মানুষ তার উৎপত্তির পর থেকেই ভূমিকম্পের আলামত দেখে এসেছে। ভূমিকম্পের শক্তি বিশাল, ধ্বংসলীলাও প্রবল। নিত্যদিনের সঙ্গী ভূমিকম্পকে ব্যাখ্যা করতে উপকথার জন্ম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। সেসব উপকথার কয়েকটি তুলে ধরছি এখানে।
সডোম ও গমোরাহ
সডোম আর গমোরাহ নগর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিয়ে একটি ইহুদী উপকথা প্রচলিত আছে। কোনো এক কারণে ঐ অঞ্চলের মানুষগুলো ভ্রষ্ট ও পাপিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। স্রষ্টা এসব পাপীদের প্রতি খুবই নারাজ হলেন এবং অভিশাপস্বরূপ পুরো নগরকে তিনি ধ্বংস করে দিলেন। পুরো নগরে একজন ভালো মানুষ ছিল। তার নাম হযরত লুত (আ:)। লুত (আ:)-কে সতর্ক করার জন্য স্রষ্টা বার্তাবাহক প্রেরণ করলেন। বার্তাবাহক তার কাছে এসে জানালেন ধ্বংস অনিবার্য, দ্রুতই যেন তিনি সডোম নগরী পরিত্যাগ করে দূরে কোথাও চলে যান।
সতর্কবার্তা পেয়ে লুত (আ:) এবং তার পরিবার পাহাড় বেয়ে চলে যেতে লাগলেন। পরিত্যাগের পরপরই স্রষ্টা ঐ অঞ্চলের পাপিষ্ঠদের উপর ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দিলেন। উপর থেকে আগুনের বৃষ্টিও প্রেরণ করলেন। হযরত লুত (আ:)-এর পরিবারকে আদেশ করা হয়েছিল যখন এলাকা পার হয়ে যাবে তখন কেউ যেন পেছনের দিকে না তাকায়।
সবকিছুই ঠিকঠাক মতোই ছিল, কিন্তু লুত (আ:)-এর স্ত্রী কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে স্রষ্টার আদেশ অমান্য করে পেছনের দিকে তাকান। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন পেছনে কী ঘটছে। কিন্তু অতিরিক্ত কৌতূহল তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পেছনের ধ্বংসলীলা দেখার সময় তার চোখ সহ সমস্ত দেহ পাথরের মতো স্থির মূর্তিতে পরিণত হয়ে যায়। কেউ কেউ বলে থাকে ঐ এলাকায় গেলে তার জমে যাওয়া মূর্তি এখনো দেখতে পাওয়া যায়।
কোনো কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন সডোম ও গমোরাহ নগরের এই ঘটনাটি একেবারেই কল্পিত উপকথা বা পৌরাণিক গল্প নয়। ঐ এলাকাকে ধ্বংস করে দিতে পারে এমন একটি ভূমিকম্প অনেক আগে হয়েছিল এখানে। ধারণা করা হয় ঐ ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে চার হাজার বছর আগে।
জশোহা ও জেরিকো
বাইবেলে আরো একটি উপকথা আছে, যার উৎপত্তিও সম্ভবত ভূমিকম্প থেকেই হয়েছে। এটি জেরিকো শহরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিয়ে। জেরিকো হচ্ছে লোহিত সাগরের উত্তরে অবস্থিত ছোট একটি শহর। পাশাপাশি পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলোর মাঝে এটি একটি।
প্রাচীন হিব্রু গল্পে জশোহা নামে একজন বিখ্যাত বীরের উল্লেখ পাওয়া যায়। জশোহা ঘটনাক্রমে জেরিকো শহরের বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গেলেন এবং তাদেরকে পরাজিত করতে মনঃস্থ হলেন। অন্যদিকে জেরিকো শহরটি ছিল পুরো প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত। আক্রান্ত হবার সময় সকল মানুষ প্রাচীরের ভেতর গিয়ে বসে আছে, কোনো কাজের জন্য কেউ প্রাচীরের বাইরে বের হচ্ছে না। জশোহার সৈন্যবাহিনী কোনোভাবে এই দেয়াল ভাঙতেও পারছে না, পারও হতে পারছে না। এমন অবস্থা দেখে জশোহা তার অনুসারী যাজকদেরকে নির্দেশ দিলেন তারা যেন একযোগে তুরী বাঁশি বাজানো শুরু করে। আর বাকি সব মানুষকে নির্দেশ দিলেন অতি উচ্চ স্বরে যেন চিৎকার করতে থাকে।
