Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলায় জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্মজীবনে একজন কবির পাশাপাশি একজন জমিদারও ছিলেন। বরেন্দ্রভূমির এক বৃহৎ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে তার জনহিতৈষি কর্মকান্ড দিয়ে তিনি বরণীয় হয়েছিলেন; যদিও জীবনের উপসংহারে আত্মোপলব্ধি থেকে তার মনে হয়েছে তার একটাই পরিচয়, শুধু কবি। কেমন ছিল বাংলায় তার জমিদারীর দিনগুলো? সেইসব দিনের স্বরুপ উপস্থাপনের ক্ষুদ্র একটি প্রয়াস এই লেখা; কবি রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে জানার এক নগন্য প্রচেষ্টা।

কবির পাশাপাশি একজন জমিদারও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ : telegraphindia.com

বলছি একেবারে গোড়ার কথা। ইংরেজ শাসনের শুরুর দিকে যশোরের পিরালি ব্রাহ্মণ পুরুষোত্তম কুশারীর বংশধর জনৈক পঞ্চানন কলকাতায় এসে ঠাকুর পদবী লাভ করেন। এই পিরালি ব্রাহ্মণ সম্পর্কে ‘বাবু বৃত্তান্ত’ গ্রন্থে কলকাতার লোকনাথ ঘোষ লিখেছেন, ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ ছিলেন ভট্টনারায়ণ। ঐ পরিবারের একবিংশ পুরুষ, পুরুষোত্তম, পীর আলি খাঁ নামক একজন আমিনের ভোজসভায় নিষিদ্ধ ভোজ্যের ঘ্রাণ নেওয়ায়, অন্যমতে পীর আলি খাঁর সাথে ভোজ্য গ্রহণ করেছিলেন এমন একজনের কন্যাকে বিয়ে করায় তাঁর পিরালি (পীর আলি) দোষ লাগে। এই সূত্রেই এই বংশ পিরালি ব্রাহ্মণ বংশ নামে পরিচিত হয়।

পঞ্চানন ঠাকুরের পৌত্র নীলমণি ঠাকুর ইংরেজদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদের মালিক হন। এই নীলমণি ঠাকুরই পরবর্তীতে পৈতৃক নিবাস পাথুরিঘাটা ছেড়ে জোড়াসাঁকোয় গিয়ে বৈষ্ণবচরণ শেঠের জমি ক্রয় করে ঠাকুর বাড়ির পত্তন করেন। নীলমণি ঠাকুরের পৌত্র ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর- যার ব্যবসা-বুদ্ধি, অর্থবল ও ব্যক্তিত্ব ঠাকুর পরিবারকে তৎকালীন কলকাতার অন্যতম ক্ষমতাশীল ও অভিজাত একটি পরিবারে উন্নীত করেছিলেন।

পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং ওড়িশায় বিশাল জমিদারী ক্রয় করেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। পূর্ববঙ্গে এই জমিদারীর আওতায় ছিল নদিয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (সদর শিলাইদহ), পাবনা জেলার শাহজাদপুর পরগণা (সদর শাহজাদপুর; বর্তমান সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত) এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনা (সদর পতিসর; বর্তমান নওগাঁর অন্তর্গত)। এছাড়া সামান্য কিছুদিনের জন্য পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরের স্বরুপপুর এবং যশোরের মোহাম্মদশাহীতে ছোট ধরণের জমিদারী ছিল। দ্বারকানাথের পর জমিদারীর দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ধার্মিক ও তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ; বিষয় আশয়ের প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি ঠাকুর জমিদারীর প্রসার ঘটাতে না পারলেও ভূ-সম্পত্তির পরিচালন ব্যবস্থা সুসংহত করেছিলেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবি ঠাকুরের কাছারিবাড়ি : natunkichu.com

দেবেন্দ্রনাথ একান্নবর্তী পরিবারের ভাগ-বাটোয়ারা নিজেই সম্পন্ন করে দেন। প্রথমদিকে বিরাহিমপুর ও কালীগ্রাম পড়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের ভাগে। পরবর্তীকালে জমিদারী পুনঃবিভাজিত হয়ে বিরাহিমপুর যায় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুরেন্দ্রনাথের অংশে, রবীন্দ্রনাথের থাকে শুধু কালীগ্রাম পরগণা। জমিদারী তদারকির কাজে রবীন্দ্রনাথকে বহুবার আসতে হয়েছে বাংলার বুকে। জমিদারীর পারিবারিক দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বাংলার অপার স্নিগ্ধতাকে প্রেরণা করে তিনি সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব কথামালা। বাংলার এই খন্ডকালীন জীবনে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ও কবি রবীন্দ্রনাথ এক ভিন্ন অথচ নিবিড় পরিচয়ে ধরা পড়েছেন। প্রজাদের মঙ্গলিক কর্মকান্ডে যেমন পদক্ষেপ রেখেছেন, তেমনি বিভিন্ন রচনায় সেই মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি ধারণ করেছেন।

