Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণীদের ভূমিকা

মানুষ নিজস্ব প্রয়োজনে অর্থাৎ আরামদায়ক জীবন ব্যবস্থা, খাদ্যের নিশ্চয়তা, প্রাণীদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া ও সঙ্গী হিসেবে আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে উদ্ভিদ ও প্রাণীকে নিজ গৃহে স্থান দিয়েছিল। প্রাণীকে গৃহপালিত করার সূচনা হয়েছিল মেসোপটেমিয়াতে। তখন মূলত মাংস, দুধ, চামড়া এবং ত্বকের জন্য পশুদের পোষ মানানো হত। প্রাণীর চামড়া দিয়ে তারা লজ্জা নিবারণ ও আশ্রয়ের জন্য তাঁবু নির্মাণ করতো।

প্রাণী গৃহপালিত করার সূচনালগ্ন; Source: Christine Serva/study.com

মানুষ প্রথমদিকে ছোট ছোট প্রাণীকে পোষ মানায়। যেমন, শিকারের কাজে সহায়তা পাওয়ার জন্য কুকুরকে পোষ মানিয়েছিল। পরবর্তীতে বড় আকারের প্রাণীর দিকে নজর দিতে থাকে মানুষ। তখন তারা গরু, ঘোড়া ইত্যাদিকে পোষ মানিয়ে চাষাবাদ ও পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা শুরু করে।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজস্ব সুযোগ-সুবিধার জন্য প্রাণীকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছে। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও বাদ রাখেনি প্রাণীদের ব্যবহার। আর প্রাণীরাও দক্ষতার সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে প্রশংসনীয় অবদান রেখে চলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও প্রাণীদের ব্যবহার ছিল অবাক করার মতো। আজকের লেখায় আমরা জানবো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত প্রাণীগুলোর অবদান নিয়ে।

ঘোড়া ও গাধা

বিশ্বে যত বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশ যুদ্ধে ঘোড়ার ব্যবহার হয়েছে। ঘোড়া ছাড়াও অনেক যুদ্ধে গাধাও ব্যবহৃত হয়েছে। গাধাকে কামান, গোলাবারুদ, যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন অস্ত্রপাতি, রসদ ইত্যাদি পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব কাজের পাশাপাশি ঘোড়াকে কিছুটা বেশি কাজ করতে হত। ঘোড়া সৈন্য পরিবহনের কাজ করত। তাছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতো অশ্বারোহী বাহিনী।

অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যেতে সক্ষম একমাত্র ঘোড়া স্যান্ডি; Source: globetrotting.com.au

প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও ঘোড়ার ব্যবহার হয়েছিল। এই যুদ্ধে ১ লাখ ৩৬ হাজারেরও অধিক অস্ট্রেলীয় ঘোড়াকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এই ঘোড়াগুলোর অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। তথাপিও যুদ্ধ শেষে মানুষের জন্য শান্তি ঘোষিত হলেও ঘোড়াদের জীবনে নেমে এসেছিল করুণ পরিণতি। ঘোড়াগুলোকে পুনরায় নিজস্ব স্থানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য জাহাজ সংকট, পরিবহন খরচ ও কোয়ারেন্টাইন এর কথা বিবেচনায় রেখে ১৩ হাজার ঘোড়াকে দেশে ফিরিয়ে নেয়া হয়নি।

এভাবেই মরে পড়ে থাকে অনেক ঘোড়া; Source: rarehistoricalphotos.com

কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে কোনো পশুপাখিকে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে নেয়া হলে কমপক্ষে পনের দিন আলাদা করে রেখে প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা। এর ফলে রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা কমে যায়। সে সময় ৩ হাজার ঘোড়াকে ধ্বংসও করা হয়েছিল। তাছাড়াও ১১ হাজার ঘোড়াকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল, যেগুলোকে তারা পুনরায় প্রাণী চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা ও সজ্জিত করে ভারতে ব্যবহার করত। শুধুমাত্র মেজর জেনারেল স্যার উইলিয়াম থ্রোসবাই ব্রীজের ঘোড়া স্যান্ডি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গিয়েছিল। পরে স্যান্ডিকে যথাযোগ্য মর্যাদাও দেয়া হয়েছিল।