বাঁশি ও চিৎকারের সম্মিলিত শব্দ এতই শক্তিশালী ছিল যে, শব্দের প্রকম্পনের চোটে দুর্ভেদ্য প্রাচীর কাঁপতে শুরু করলো এবং একসময় ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশে গেল। জশোহার সৈন্যরা তারপর ভেতরে ঢুকে সকলকে কচুকাটা করে মেরে শহর পরিষ্কার করে ফেললো। এদের মাঝে নারী ও শিশুও ছিল। এমনকি গরু-ছাগল-ভেড়াকেও ছাড় দেয়া হয়নি। সামনে যা পেয়েছে তা-ই হত্যা করেছে।
এখানেই শেষ নয়। শহরকে রক্তের বন্যায় ভাসানোর পরে জশোহা শহরের সবকিছুকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। পুড়ে যাবার হাত থেকে একমাত্র রেহাই পেয়েছে সোনা ও রূপা সহ কিছু ধাতব বস্তু। এভাবে কচুকাটা করে মেরে ফেলাটা কি খুব বেশি অপরাধ বলে মনে হচ্ছে? উপকথায় এই কাহিনীটি বলার ধরণ অনুসারে এটিকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। কারণ এই শহরটি ছিল জশোহার অধীনস্থ মানুষদের সম্পদ। এর মাধ্যমে তারা তাদের ভূমি ফিরে পেয়েছিল।
এই শহরটি আসলে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। অনেকে ধারণা করেন জশোহা ও জেরিকো শহরের উপকথাটি আসলে একটা ভূমিকম্পের ফলাফল। ভূমিকম্পের ফলে শহরের প্রাচীর ভেঙে পড়েছিল। মানুষের চিৎকার ও তুরী-বাঁশির আওয়াজে প্রাচীর ভেঙে পড়েনি। স্বাভাবিকভাবে হিসাব করে দেখলে চিৎকার আর বাঁশির সুরে পুরো প্রাচীর ভেঙে পড়া সম্ভবও নয়। ভূমিকম্পের ফলেই ভাঙন হয়েছে এবং মানুষের মুখে মুখে এটি ঘুরতে ঘুরতে একসময় চমকপ্রদ উপকথায় পরিণত হয়েছে।
জাপানের নামাজু
ভূমিকম্প নিয়ে আরো অনেক অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। ভূমিকম্প মানুষের নিত্য সঙ্গী। প্রায় সমগ্র পৃথিবীতেই ভূমিকম্প হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ একে নিয়ে বিভিন্ন রকম কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। জাপানে সবসময়ই ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়। জাপানে যেহেতু সবসময় ভূমিকম্প লেগেই থাকে, সেহেতু জাপানের মানুষেরা ভূমিকম্প নিয়ে আকর্ষণীয় উপকথা তৈরি করবে না তা কি হয়? জাপানের অনেকগুলো কাহিনীর মাঝে একটি কাহিনী হচ্ছে- ‘নামাজু’ নামের একটি অতি-বিশাল মাগুর মাছ সমগ্র পৃথিবীর ভূখণ্ড তার পিঠে নিয়ে আছে। মাগুর মাছ যখন তার লেজ নাড়ায় তখনই ভূমি প্রকম্পিত হয় এবং ভূমিকম্পের জন্ম হয়।
রো
