১
বৈরাম খানের পদচ্যুতি ও মৃত্যু (১৫৬১ সাল), আকবরের উপর হেরেমের প্রভাব, আদম খান ও মাহাম আগার মৃত্যু এবং সবশেষে নিজের পরিবারের অন্যান্য ক্ষমতালোভী সদস্যদের অযাচিত খবরদারির হাত থেকে রক্ষা পেতে আকবরকে তার রাজত্বকালের বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়। যদিও শেষপর্যন্ত সব ধরনের চক্রান্ত তিনি অতিক্রম করতে সক্ষম হন। তবে সমস্যা হলো, মুঘল সিংহাসনের প্রতি অনেকেই তখনো লালায়িত ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আলী কুলি খান মাহরাম, যিনি খান জামান হিসেবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন।
আলি কুলি খান মাহরাম পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বেশ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তীর বিদ্ধ হওয়ার পর অচেতন হিমুকে তিনিই বন্দী করে নিয়ে এসেছিলেন। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে জৈনপুরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো।
যতদিন বৈরাম খান বেঁচে ছিলেন, ততদিন বৈরাম খান আকবরকে নিজের সার্বিক তত্বাবধায়নে একজন যোগ্য শাসক হিসেবে গড়ে তুলছিলেন। কিন্তু, বৈরাম খানের মৃত্যুর পর আকবর কিছু সময়ের জন্য খেই হারিয়ে ফেললেন। এসময় মাহাম আগার নেতৃত্বে অভিজাতদের একটি দল আকবরের উপর প্রভাব বিস্তার করে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করতে লাগলো। কিছুদিনের মাঝেই আকবর বুঝে গেলেন তাকে ঘিড়ে একটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে। আকবর যখন এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, তখনই সাম্রাজ্যের পূর্বে ধীরে ধীরে আরেকটি সমস্যা জট পাকিয়ে উঠছিলো। সমস্যার মূলে ছিলেন জৈনপুরের গভর্নর আলী কুলি খান মাহরাম।
আলী কুলি খান মাহরাম এ সময় মূলত সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের নেতৃস্থানীয়দের সাথে হাত মিলিয়ে পূর্বাঞ্চল স্বাধীন করে আলাদা একটি রাজ্য গঠন করতে চাচ্ছিলেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে কোনো সময়ক্ষেপণ না করে ১৫৬১ সালের জুলাই মাস নাগাদ আকবর রাজধানী ত্যাগ করেন। এদিকে আকবরের অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে আলী কুলি খান মাহরাম ভীত ও অনুতপ্ত হয়ে এলাহাবাদে বিনাযুদ্ধেই আকবরের নিকট আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা চান। পূর্বে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি তার আনুগত্য আর সেবার দিকটি বিবেচনা করে আকবর তাকে ক্ষমা করে দেন।
২
উচ্চাশা সহজে মাটিচাপা দেয়া যায় না। আলি কুলি খানও তার উচ্চাশা মাটি চাপা দিতে পারলেন না। আকবরের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা পাওয়ার মাত্র ৪ বছরের মাথাতেই (১৫৬৫ সালে) আলি কুলি খান মাহরাম আবার বিদ্রোহ করে বসলেন। আকবর আবারও তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন। কিন্তু, চাচা ইব্রাহীম ও ভাই বাহাদুর খানের সহায়তায় আলি কুলি খান মাহরাম এবার মুঘল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেন। মুঘল সৈন্যরা ঔধের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হলেন। বিদ্রোহীদের দমনে আরেকবার স্বয়ং আকবরকে সেনাবাহিনী নিয়ে মাঠে নামতে হলো। ১৫৬৫ সালের মে মাস নাগাদ আকবর যমুনা অতিক্রম করে পূর্বদিকে অগ্রসর হলে বিদ্রোহীরা পিছু হটে পাটনার কাছাকাছি হাজীপুরে নিজেদের ঘাঁটি স্থাপন করে। আকবরও জৈনপুরকে কেন্দ্র করে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করলেন।
