Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পেগাসাস: গ্রীক মিথোলজির অত্যাশ্চর্য এক প্রাণী

হলিউড সিনেমা ‘ক্ল্যাশ অব দ্য টাইটানস’ কিংবা এর সিক্যুয়েল ‘র‍্যাথ অব দ্য টাইটানস’ দেখার সুবাদে অনেকেরই পেগাসাসের সাথে পরিচয় আছে। তবে সিনেমার খাতিরে কালো কুচকুচে ডানাওয়ালা যে ঘোড়াটি পেগাসাস হিসেবে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেটি আসলে এর মৌলিক রূপ নয়। কারণ পেগাসাস হচ্ছে প্রাচীন গ্রীক পুরাণের একটি পৌরাণিক জীব যা মিথ অনুযায়ী ধবধবে সাদা, অসম সুন্দর ডানাওয়ালা এক ঘোড়া। পাখির মতোই আকাশে উড়ে বেড়াতো সেই ঘোড়াটি।

পেগাসাস; image source: playbuzz.com

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ গ্রীক উপকথাগুলো নিয়ে ভেবেছে, কল্পনা করেছে আর শিহরিত হয়েছে এই ভেবে যে এসব গল্প যদি সত্যি হতো! গ্রীক আর রোমানদের ইতিহাস জুড়ে আছে অজস্র পৌরাণিক কল্পকাহিনী যার পেছনে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগতেই পারে- বাস্তবতাবর্জিত এসব বিষয় নিয়ে কেন মানুষ শত শত বছর ধরে লেখালেখি করেছে? এগুলো মনে রাখারই বা কী দরকার ছিল? উত্তরটা না হয় আপনারাই ভেবে দেখবেন। তবে গ্রীক পুরাণের শত শত কল্পিত দৈত্য-দানব আর অদ্ভুত সব প্রাণীর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি প্রাণী পেগাসাস। পেগাসাসের গল্প বলতে এখন আপনাদের নিয়ে যাবো গ্রীক দেব-দেবীদের জগতে। গল্পের শুরুতে কিছু প্রধান চরিত্রের সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়ে দেয়া প্রয়োজন।

পারসিয়াস

গ্রীক কিংবদন্তি পারসিয়াস; image source: greekgodsandgoddesses.net

প্রাচীন গ্রীসের আরগোসের রাজা অ্যাক্রিসিয়াসের একমাত্র কন্যা ছিল ডেনাই। তবে অ্যাক্রিসিয়াসের মনে পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। তাই সে চলে যায় ওরাকলদের কাছে। গ্রীক মিথ অনুযায়ী ওরাকলরা সৌভাগ্যের প্রতীক। একইসাথে তারা ভবিষ্যৎও দেখতে পেতো। তবে ওরাকল অ্যাক্রিসিয়াসকে সৌভাগ্যের বদলে দুঃসংবাদই দিল। ওরাকল দেখতে পায় ভবিষ্যতে অ্যাক্রিসিয়াসকে তারই মেয়ে ডেনাইয়ের পুত্র হত্যা করবে। এ কথা জানতে পেরে অ্যাক্রিসিয়াস তার কন্যাকে জেলে বন্দী করে রাখে যেন সে কখনো কোনো পুরুষের সাথে মিলিত হতে না পারে। অ্যাক্রিসিয়াসের পরিকল্পনায় বাধ সাধলেন স্বয়ং জিউস। তিনি জেলে বন্দী ডেনাইয়ের সাথে ছদ্মবেশে মিলিত হলেন আর ডেনাইয়ের গর্ভে এলো সেই বিখ্যাত পারসিয়াস, যিনি মেডুসার হত্যাকারী হিসেবেই অধিক পরিচিত। এর অর্থ দাঁড়ালো- পারসিয়াস আধা মানব, আধা ঈশ্বর! অর্থাৎ উপদেবতা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডেমিগড’।

মেডুসা

মেডুসা; image source: BeastsandCreatures

মেডুসা হচ্ছে ক্লাসিক্যাল গ্রীক মিথোলজির সবচেয়ে পুরাতন চরিত্রগুলোর একটি। প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য ও পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী মেডুসা তিন ‘গোরগান’ বোনের একজন। গোরগান শব্দের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘অত্যন্ত কুৎসিত নারী’। নাম থেকেই বুঝতে পারছেন মেডুসা কেমন দেখতে। তবে আরেকটু বর্ণনা শুনলে শিউরে উঠবেন নিশ্চিত! মেডুসার মাথায় কোনো চুল ছিল না, যা ছিল তা হচ্ছে অত্যন্ত বিষধর অনেকগুলো সাপ! তার দেহের নিচের অংশটাও সাপের মতোই। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি হলো মেডুসার চেহারার দিকে কেউ তাকালেই সে পাথরে পরিণত হতো! দুর্বলতা বলতে এতটুকুই যে, বাকি দুই গোরগান ছিল অমর, তবে মেডুসা তা নয়।