জাপান থেকে আরো কয়েক হাজার মাইল দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড গেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাহিনী পাওয়া যাবে। ঐ অঞ্চলের মানুষের উপকথা অনুসারে মাতা পৃথিবী দেবতা ‘রো’কে পেটে নিয়ে গর্ভবতী অবস্থায় আছেন। (জন্মভূমি, দেশ, পৃথিবী এগুলোকে মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। মা যেমন সন্তান পেটে ধারণ করে, তেমনই দেশ বা পৃথিবীও তার বুকে মানুষ ধারণ করে। সেজন্য এদেরকে স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সর্বনাম হিসেবে ‘She’ ব্যবহার করা হয়।) মায়ের পেটে বাবুরা যেমন নড়াচড়া করে, পৃথিবীর গর্ভেও দেবতা রো তেমন নড়াচড়া করে। যখনই দেবতা রো নড়ে উঠে, তখনই পৃথিবী কেঁপে উঠে এবং মানুষ একে ভূমিকম্প হিসেবে দেখতে পায়।
তাল ও কুকুর
সেখান থেকে আবার উত্তর দিকে সাইবেরিয়ায় গেলে আরেক ধরনের উপকথার দেখা পাওয়া যাবে। সাইবেরিয়ার কিছু উপজাতি বিশ্বাস করতো পৃথিবী একটি স্লেজ গাড়ির উপর অবস্থিত। স্লেজ গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যায় একটি কুকুর এবং একে চালায় ‘তাল’ নামে একজন দেবতা। বেচারা কুকুরের গায়ে একধরনের ক্ষুদ্র মক্ষিকা বাস করে যাদের কারণে কুকুরের বেশ কষ্ট হয়। মক্ষিকার আক্রমণ যখন আর সহ্য হয় না, তখন এখানে ওখানে আঁচড় কাটতে থাকে। আঁচড় যদি পৃথিবীর গায়ে পড়ে তাহলে পৃথিবীতে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
পশ্চিম আফ্রিকা
পশ্চিম আফ্রিকার একটি উপকথা অনুসারে পৃথিবী হচ্ছে একটি সমতল প্লেট। প্লেটের এক প্রান্ত ভর করে আছে উঁচু একটি পাহাড়কে এবং আরেক প্রান্ত ধরে রেখেছে বিশাল এক দৈত্য। তার পাশাপাশি অবস্থান করছে তার স্ত্রী। স্ত্রী আবার হাত উঁচু করে আকাশকে ধরে রেখেছে, যেন আকাশ নিচে পড়ে না যায়। যখনই তারা জড়াজড়ি করার জন্য পরস্পরের কাছে আসে, তখন পৃথিবী কেঁপে উঠে এবং এতে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
পশ্চিম আফ্রিকার আরেকটি উপজাতি বিশ্বাস করতো, তারা সকলে অনেক বড় একটি দৈত্যের মাথার উপরে বসবাস করছে। পৃথিবীর বন-জঙ্গলগুলো হচ্ছে ঐ দৈত্যের চুল আর মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীরা হচ্ছে তার মাথার উকুন। দৈত্যটি যখন হাঁচি দেয়, তখন ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
আজকের যুগের মানুষেরা ভূমিকম্পকে বৈজ্ঞানিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। মুগ্ধকর উপকথা না এসে সেখানে চলে আসে টেকটোনিক চলন, কন্টিনেন্টাল ড্রিফট, ক্রাস্ট, ম্যান্টল, শক ওয়েভ ইত্যাদি টার্ম। আসলে তখন সে ধরনের উপকথা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। তখন বিজ্ঞান ছিল না, যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে ব্যাখ্যা দেবার সংস্কৃতিও ছিল না। যে জিনিসের ব্যাখ্যা বের করা যাচ্ছে না, সেটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘অমীমাংসিত’ রেখে দেবার প্রবণতাও ছিল না। ঘটনা যা-ই হোক, কোনো না কোনোভাবে মানুষ তার ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেসব ব্যাখ্যার জন্য হয়তো উঠে এসেছে স্বর্গের কিংবা মর্ত্যের কোনো দেব-দেবীর উপাখ্যান। আজকের যুগে আমরা সেগুলোকে পাঠ করে স্বপ্নীল সাহিত্যের স্বাদ পাই।
তথ্যসূত্র: The Magic of Reality: How We Know What’s Really True
ফিচার ছবি: Sa Kuuuul/Twitter