পতিসরে রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ি : news41.com

জমিদারী দেখাশোনার জন্যে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পতিসর আসেন ১৮৯১ সালে এবং শেষবার ১৯৩৭ সালে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি কেবল কালীগ্রাম পরগণারই জমিদার ছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল এই বাংলার বিভিন্ন এলাকার সাথে। এখানকার খাল-বিল, নদ-নদী, শষ্যক্ষেত, শরৎ, হেমন্ত, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এমনকি পদ্মার উত্তাল বুকের উপর শৈল্পিক বক্ররেখায় উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক আর সর্বোপরি মানুষ, সবই জায়গা করে নিয়েছিল তার লেখায়। ‘চৈতালি’র ভূমিকায় তিনি তার আন্তরিক অভিব্যক্তি নিজ ভঙ্গিতেই লিখে গেছেন-

“পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। অলসতার পরিসর, মন্থর তার স্রোত। তার এক তীরে দরিদ্র লোকালয়, গোয়ালঘর, ধানের মরাই, বিচালির স্তুপ, অন্য তীরে বিস্তীর্ণ ফসল-কাটা শস্যক্ষেত ধূ ধূ করছে। কোনো এক গ্রীষ্মকালে আমি এখানে বোট বেঁধে কাটিয়েছি। দুঃসহ গরম। মন দিয়ে বই পড়বার মতো অবস্থা নয়, বোটের জানলা বন্ধ করে খড়খড়ি খুলে সেই ফাঁকে দেখছি বাইরের দিকে চেয়ে। মনটা আমার ক্যামেরার চোখ দিয়ে ছোট ছোট ছবির ছায়াছাপ দিচ্ছে অন্তরে। অল্প পরিধির মধ্যে দেখছি বলেই তা স্পষ্ট দেখছি।”

বোঝাই যায় কতটা ছাপ ফেলেছিল এই বাংলার প্রকৃতি তার মনে। রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় বড়, অনেক গভীরতর বিষয় নিয়ে কাব্যচর্চা করেছেন। কিন্তু কবি হিসেবে এই অঞ্চলে তিনি যেন একটু ভিন্ন মেজাজের। তার অসংখ্য লেখায় এই ভিন্ন মেজাজের ছাপ রয়ে গেছে। বিশেষ করে পতিসরে তার লেখা চিঠিপত্রসমূহ অমূল্য ও প্রাণবন্ত দলিল হিসেবে বিবেচিত। পত্নী মৃণালিনী দেবীকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিদিনের ক্ষুদ্র-বৃহৎ, তাৎপর্যবাহী-নগন্য সকল ঘটনা, সকল অনুভূতিই লিখতেন তিনি। নাগর নদবিধৌত পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ সম্পৃক্ত করেছিলেন এবং প্রকৃতির সুবিশাল ক্যানভাসে এক মহৎ জীবনশিল্পীর ভূমিকায় নিজের প্রকৃত পরিচয় বিধৃত করেছিলেন। সে গভীর পরিচয় তার এই পত্রের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যে উদ্ভাসিত হয়েছে-

“নাগর নদী জল কমিয়া গেলে কেবল শ্যাওলা। গরমে একটু খড়খড়ি খুলিয়া বাইরে দেখিতাম- নানা বর্ণের জলফুল, পতঙ্গদের খেলা ও ফুলের উপর অতিসূক্ষ্ম পাখা স্থির করিয়া থাকা, নানা ভঙ্গিতে উড়া হংস প্রভৃতির খেলা দেখিতাম। তখন এক একটি sonnet নিত্য লিখিতাম। তখন পতঙ্গেরই মতো প্রকৃতির অতি কাছে ছিলাম।”