কয়েকমাস অচলাবস্থার পর ডিসেম্বর নাগাদ আলি কুলি খান মাহরামের সাথে সমস্যা সমাধানে আকবর মুনিম খানকে প্রেরণ করেন। মুনিম খানের মধ্যস্ততায় একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই আলি কুলি খান চুক্তি ভঙ্গ করেন। আলি কুলি খান বেশ অদ্ভুদ চরিত্রের মানুষ ছিলেন। কারণ, এরপর নিজেই আবার এসে কৃতকর্মের জন্য আকবরের কাছে ক্ষমা চান। আলি কুলি খানের উচ্চাশা চিরদিনের মতো মিটিয়ে দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি সাথে না থাকায় আকবরও মুখ বুজে সব সহ্য করে আরেকবার তাকে ক্ষমা করতে বাধ্য হলেন।
এদিকে সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলও তখন অশান্ত হতে শুরু করছিলো। এরই প্রেক্ষিতে কাবুল থেকে আকবরের কাছে জরুরী একটি বার্তা এলো। বার্তায় জানানো হলো, কাবুলের শাসনকর্তা আকবরের সৎ ভাই মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে উৎখাত করে কাবুল দখল করে নিয়েছেন বাদাখশানের সুলায়মান মির্জা। মির্জা হাকিম তার হাতে থাকা অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন। এখন কাবুল পুনরুদ্ধারে তিনি আকবরের সহায়তা চাচ্ছেন।
একদিকে সাম্রাজ্যের পূর্বসীমান্তে বিদ্রোহীরা তখনও গোটা সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি, আর এদিকে পশ্চিমে মির্জা হাকিম সামরিক সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছেন। এরকম অবস্থায় যেকোনো শাসকের জন্যই সিদ্ধান্ত নেয়াটা বেশ কঠিন, বিশেষত তরুণ একজন শাসকের জন্য, যিনি ধীরে ধীরে তার সাম্রাজ্যের ক্ষমতা মাত্র বুঝে নিচ্ছেন। ব্যাপারটি আকবরও বুঝতেন, তাই তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। কালক্ষেপণ করে ঘটনা কোনদিকে মোড় নেয় তা দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
কিন্তু, আকবরের কালক্ষেপণের এই ব্যাপারটি সহ্য করা মির্জা হাকিমের জন্য বেশ বিরক্তিকর ছিলো। মির্জা হাকিম পাঞ্জাবে বসে বসে অস্থির হয়ে উঠছিলেন। আকবর তার সহায়তায় সামরিক সহায়তা প্রেরণ না করায় এবার তিনি ভেরা লুন্ঠন করে খোদ লাহোরকেই অবরোধ করে বসলেন। বাধ্য হয়ে আকবর একই সাথে দুটি যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের মতো কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হলো। তবে বিদ্রোহীদের উপর নজর রাখার জন্য পূর্বাঞ্চলে নিজের অভিজ্ঞ সেনাপতিদের মোতায়েন করে আকবর দিল্লি আর আগ্রা থেকে নতুন সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
৩
মির্জা মুহাম্মদ হাকিম জানতেন লাহোর অবরোধের সংবাদ শুনে আকবর ছুটে আসবেন। কিন্তু এত দ্রুত যে তিনি এসে পড়বেন, তা তিনি কল্পনাও করেননি। বাধ্য হয়ে তাকে লাহোর অবরোধ তুলে নিয়ে খাইবার গিরিপথ বরাবর অগ্রসর হতে হলো। তবে মির্জা হাকিম এত সহজে নিস্তার পেলেন না। তাকে ধাওয়া দিয়ে সিন্ধু পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। মির্জা হাকিমের হাত থেকে আকবর সহজেই নিস্তার পেয়ে গেলেন, তবে পূর্বদিকে বিদ্রোহীদের সাথে হিসেব মেলানো তখনও বাকী ছিল।
১৫৬৭ সালের মে মাসের দিকে আকবর গঙ্গা নদী পাড়ি দিয়ে কালপির দিকে যাত্রা করেন। আকবরের সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হয় এলাহাবাদ জেলায়। আলি কুলি খান এসময় আকবরের অগ্রযাত্রার ব্যাপারে একেবারেই কিছু জানতেন না। ফলে তিনি সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন। আকবরের ঝটিকা হামলার মুখে পড়ে আলি কুলি খান আক্ষরিক অর্থেই খড়কুটার মতো ভেসে গেলেন।
