কীভাবে শুরু হয়েছে এবারের সংকট?
ঘটনার শুরু গত ১৪ জুলাই, শুক্রবার সকাল বেলা, যখন তিনজন ইসরায়েলি আরব মুসলমান, জেরুজালেমের আল-আক্বসা মসজিদ প্রাঙ্গনে দুই ইসরায়েলি পুলিশের উপর আক্রমণ করে তাদেরকে হত্যা করে। আক্রমণকারীরা তিনজনই ছিল ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর উম্ম-আল-ফাহ্মের অধিবাসী। তারা মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তরে অবস্থিত লায়ন গেট দিয়ে মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করে এবং দুই পুলিশকে পেছন থেকে গুলি করে। তাদের সাথে ছিল ঘরে তৈরি মেশিনগান, যেগুলো তারা জামার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। ইসরায়েলি পুলিশ তাদের পেছনে ধাওয়া করলে তারা মসজিদ কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে এবং সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।
হত্যাকান্ডের পরপরই ইসরায়েলি পুলিশ মসজিদ সংলগ্ন পুরো এলাকা বন্ধ করে দেয় এবং ১৯৬৯ সালের পর প্রথবারের মতো মসজিদে নামাজ বাতিল করে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পুলিশের পরামর্শে মসজিদ প্রাঙ্গণে মেটাল ডিটেক্টর সম্বলিত ইলেক্ট্রনিক গেট স্থাপন করার নির্দেশ দেন, যেন আর কেউ অস্ত্র নিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে না পারে। মূলত মেটাল ডিটেক্টর সম্বলিত ইলেক্ট্রনিক গেট স্থাপন করার পরপরই মুসল্লীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তারা ইসরায়েলি পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত ইলেক্ট্রনিক গেটের মধ্য দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মসজিদের বাইরে অবস্থান নেয়।
ঘটনার পরপরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে ফোনে কথা বলেন এবং এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানান। তিনি একই সাথে নেতানিয়াহুকে ইলেক্ট্রনিক গেট সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও আহ্বান জানান।
এদিকে মসজিদ কম্পাউন্ডের জর্ডান ভিত্তিক পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ‘ওয়াক্বফ’ মেটাল ডিটেকটর স্থাপনের বিরুদ্ধে মুসল্লীদের প্রতিবাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে মুসল্লীরা মসজিদে প্রবেশ না করে মসজিদের বাইরে খোলা মাঠে নামাজ আদায় করতে থাকেন। পরবর্তী শুক্রবার, ২১শে জুলাইকে ফিলিস্তিনীরা বিক্ষোভ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। শুক্রবার এগিয়ে আসতে থাকলে ইসরায়েলি সরকারের উপর ইলেক্ট্রনিক গেট সরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপও বাড়তে থাকে।
প্রতিবাদের মুখে মেটাল ডিটেক্টর সরিয়ে বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা, এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার রাতে সিনিয়র মন্ত্রী এবং পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বিভাগ ‘শীন বেত’ মেটাল ডিটেকটর সরানোর পক্ষে মত দেয়। কিন্তু পুলিশের পরামর্শে নেতানিয়াহু শেষ পর্যন্ত মেটাল ডিটেক্টর না সরানোর ব্যাপারেই অনড় থাকেন।
শুক্রবারে মসজিদের বাইরে নামাজরত মুসলমানদের সাথে দখলদার ইসরায়েলি পুলিশের তীব্র সংঘর্ষ হয়। শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানরত নিরস্ত্র মুসল্লীদের উপর পুলিশ বর্বর আক্রমণ করে। অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে পুলিশ এবং অবৈধ ইসরায়েলী সেটলারদের আক্রমণে চারজন ফিলিস্তিনী নিহত এবং অন্তত অর্ধশতাধিক আহত হয়। পুলিশ আহতদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য হাসপাতালগুলোতেও অভিযান চালায়। প্রতিবাদে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করার ঘোষণা দেন।
ওদিকে শুক্রবার রাতে এক ফিলিস্তিনী পশ্চিম তীরের হালামিশ সেটলমেন্টে অনুপ্রবেশ করে এবং এক পরিবারের তিন ইসরায়েলি নাগরিককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। পরে প্রতিবেশী এক পুলিশের গুলিতে সে নিহত হয়। অন্যদিকে রবিবারে জর্ডানের ইসরায়েলি দূতাবাসের এক জর্ডানিজ কর্মচারী স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে এক ইসরায়েলি নিরাপত্তারক্ষীকে আক্রমণ করতে গেলে নিরাপত্তারক্ষী তার উপর গুলি চালায় এবং সে সহ আরেকজন নিহত হয়। যদিও পরে জানা যায়, ঘটনাটি ছিল দূতাবাসের আসবাবপত্র হস্তান্তর সংক্রান্ত, কিন্তু প্রাথমিকভাবে এটাকেও আল-আক্বসার সাথে সম্পর্কিত ঘটনা বলে ধারণা করা হয়েছিল।
আল-আক্বসা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?