বেলারোফোন

পেগাসাসের পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধ করছেন বেলারোফোন; image source: greekmythology

গ্রীক মিথোলজির আরেক বিখ্যাত বীর হচ্ছেন বেলারোফোন, যিনি হত্যা করেছিলেন অসংখ্য দৈত্য-দানবকে। তবে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ‘কাইমেরা’কে হত্যা করা। গ্রীক কবি হোমারের বর্ণনায় কাইমেরা হচ্ছে ছাগলের দেহে সিংহের মাথাওয়ালা অদ্ভুত এক প্রাণী যার মুখ থেকে আগুন বের হতো। হেরাক্লিস বা হারকিউলিসের পূর্ববর্তী সময়ে পারসিয়াস আর বেলারোফোনই ছিলেন শ্রেষ্ঠ বীর।

চলুন পেগাসাসের কাছে ফিরে যাওয়া যাক।

পেগাসাসের জন্ম

জিউসের পুত্র পারসিয়াস রাজার আদেশে মেডুসাকে হত্যার উদ্দেশ্যে মেডুসার গুহার দিকে রওনা দেন। কিন্তু যার মুখ দেখলেই আপনি পাথর হয়ে যাবেন, তাকে মারার উপায় কী? উপায় বের করে দিলেন দেবতা হার্মিস এবং দেবী আতেইন। তারা পারসিয়াসকে একটি জাদুর তরবারি, একটি ব্রোঞ্জের ঢাল যা একই সাথে আয়নার কাজ করতে সক্ষম এবং এক জোড়া ডানাওয়ালা লোহার জুতা উপহার দেন। এগুলো নিয়েই পারসিয়াস উপস্থিত হন মেডুসার গুহায়। যখন মেডুসা ঘুমন্ত, পারসিয়াস তার ঢালকে আয়নার মতো ব্যবহার করে পিছনে ফিরে ফিরে মেডুসার কাছে পৌঁছে গেলেন এবং তরবারির এক কোপে মেডুসার দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে দিলেন। এ সময় মেডুসার গলা থেকে যে রক্ত ঝরেছিল তা থেকেই জন্ম হয় বিখ্যাত ডানাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাসের!

পোসাইডনের ক্রোধ

জলদানব সিটাস; image source: Pinterest

এ সময় ইথিওপিয়ার রাণী ক্যাসিওপিয়া নিজের ও নিজের কন্যা ‘অ্যান্ড্রোমিডা’র সৌন্দর্য নিয়ে এতটাই অহংকার বোধ করেন যে তিনি নিজেদেরকে গ্রীক জলদেবী ‘নেরেইড’-এর চেয়েও অধিক সুন্দরী দাবি করেন। তার এই অহংবোধ ক্রুদ্ধ করে সাগরের দেবতা পোসাইডনকে। তিনি সাগরে ঢেউ সৃষ্টি করেন এবং সাগরের বিশাল আকারের ড্রাগন ‘সিটাস’-কে প্রেরণ করেন তাদেরকে শিক্ষা দিতে। তবে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভুত হন পারসিয়াস। তিনি মেডুসার গুহা থেকে তৎক্ষণাৎ পেগাসাসের পিঠে চড়ে সিটাসের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য ইথিওপিয়ার দিকে রওনা দেন। সাথে করে নিয়ে যান মেডুসার কাটা মাথা। সেখানে পৌছে তিনি ড্রাগনের সামনে মেডুসার মাথা তুলে ধরতেই ড্রাগনটি পাথরে পরিণত হয়। ঘটনাক্রমে পারসিয়াসের সাথে অ্যান্ড্রোমিডার বিয়ে হয়। আর পরে আকাশে সৃষ্টি হয় ‘পেগাসাস কনস্টেলেশন’ বা নক্ষত্রপুঞ্জ যার সাথেই রয়েছে পারসিয়াস আর অ্যান্ড্রোমিডা।

পেগাসাস কনস্টেলেশন; image source:bp.blogspot.com

বেলারোফোনের পেগাসাসকে খুঁজে পাওয়া

পারসিয়াস আর অ্যান্ড্রোমিডার বিয়ের পর পেগাসাসকে হেলিকন পর্বতে নিয়ে যান জ্ঞানের দেবী এথেনা (রোমানরা যাকে বলে মিনেভরা)। এদিকে পেগাসাসকে পাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠা বেলারোফোন এক সন্ন্যাসীর পরামর্শে দেবী এথেনার মন্দিরে চলে যান। তিনি যখন সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন, তখন স্বপ্নে দেখতে পান দেবী এথেনা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার হাতে একটি স্বর্ণের লাগাম বা বল্গা। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন বেলারোফোনের চোখে বিস্ময়। কারণ তার সামনে সত্যিই পড়ে আছে একটি সোনার লাগাম! তিনি তৎক্ষণাৎ লাগামটি হাতে নিয়ে চলে গেলেন পেগাসাসের নিকট এবং সেটি ঘোড়াটির মাথায় পরিয়ে দিলেন। সাথে সাথে পেগাসাস বশীভূত হয়ে গেল এবং বেলারোফোনকে প্রভু হিসেবে মেনে নিল।