এলাহাবাদের এ যুদ্ধে আলি কুলি খান মাহরাম যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন। তার ভাই বাহাদুর খান বন্দী হন। বাহাদুর খানকে ক্ষমা করে দিয়ে আকবর আবারও কোনো ভুল করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি সমূলে এই বিদ্রোহকে উপড়ে তুলতে চাইলেন। কাজেই এবার বিদ্রোহীদের ব্যাপারে তাকে আগের মতো নমনীয় পাওয়া গেলো না।
আকবর বাহাদুর খানকে মৃত্যুদন্ড দিলেন। শিরচ্ছেদের মাধ্যমে এ মৃতুদন্ড কার্যকর করা হলো। একই সাথে বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী নেতা ও জেনারেলকে হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হলো। একইসাথে ঘোষণা দেয়া হলো বিদ্রোহীদের মাঝে যারা মুঘলদের অন্তর্গত, তাদের মাথা এনে দিতে পারলে একটি স্বর্ণমুদ্রা আর হিন্দুস্তানী বিদ্রোহীদের একজনের মাথা এনে দিতে পারলে একটি রূপার মুদ্রা পুরষ্কার দেয়া হবে। এই ঘোষণা টনিকের মতো কাজ করলো। জনগণ উল্লসিত হয়ে বিদ্রোহীদের মাথার খোঁজে ঝাপিয়ে পড়লো!
যা-ই হোক, এই বিদ্রোহ দমন করে আকবর আলি কুলি খান মাহরামের জায়গীর খান-ই-খানান মুনিম খানের হস্তগত করে এলাহাবাদ থেকে বেনারসের মধ্য দিয়ে জৈনপুর হয়ে কারাতে গিয়ে পৌছান।
৪
আলি কুলি খান মাহরামের বিদ্রোহ দমনেই যে আকবর এতগুলো বছর নষ্ট করেছেন, তা কিন্তু মোটেও ঠিক না। বরং, আলি কুলি খান আকবরের জন্য ছিলেন ছোটখাট একটি সমস্যা, যা তিনি নমনীয়তা আর প্রশ্রয় দিয়ে এতদূর গড়াতে দিয়েছিলেন। অবশ্য শেষমেষ বিরক্ত হয়ে তিনি সেই সমস্যাকে উপড়ে ফেলতেও দ্বিধা করেননি।
আকবর মূলত এই দীর্ঘ সময়টা ব্যয় করেছেন মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর চেষ্টায়। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করেছে তার ব্যক্তিত্ব আর দূরদর্শিতা।
আকবর মনে করতেন, পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকরা হিন্দুস্তানে বিশাল ভূখন্ড জয় করে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও প্রায়ই তারা বিদ্রোহের সম্মুখীন হতেন, কারণ বিশাল এই জনপদের ভিন্ন ধর্মালম্বীদের দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতের শাসকরা পরিস্থিতির সার্বিক বিচার করতেন না বা করতে চাইতেন না। ফলে যদিও মুসলিম শাসকরা অন্যান্য শাসকদের মতো অত্যাচার নির্যাতন করতেন না, তারপরেও স্থানীয় জনগণের সাথে শাসকদের একটা আত্মিক দূরত্ব সবসময়ই বজায় থাকতো। এর ফলে স্থানীয় জনগনকে প্রভাবিত করে সহজেই শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলা যেত, যা সাম্রাজ্যগুলোর স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো।
আবার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক দিয়ে হিন্দুস্তান কখনোই একক দেশ ছিলো না। আলাউদ্দিন খিলজিই সর্বপ্রথম সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে হিন্দুস্তানের ভূখন্ডগুলোকে দখল করে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছিলেন। কিন্তু, হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মন মানসিকতা পূর্বের মতোই আলাদা থাকতো। ফলে একজন শাসকের পক্ষে হিন্দুস্তানকে পুনরায় এক পতাকার নিচে নিয়ে এসে সবাইকে সন্তুষ্ট করা ছিলো একপ্রকার অসম্ভব একটি কাজ।
তাই আকবর তরুণ মুঘল সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য ভিন্নভাবে পরিস্থিতি বিচার করলেন। তিনি মুঘল পতাকার অধীনে মহান সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির হিন্দুস্তানকে শাসন করতে চাইলেন, তবে হিন্দুস্তানের স্থানীয় জনগনকে সাথে নিয়েই। এক্ষেত্রে তিনি বহুভাষা ও বহু সংস্কৃতির দেশ হিন্দুস্তান শাসনের জন্য রক্ষণশীল আচরণ ছেড়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এগোতে চাইছিলেন।