আল-আক্বসা বা বাইতুল মুক্বাদ্দাস হচ্ছে মুসলমান, ইহুদী এবং খ্রিস্টান- তিনটি ধর্মের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মসজিদ, যেটি ইসরায়েল কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে ৩৫ একর আয়তনের একটি কম্পাউন্ডে অবস্থিত। এই কম্পাউন্ডটি মুসলমানদের কাছে হারাম আল-শরিফ নামে পরিচিত। আল-আক্বসা ছাড়াও এতে ডোম অফ দ্য রক তথা কুব্বাত আস-সাখ্র অবস্থিত।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ যখন ফিলিস্তিনী ভূমিতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে, তখন তিনটি ধর্মের কাছেই আল-আক্বসার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে জেরুজালেম শহরটিকে কোনো রাষ্ট্রের অধীনে না দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাব করে। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল সকল আন্তর্জাতিক সমঝোতা ভঙ্গ করে আল-আক্বসা সহ জেরুজালেমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু বিশ্বে একমাত্র ইসরায়েল ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র জেরুজালেমের উপর তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেয় না।
জেরুজালেম ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৬৭ সালের পর ইসরায়েল জর্ডানের সাথে ঐক্যমতে (স্ট্যাটাস ক্যু) পৌঁছায় যে, হারাম শরিফ কম্পাউন্ডের ভেতরের ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করবে জর্ডান ভিত্তিক ইসলামিক ট্রাস্ট তথা ওয়াক্বফ কমিটি। তবে এর বাইরের পুরো শহরের এবং কম্পাউন্ডের আশেপাশের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে ইসরায়েল। মসজিদে শুধু মুসলমানরাই নামাজ পড়তে পারবে। ইহুদী বা খ্রিস্টানরা ভিজিটিং আওয়ারে এটি পরিদর্শন করতে পারবে, কিন্তু মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করতে বা সেখানে প্রার্থনা করতে পারবে না।
কিন্তু ইসরায়েলের উগ্র ইহুদীবাদী গোষ্ঠী সব সময়ই এর বিরোধিতা করে এসেছে। তারা আল-আক্বসা মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে ইহুদী উপাসনালয় নির্মাণের দাবিতে সোচ্চার। এরকম কিছু গোষ্ঠীকে ইসরায়েলি সরকারের অনেক সদস্য আর্থিকভাবে সহযোগিতাও করে আসছে। এবং সরকারের সহযোগিতা ও পুলিশের পাহারায় এরকম গ্রুপগুলো মাঝেমাঝেই আল-আক্বসা প্রাঙ্গণে গিয়ে তাদের দাবির পক্ষে প্রচারণা চালায় এবং মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে দখলদার ইসরায়েলি পুলিশ নিয়মিতভাবে জেরুজালেমের বিভিন্ন স্থানে কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে আল-আক্বসা মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করে।
শুধু যে রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনীরা জেরুজালেমের এবং আল-আক্বসা মসজিদের দাবিদার, তা-ই না। আল-আক্বসা মসজিদটা মুসলমানদের জন্য ধর্মীয়ভাবেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র মক্কা এবং মদীনার পর এটাকেই মুসলমানদের সবচেয়ে সম্মানিত এবং পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পবিত্র কুরআন শরীফে এই মসজিদের কথা উল্লেখ আছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এখান থেকে মিরাজে গমন করেছিলেন।
