্থ দাঁড়ায় ‘স্তূপকৃত’। এই পদ্ধতিতে ফুল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানগুলো এক প্রকার নিচু ও অগভীর পাত্রে সাজানো হয়।
নাগেইরে: আরও একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি, যার অর্থ ‘নিহিত করা’। এই পদ্ধতিতে সব প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে একটি লম্বা আকৃতির ফুলদানিতে সাজানো হয়।
রিক্কা: ফুল সাজানোর ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিটির নামের অর্থ ‘দাঁড় করানো ফুল’। এই পদ্ধতিতে প্রকৃতির একটি চিত্র তুলে ধরার জন্য ৭ রকমের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়।
শোকা: এটি হলো ফুল সাজানোর এমন একটি পদ্ধতি যা আধ্যাত্মিক জীবনের মূর্ত প্রতীক।
শীন: একটি কাণ্ডকে ব্যবহার করা হয় স্বর্গের প্রতীক হিসেবে এবং এই কাণ্ডটি শোকা ফুল সাজানোর পদ্ধতিতে বেশ জনপ্রিয়।
সোয়ী: মানুষের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত একটি কাণ্ড এবং এটিও শোকা ফুল সাজানোর পদ্ধতিতে বেশ জনপ্রিয়।
তাই: পৃথিবীকে মূর্ত প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত একটি কাণ্ড। এটিও শোকা ফুল সাজানোর পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান এটি।
ইকেবানার যত উপাদান
- মিনিমালিজম: ইকেবানার মূলে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শে মিনিমালিজম। সজ্জার এই প্রক্রিয়াতে প্রাকৃতিক সব উপাদান যেন ভাস্কর্যের মতো এবং প্রতীটিরই রয়েছে আলাদা আলাদা তাৎপর্য। উদাহরণস্বরূপ- এমন সব পাতা নির্বাচন করতে হবে, যেগুলো একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে বা পুরো বা পুরো শিল্পটিকে পরিপূর্ণ রূপদেয়।
- শেইপ এন্ড লাইন: এই উপাদানগুলোও বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত, যেহেতু সব শেইপ ও লাইনগুলো একেবারেই প্রাকৃতিক অবস্থানে রাখতে হয়। যেমন- খাড়াভাবে সাজানোর পদ্ধতিগুলোতে বেশিরভাগই শক্ত ও সোজা ধরনের ডালপালা ব্যবহার করা হয়। এতে করে একটি গাছের শক্তি ও দৃঢ়তার বিষয়টা ফুটে উঠে। ঢালু ধরনের এক পদ্ধতিতে নরম সব উপাদান, যেমন-ফুল ও ঘাস ব্যবহার করা হয় যেগুলো ঢালু জায়গায় জন্মে। এতে করে গতিবিধি ও কমনীয়তার চেতনা অনভূত হয়।
- স্ট্রাকচার: অধিকাংশ জাপানী ফুলসজ্জা বিষমভূজ ত্রিভুজের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। ত্রিভুজের বিন্দুগুলো সাধারণত পত্র-পল্লব বা ডালপালা দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। শোকা নামের ফুল সাজানোর জনপ্রিয় পদ্ধতিটি এর গঠনের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক জগতকে প্রকাশের মাধ্যমে একে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় যে ডাল বা ফুলটি থাকে তাকে ‘শীন’ বলে যা স্বর্গের মূর্ত প্রতীক। মাঝারি আকারের ডাল বা ফুলকে বলে ‘সো’ যা মূলত মানুষকে এবং সবচেয়ে ছোটগুলোকে বলা হয় ‘তাই’ যা পৃথিবীকে বুঝায়।
- ফর্ম: একটি আদর্শ ইকেবানা তৈরিতে খালি জায়গা ও অসম সংখ্যা এবং গুটিকয়েক ফুল ব্যবহার করে অসমতা এবং অপূর্ণতার উপর জোর দেয়া হয়।
- এসথেটিক্স (নান্দনিকতা): এটি এমন একটি উপায়, যা ‘ইকি’ বা সুনির্দিষ্ট বিশিষ্ট এবং’ রিক্কা’ বা দাঁড় করানো ফুলসজ্জাকে প্রকাশ করে। এই পদ্ধতিতে সাতটি ডালপালা ব্যবহার প্রাকৃতিক বিভিন্ন সৌন্দর্য যেমন- পাহাড়, ঝর্ণা ও উপত্যকার মূর্ত প্রতীক ফুটিয়ে তোলা হয়।
- মানবতা ও নীরবতা: ইকেবানাকে বলা হয়ে থাকে সৃজনকর্তার প্রতিমূর্তি। এর মাধ্যমে সৃজনকারীর মনোভাব এবং প্রকৃতির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ পায়। ইকেবানা তৈরির সময় কথা না বলাই শ্রেয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি ধ্যানের মতো, যা তৈরির সময় মনেপ্রাণে প্রকৃতিকে চোখের সামনে অনুভব করা হয়।
তবে এখন শুধুমাত্র জাপানেই নয়, বরং সারা বিশ্বে চর্চা হয় ইকেবানার! এছাড়াও ইকেবানার বিভিন্ন স্কুল তো আছেই এবং প্রদর্শনীও হয় বিশ্বব্যাপী।