পদ্মায় রবি ঠাকুরের বোট : en.wikipedia.org

বাংলায় জমিদারীর দিনগুলোতে বেশিরভাগ সময় বোটেই থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতির যতটা কাছে থাকা যায় আর কি। বোটে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অসীম আকাশ দেখতেন আর অপার ভাবনার গহীনে ডুব দিয়ে তুলে আনতেন মণি-মুক্তারুপ এক একটা কালজয়ী লেখনী। শিলাইদহের কুঠিবাড়িটি রবীন্দ্রনাথের অনেক প্রিয় এক জায়গা ছিল। গঠন দেখলেই বুঝা যায় যে চিন্তা ও লেখনীর অপরুপ সন্নিবেশ হবার উপযুক্ত করেই এই কুঠিবাড়িটি তৈরি করা। দোতলার ঝুল বারান্দা, চারপাশ লম্বা লম্বা জানলায় ঘেরা একেকটা ঘর, আম, কাঁঠাল, নারিকেল গাছের ছায়ায় ঘেরা, ঘুঘু ডাকা, স্নিগ্ধ শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ, যেখানে হাওয়ার সূক্ষ্ণতম অনুরণনও গভীরভাবে অনুভব করা যায়, এমন একটা পরিবেশের দরকার ছিল একজন রবীন্দ্রনাথের।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি : thedailystar.net

কুঠিবাড়ির পরিবেশ ছায়াসুনিবিড়, শান্ত ও সাহিত্যবান্ধব : youtube.com

নোবেলজয়ী ‘গীতাঞ্জলি’র অনেক অংশই এই কুঠিবাড়িতে থাকার সময়ে লেখা। শিলাইদহে থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যাহিক রুটিনের দিকে চোখ দিলে দেখা যায়, দিনের বিশাল অংশ তিনি লিখেই ব্যয় করতেন। বিরতি বলতে শুধু খাবার সময়গুলোই। যে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে একসময় ‘রাইটার্স ব্লক’-এর কবলে পড়ে নতুন কিছু লেখার না পেয়ে বসে বসে ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথই শিলাইদহে এত বেশি লিখতে পেরেছিলেন কোন মন্ত্রমুগ্ধতার বলে? এখানেই বাংলার প্রকৃতির তাৎপর্য। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ঘুরে এমনকি স্বদেশ ভারতবর্ষের কোথাও এমন উদাস করা পৃথিবীর সন্ধান পাননি, যা পেয়েছিলেন এই বাংলার বরেন্দ্রভূমিতে।

কুঠিবাড়ির এই খোলা জানালাতেই হয়তো কবি পেয়েছিলেন সেই খোলা হাওয়া : tripadvisor.co.uk

প্রকৃতিকে ভালোবাসতে গিয়েই রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসেছেন প্রকৃতির সন্তান মানুষকে। শুধু সাহিত্যচর্চায়ই রত থাকেননি কবি, জমিদার হিসেবে তার দায়িত্বও পালন করেছেন। প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্যে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা দানকল্পে বিভিন্ন জনহিতৈষি কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। প্রথমে এ ধরণের উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেন বিরাহিমপুর পরগণায়, কিন্তু অনৈক্য ও অসহযোগিতার কারণে সেখানে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই পতিসরে সমাজকল্যাণ মূলক কাজ শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ।

দক্ষ সমাজকর্মী কালীমোহন ঘোষ, আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক পুত্র এবং খুলনার সেনহাটির স্বদেশকর্মী ও বিপ্লবী অতুল সেনকে নিয়ে গ্রামোন্নয়ন শুরু করেন তিনি। প্রজাদের পানিকষ্ট দূর করার নিমিত্তে কূপ ও পুকুর খনন, যাতায়াতের রাস্তা তৈরি, ঝোঁপ-ঝাড় পরিষ্কার করে আবাদি জমিতে রুপান্তর সব চললো পুরোদমে। পরগণার ঋণগ্রস্ত প্রজাদের রক্ষার জন্যে কৃষিঋণ প্রদানের উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ। শতকরা তিন টাকা হারে সুদ ধরে স্টেট থেকে ঋণ দেওয়া শুরু হয়। এই ঋণ পদ্ধতিতে জমির ফসল উঠতো স্টেটের কাছারিতে। সুদসহ ঋণলব্ধ টাকার সমপরিমাণ ফসল এস্টেট রেখে দিতো, বাকিটা চাষীরা নিয়ে যেতো তাদের ঘরে। এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় চাষীরা মহাজনের চক্রবৃদ্ধি হারে সর্বনাশা সুদের কবল থেকে রক্ষা পেতে থাকলো। এলাকার কাবুলিপন্থী মহাজনরা এ সময় তাদের ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়।