নাকের চামড়া কেটে গেলে সেলাই দিচ্ছেন প্রাণীচিকিৎসক; Source: forces-war-records.co.uk

অপরদিকে ১৯১৭ সালের দিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ৫ লক্ষ ৩০ হাজার ঘোড়া ও ২ লক্ষ ৩০ হাজার খচ্চর যুদ্ধের জন্য নিয়োগ করেছিল। এই প্রাণীগুলোর অধিকাংশই যুদ্ধক্ষেত্রে গোলার আঘাত, রোগ ও জাহাজডুবিতে মারা যায়। অনেক প্রাণী দুর্বল ও খোঁড়া হয়। খাদ্যাভাবে তারা মালবাহী গাড়ির চাকা খাওয়ার চেষ্টা করতো। সৈন্যরা প্রাণীগুলোকে দানাদার খাদ্যের অভাবে কাঠের গুঁড়া ভিজিয়ে দলা পাকিয়ে খাওয়াতো।

কবুতর

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সে কারণে মানুষ যুগযুগ ধরে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতো। আজ থেকে ৩ হাজার বছর পূর্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত আধুনিক ছিল না। সে সময় তথ্য আদান-প্রদানের জন্য মানুষ প্রথম কবুতরের ব্যবহার শুরু করেছিল।

খাঁচায় আবদ্ধ কবুতর ছাড়া হচ্ছে; Source: utexas.edu

তথ্য আদান-প্রদানের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও কবুতর ব্যবহার করা হয়েছিল। অনেক উঁচুতে উড়তে সক্ষম ও দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নিজের আস্তানায় ফেরার ক্ষমতা থাকায় কবুতর দিয়ে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করা হতো। এজন্য কবুতরের বাসা সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে তৈরি করা হতো। অতঃপর সেনাদের সাথে অথবা কোনো যানবাহনে করে কবুতরকে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হত। তারপর প্রয়োজনীয় তথ্য সম্বলিত চিঠি পায়ে বেঁধে দিলেই ফিরে আসত সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে।

যুদ্ধক্ষেত্রে পা হারানো বার্তাবাহক; Source: alpinepublications.net

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১ লক্ষ কবুতর ব্যবহার করা হয়েছিল। এই কবুতর শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে সঠিক স্থানে পত্র নিয়ে যেতে পারতো। তবে তাদের জীবনও সহজ ছিল না। শত্রুপক্ষের আঘাত তাদেরকেও সহ্য করতে হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সংগৃহিত দুটি কবুতরের একটির নাম ছিল চের আমি (Cher Ami)। কবুতরটি ১২টি বার্তা প্রেরণ করেছিল। ১৯১৮ সালের ৪ অক্টোবর, কবুতরটি বুক ও পায়ে গুলির আঘাত নিয়ে সর্বশেষ তথ্য প্রদান করেছিল। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ২০০ জন হারানো সেনার জীবন বেঁচে গিয়েছিল।

যুদ্ধক্ষেত্রে বুক ও পায়ে আঘাত পাওয়ায় ১৯১৯ সালের ১৩ জুন কবুতরটি মারা যায়। ফ্রান্স সরকার কবুতরটিকে Croix de Guerre পুরস্কারে ভূষিত করেছিল।

কুকুর

আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রভুভক্ত প্রাণী হচ্ছে কুকুর। মনিবের নির্দেশ পালনে জীবন দিতেও সদা প্রস্তুত থাকে এই প্রাণীটি।

কুকুরের প্রভুভক্তির দৃষ্টান্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সফল প্রাণী সৈনিক; Source: militarytime.com