আকবর মূলত চাইছিলেন মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুদেরও এক কাতারে নিয়ে এসে হিন্দুস্তান শাসন করতে। এক্ষেত্রে তিনি মুসলিম রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও হিন্দু রাজ্যগুলোকে মৈত্রীর সম্পর্কের ভিত্তিতে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসতে ইচ্ছুক ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে অনেকক্ষেত্রে তিনি প্রাচীন হিন্দু রাজ্যগুলোকে সরাসরি দখল না করে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে বেশ স্বাধীনভাবেই চলতে দিয়েছিলেন। অনেকক্ষেত্রে কৌশলগত কারণে তিনি অনেক হিন্দু রাজ্যকে শক্তিশালীও হতে দিয়েছিলেন। আকবরের এই পরিকল্পনার ফলস্বরূপ দেখা গেলো মুসলিম রাজ্যগুলো মুঘল সাম্রাজ্যের সরাসরি অধীনে গিয়ে শাসিত হতে লাগলো। অন্যদিকে হিন্দুরাজ্যগুলোও আংশিক স্বাধীনতা নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনেই রয়ে গেলো। ফলে বড় রকমের কোনো বাঁধা না পেয়েই হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্য স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে গেলো।
নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আকবর চারটি নীতির উপর অটল থেকেছিলেন।
এক, পারস্পরিক বিবাদমান রাজ্যগুলোর মাঝে শান্তি স্থাপন করা। দুই, মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র ন্যয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা। কারণ, ন্যয় বিচার না থাকলে একটি রাষ্ট্র কখনোই স্থায়ী ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে না। তিন, ধর্মীয় সহনশীলতা আর হিন্দুস্তানের বহু সংস্কৃতির মাঝে সমন্বয় করা। চার, মুঘল সাম্রাজ্যের অনুকূলে শক্তিশালী একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা।
তবে একটি ব্যাপারে আকবর সবসময়ই অনড় ছিলেন। তার শান্তির বার্তায় কেউ যদি একমত না হয়, তাহলে প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে তিনি দ্বিতীয়বারও ভাববেন না।
৫
বুদ্ধিমান এবং কৌশলী সম্রাট আকবর হিন্দুস্তানের উপর আধিপত্ত বিস্তারে মুসলিম বাদে যে শক্তিটিকে নিজের পাশে চেয়েছিলেন তা হলো রাজপুত শক্তি।
রাজপুতদের সাথে সেই প্রাচীনকাল থেকেই মুসলিমদের দ্বন্দ্ব চলতে থাকলেও আকবর রাজপুতদের মাঝে একটি সম্ভাবনা দেখেছিলেন। মূল স্রোত থেকে হারিয়ে যাওয়া রাজপুত শক্তিকে আকবর তাই তার তত্বাবধায়নে হিন্দুস্তানের রাজনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। রাজপুতদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আকবরকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিলো তা হলো রাজপুতদের সততা, সামরিক দক্ষতা, আভিজাত্য, বিশ্বাসযোগ্যতা আর তাদের প্রভুভক্তি। তবে আকবর জানতেন, মুসলিম প্রতিপক্ষ একটি শক্তিকে রাজনীতির মূল স্রোতে নিয়ে এসে তিনি মূলত আগুন নিয়ে খেলায় মেতেছেন। তাই রাজপুতদের সাথে যেকোনো দরকষাকষিতে তিনি নিজেকে সবসময়ই শক্তিশালী অবস্থানে রাখতেন।