প্রজাদের মাঝে এক অনন্যসাধারণ জমিদার : parabaas.com

অতুল সেনের উপর সালিশের দ্বারা প্রজাদের কলহের নিষ্পত্তির দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রজাদের মধ্যকার যেকোনো ধরণের বিবাদ কাছারিতে বসে মেটাতেন অতুল সেন। তার সালিশে  প্রজারা ন্যায়বিচার তো পেতোই, পাশাপাশি মামলার অর্থ অপচয় থেকেও তারা রেহাই পেতো। শান্তিনিকেতনে রক্ষিত ১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দের কাগজপত্র ও মুহাফেজখানা সূত্রে জানা যায়, এই সালিশ প্রথা যতদিন ছিল ততদিন তো বটেই, এমনকি তার পরেও বেশ কয়েক বছর এই পরগণা থেকে একটি মামলাও বিচারের জন্যে সদরে যায়নি। এসব কাজে রবীন্দ্রনাথ উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে চিঠি পাঠাতেন অতুলকে। ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২১ ফাল্গুন তিনি লিখেন-

“সমস্ত হৃদয়মন উৎসর্গ করিয়া লোকের হৃদয় অধিকার করিয়া লও। তাহা হইলেই সমস্ত বাধা কাটিয়া যাইবে।” (শনিবারের চিঠি, ১৩৪৮, আশ্বিন)।

রবীন্দ্রনাথ যখন অতুল সেনকে কাজে লাগিয়ে স্বস্তি পেতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তি। ব্রিটিশ রাজরোষে পড়ে বিপ্লবী অতুলকে তার সঙ্গী-সাথীসহ ফেরার হতে হলো। নির্ভরশীল ও দক্ষ কর্মীর অভাবে রবি ঠাকুরের পল্লী উন্নয়ন স্বপ্নও ভেঙে পড়লো।

রবীন্দ্রনাথ সর্বশেষ পতিসরে আসেন ১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই। কলকাতা থেকে ট্রেনে রওনা হয়ে তিনি আত্রাই স্টেশনে এসে পৌঁছান রাত ১০টায়। সেখান থেকে বোটে চেপে রাত ১১ টায় পতিসরে পৌঁছান ও পরদিন বুধবার ঠাকুর স্টেটের পুন্যাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রজারা দীর্ঘদিন পর রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কোনো প্রাপ্তিযোগ নয়, কবিকে কাছে পেয়েই তারা আনন্দিত। পরদিন সকালে একটি ছেলে আসে হাতে কিছু কাগজ নিয়ে আর কবিকে কিছু লিখে দিতে অনুরোধ করে। কবিগুরু লিখেন-

“সীমাশূন্য মহাকাশে দৃপ্ত বেগে চন্দ্রসূর্য্য তারা

যে প্রদীপ্ত শক্তি নিয়ে যুগে যুগে চলে ক্লান্তিহারা,

মানবের ইতিবৃত্তে সেই দীপ্তি লয়ে, নরোত্তম,

তোমরা চলেছ নিত্য মৃত্যুরে করিয়া অতিক্রম।”

বিকেলে দলে দলে প্রজারা আসে তাদের প্রিয় জমিদারকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। অধিকাংশ প্রজাই তার শেষ বিদায়কালে অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। বোটে চড়ে আত্রাই স্টেশনে এসে পৌঁছান তিনি। সেখানে কবির পূর্ব অনুরোধে তার সাথে দেখা করেন তৎকালীন রাজশাহীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অন্নদাশঙ্কর রায়। সেখানে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষারত অবস্থায় প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট তারা সাহিত্যালাপ করেন। আত্রাই থেকে ট্রেনে কলকাতা ফিরে যান রবীন্দ্রনাথ।

হে বন্ধু বিদায়… : wn.com

১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকারের এক অর্ডিন্যান্সবলে কালীগ্রাম পরগণার জমিদারী হাতছাড়া হয়ে গেলে পূর্ববঙ্গের শেষ ঠাকুর জমিদার রথীন্দ্রনাথ ও তার পত্নী প্রতিমা দেবীর আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আর এভাবেই ক্রমে অজ্ঞাত হয়ে পড়তে থাকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পূর্ববঙ্গের সর্বশেষ জমিদারী পরগনা।

তথ্যসূত্র

১) অন্য এক রবীন্দ্রনাথ – প্রফেসর ড. নিশীথ কুমার পাল

২) পতিসরে রবীন্দ্রনাথ- সাইফুদ্দীন চৌধুরী

Related Articles