পরিখার ভিতর শত্রুপক্ষের উপস্থিতি জানান দেয়ার কাজটি খুবই দক্ষতার সাথে করতো কুকুর। এমনকি এরা পরিখার উপরে বসে থেকে নিকটস্থ শত্রুসেনার উপস্থিতি বুঝতে পেলে ঘেউ ঘেউ না করে মৃদুস্বরে ঘড়ঘড় বা গোঁ গোঁ শব্দ করে পরিখার ভিতর সতর্ক বার্তা দিত। বিচক্ষণতা, শ্রবণশক্তি ও ঘ্রাণশক্তির প্রখরতার জন্য কুকুরকে পাহারাদারের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছিল। এছাড়াও আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিকের অবস্থান খোঁজা, গোলাবারুদ শনাক্তকরণ, অস্ত্রপাতি পরিবহনের কাজও করা হয়েছিল কুকুরকে দিয়ে।

কুকুরকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণের পূর্বে হ্যাম্পশায়ারে প্রশিক্ষণ দেয়া হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২০ হাজার প্রশিক্ষিত কুকুরকে পাঠানো হয়েছিল। এদের মধ্যে ৭ হাজার ছিল মানুষের বাসা-বাড়িতে পোষা কুকুর। বাকিগুলো প্রশিক্ষণশালা ও পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছিল।

বেবুন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন প্রাণীর মতো কাজ করেছিল জ্যাকি নামক একটি দক্ষিণ আফ্রিকার বেবুন। বেবুনটিকে যখন যুদ্ধের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়, তখন তাকেও সৈনিকের পোষাক, টুপি, সেনাদের ব্যাজ, বেতন বই এবং তার নিজস্ব খাবার দেয়া হয়েছিল।

বেবুন জ্যাকি; Source: merialvetsite.com

জ্যাকি পদমর্যাদার ভিত্তিতে স্যালুট প্রদান করতে পারতো। এছাড়াও শত্রুদের উপস্থিতি বুঝতে পেলে বাকিদের সতর্ক করত। সে সাধারণত সহযোদ্ধাদের কাপড় টেনে, শব্দ করে শত্রুর উপস্থিতি জানান দিত। জ্যাকি মিশর, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সে পদাতিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধের ময়দানে কাজ করেছিল।

স্লাগ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বপ্রথম মাস্টার্ড গ্যাস বা সালফার মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। এই গ্যাসের শিকার ব্যক্তির ত্বক, চোখ ও শ্বাসনালীতে জ্বলুনি শুরু হত। পরে ফোস্কা পড়ত, চুলকানি হত, ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টিশক্তি কমে যেত, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট হতো। এই বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো গ্যাসের সংস্পর্শে যাওয়ার পর ১২ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রকাশ পেত।

স্লাগ; Source: © Dr. Saiful Islam Sohel/Writer

মানব সৈনিকেরা গ্যাসের উপস্থিতি সাথে সাথে বুঝতে না পারলেও ঠিকই বুঝে ফেলত স্লাগ! প্রাণী চিকিৎসক ডাঃ পল বার্টস এই বিষয়টি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। স্লাগ হচ্ছে মলাস্কা পর্বের শামুকজাতীয় প্রাণী। তবে এর শামুকের মতো খোলস নেই। খোলসের পরিবর্তে শক্ত ত্বক রয়েছে।

গ্যাস মুখোশ পরিহিত দুজন জার্মান সৈনিক; Source: rarehistoricalphotos.com

পরিখায় গ্যাস থাকলে শ্বাস নেয়া বন্ধ করে দিত ও শরীরকে সংকুচিত করত স্লাগ। তখন বিপজ্জনক এই গ্যাসটির উপস্থিতি আছে বুঝে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে গ্যাস মুখোশ ব্যবহার করত সৈন্যরা। এভাবেই স্লাগ সৈন্যদল অনেক জীবন বাঁচিয়েছিল।

অন্যান্য প্রাণী

যুদ্ধক্ষেত্রে সকল মানব সৈনিক যেমন সমান ভূমিকা রাখবে না, তেমনি সকল প্রাণীও সমানভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত অন্যান্য প্রাণী তালিকায় শেয়াল, যুক্তরাষ্ট্রের কালো ভালুক, হাতি, উট, বিড়াল ইত্যাদির কথাও জানা যায়। এদের মধ্যে পরিখায় সৈন্যদের রাখা খাবার নষ্টকারী ইঁদুরকে হত্যার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল বিড়াল

ফিচার ইমেজ – worldwarone.it

Related Articles