অন্যদিকে, বেশিরভাগ রাজপুতই আকবরের নীতির সাথে একমত হয়েছিলেন। আকবরের যে দিকটি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো, তা হলো রাজপুতরা মনে করতেন আকবর অন্যান্য মুসলিম শাসকদের তুলনায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তুলনামূলক বেশি উদার। ইলতুৎমিশ থেকে সম্রাট হুমায়ুন পর্যন্ত সব মুসলিম শাসকই রাজপুতদের ব্যাপারে কমবেশি কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। কিন্তু, আকবরের নীতিকে এক্ষেত্রে তারা অন্যরকম মনে করেছিলেন।
রাজপুতদের প্রতি উদার নীতির কারণে এভাবেই আকবর তার গ্রেট মুঘল হিন্দুস্তান গঠনে রাজপুতদের সহশক্তি হিসেবে পাশে পেয়ে গেলেন, যাদের বিশ্বাস করে একসাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়।
৬
রাজনৈতিকভাবে রাজপুতদের উপর প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে আকবর শুরুতে তাদের সাথে মৈত্রীতার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। এমনকি প্রয়োজনে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করতেন। ১৫৬২ সালে আম্বারের রাণা বিহারিমলের কন্যা হীরা কুনওয়ারিকে বিয়ে করে রাজপুতদের প্রতি তিনি তার আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু রাজপুত রাজ্য মুঘলদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মুঘল বশ্যতা স্বীকার করেন।
শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেই যে আকবর রাজপুতদের সম্মানিত করতেন তা না। বরং, যোগ্যতার ভিত্তিতে রাজপুতদের মুঘল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ন পদগুলোতেও বিচরণের সুযোগ দিয়েছিলেন। এমনকি সামরিক ও বেসামরিক সর্বোচ্চ পদগুলোতেও রাজপুতরা নিয়োগ পেতেন।
তবে মৈত্রীতার ব্যাপারে রাজপুতদের সাথে আকবরের সবগুলো পদক্ষেপই যদি ব্যর্থ হতো, শুধুমাত্র তখনই আকবর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেন। অবশ্য এক্ষেত্রেও তিনি নমনীয়তা দেখাতেন। যেমন- যুদ্ধে পরাজয়ের পর পরাজিত রাজপুত রাজা যদি মুঘল সাম্রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করতেন, তাহলে তাকে স্বায়ত্বশাসনসহ রাজত্ব পরিচালনা করতে দেয়া হতো। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া আকবর এসব রাজ্যগুলোতে তেমন হস্তক্ষেপও করতেন না।
এতকিছুর পরও রাজপুতদের পক্ষ থেকে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি থেকেই যেত। এ বিষয়েও আকবর আলাদা একটি কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। আকবর উচ্চ পদাধিকারী রাজপুত নেতাদের রাজপুত রাজ্যগুলো থেকে দূরের প্রদেশগুলোতে নিয়োগ দিতেন, যেন নিজ এলাকায় থেকে তারা বিদ্রোহের চিন্তা করতে না পারে। তাছাড়া, রাজপুতদের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দুর্গ সবসময়ই নিজের দখলে রাখতেন।
অন্যদিকে, রাজপুতদের মতো যোদ্ধা একটি জাতিকে এত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে অলস বসিয়ে রাখলে বিদ্রোহের চিন্তা তাদের মাথায় আসবেই। কাজেই তিনি এই রাজপুত শক্তিকে উজবেক, আফগান ও পারস্যসহ মুঘল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখার কৌশল অবলম্বণ করেছিলেন।
এত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরে যে রাজপুতরা সহজেই মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তা কিন্তু না। বরং চিতোর, রণথম্ভোর আর কালিঞ্জরের মতো শক্তিশালী দুর্গগুলো থেকে হিন্দুস্তানে মুঘল সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হলো। কাজেই আকবর আবারও মুঘল সেনাবাহিনীকে যুদ্ধাবস্থায় নিতে বাধ্য হলেন। সম্রাটের প্রথম লক্ষ্য এবার মেবারের শক্তিশালী চিতোর দুর্গটি জয় করা।
[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]