সোনার লাগাম পরিহিত পেগাসাস; image source: fineartamerica

কাইমেরার সাথে যুদ্ধ

এদিকে ঘটনাক্রমে সুঠামদেহী সুপুরুষ বেলারোফোনের প্রেমে পড়েন রাজা প্রোটিয়াসের স্ত্রী আনতিয়া। কিন্তু বেলারোফোন রানীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে রানী প্রোটিয়াসের নিকট বেলারোফোনের মৃত্যু দাবি করেন। প্রোটিয়াস জিউসের ভয়ে নিজে বেলারোফোনকে হত্যা না করে লাইসিয়ার রাজার নিকট পাঠিয়ে দেন এবং সাথে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। চিঠিতে বলে দেন বেলারোফোনকে যেন এমনভাবে হত্যা করা হয় যাতে করে বেলারোফোন তার হত্যাকারী কে সেটা জানতে না পারে। লাইসিয়ার রাজা তাই বেলারোফোনকে কাইমেরা (উপরে এর বর্ণনা রয়েছে) নামক জন্তুটি হত্যা করতে আদেশ দেন। উল্লেখ্য, ভয়ংকর প্রাণী কাইমেরাকে তখন অপরাজেয় ভাবা হতো। তাই লাইসিয়ার রাজা ভেবেছিলেন কাইমেরাকে হত্যা করতে গেলে বেলারোফোন নিজেই মারা পড়বে।

পেগাসাসকে নিয়ে বেলারোফোন বেরিয়ে পড়েন কাইমেরারকে হত্যা করতে। শক্তিশালী কাইমেরা বেলারোফোনের নিকট অসহায় হয়ে পড়ে। কেননা কাইমেরার আগুন বা ভয়ানক থাবা কোনোটিই প্যাগাসাসের পিঠে সওয়ার বেলারোফোনকে স্পর্শ করতে পারছিলো না। বেলারোফোনের হাতে ছিল একটি বর্শা যার ফলাটি ছিল বিষাক্ত সীসা নির্মিত। কাইমেরা যখন আগুন নিঃসরণের জন্য মুখ খুললো, তখন সুযোগ বুঝে বেলারোফোন কাইমেরার মুখ বরাবর বর্শাটি নিক্ষেপ করলো। কাইমেরার মুখের আগুনে বর্শার ফলা তৎক্ষণাৎ গলে গেল এবং বিষাক্ত গলিত সীসা কাইমেরার পেটে চলে গেল। মৃত্যু হলো কাইমেরার!

অহংকারের পতন

কাইমেরাকে হত্যার পর বেলারোফোনের সুনাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। চারিদিকে তখন সবাই বেলারোফোনের বীরত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাজা প্রোটিয়াসও নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হন এবং নিজের মেয়েকে বীর বেলারোফোনের সাথে বিয়ে দেন। পরবর্তীতে বেলারোফোন আরো অনেক দৈত্য-দানব বধ করেন। সাফল্যের চূড়ায় উঠে তিনি অহংকারে অন্ধ হয়ে যান। তিনি অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায় ওঠার সংকল্প করেন যেখানে দেবতারা বসবাস করেন। তিনি চেয়েছিলেন অলিম্পাস পর্বতে দেবতাদের সাথে থাকবেন। এখানে এসে পৌরাণিক ইতিহাস দ্বিধাবিভক্ত হয়। অনেকের মতে পেগাসাসকে নিয়ে বেলারোফোন যখন অলিম্পাসের দিকে রওনা দেন, তখন পেগাসাস নিজেই বেলারোফোনকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়। তবে অধিকাংশের মতে জিউস বেলারোফোনের অহংকারে ক্ষিপ্ত হয়ে একটি পতঙ্গ প্রেরণ করেন যা পেগাসাসকে কামড় দেয়। কামড় খেয়ে পেগাসাস এলোমেলোভাবে উড়তে শুরু করে এবং বেলারোফোন স্থানচ্যুত হয়ে নিচে পড়ে যায়। এখানেও মিথ দ্বিধাবিভক্ত। কারো মতে বেলারোফোন পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কারো মতে অন্ধ হয়ে আরও কিছুদিন বেঁচে ছিলেন এই বীর।

পেগাসাসের পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছেন বেলারোফোন; image source: Artnet

এরপর পেগাসাসকে পৃথিবীতে আর কখনো দেখা যায়নি। কারণ বেলারোফোন পিঠ থেকে পড়ে গেলেও সে উড়তে উড়তে অলিম্পাসে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে দেবতাদের সেবায় নিয়োজিত হয়।

ফিচার ইমেজ: moheban-ahlebeit.com

Related Articles