এ কারণে শুধু ফিলিস্তিন না, সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছেই এই স্থানের গুরুত্ব অন্যরকম। আল-আক্বসাকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত যতবার সংঘর্ষ হয়েছে, সবগুলোই হয়েছে সাম্যাবস্থা ভঙ্গ করে উগ্র ইহুদীবাদীরা জোরপূর্বক মসজিদে প্রবেশ করার চেষ্টা করার ফলে। ২০০০ সালে এরিয়েল শ্যারন স্ট্যাটাস ক্যু ভঙ্গ করে ১,০০০ পুলিশ সহ হারাম শরীফে প্রবেশ করলে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শুরু হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, যার ফলে প্রায় ৩,০০০ ফিলিস্তিনি এবং ১,০০০ ইসরায়েলি নিহত হয়।
কেন মেটাল ডিটেক্টর স্থাপন এত বিতর্কিত?
বর্তমান বিশ্বে মেটাল ডিটেকটর নতুন কিছু না। ইসরায়েলে তো বটেই, বিশ্বের প্রায় সবদেশেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর প্রবেশপথে, এমনকি কিছু মুসলিম দেশের গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের প্রবেশপথেও মেটাল ডিটেক্টর আছে। ইসরায়েল দাবি করছে, এই মেটাল ডিটেক্টর বসানোর উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন কেউ অস্ত্র সহ মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এমনকি এরকম দাবিও করেছেন যে, নামাজ পড়তে আসা মুসলমানদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এই ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে মুসলমানরা কেন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে?
ব্যাপারটা হচ্ছে, আল-আক্বসা কম্পাউন্ড বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের মতো না। ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়ায় এর উপর ইসরায়েলের একক কোনো কর্তৃত্ব নেই। চুক্তি অনুযায়ী একটা বিশেষ ‘স্ট্যাটাস ক্যু’ অনুযায়ী এটি নিয়ন্ত্রিত হয়। আক্বসা কম্পাউন্ডে আগে থেকেই মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ওয়াক্বফের সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট আছে। ইসরায়েল চাইলে তাদের সাথে আলোচনা করে তাদের দ্বারাই মেটাল ডিটেকটর বসানোর প্রস্তাব করতে পারতো। সেটা না করে, ফিলিস্তিনী নেতাদের সাথে বা ওয়াক্বফের সাথে আলোচনা না করে, নিজেদের সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত ইলেক্ট্রনিক গেট স্থাপন করাকে তাই ইসরায়েলের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুরভিসন্ধিমূলক আচরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তাছাড়া ইসরায়েলের উগ্রপন্থী একটা অংশ বরাবরই বিভিন্ন অযুহাতে আল-আক্বসা মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে ইহুদীদের ধর্মীয় উপাসনালয় তৈরির দাবি করে আসছে। ইসরায়েলের সরকার এবং পুলিশও বিভিন্ন সময় তাদের পক্ষে ভূমিকা নিয়েছে। কাজেই ইসরায়েলের মেটাল ডিটেক্টর বসানোটাকে আল-আক্বসার উপর জায়নিস্টদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটা অপচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের প্রতিবাদটা তাই শুধুমাত্র মেটাল ডিটেক্টরের বিপক্ষে না, বরং সেটা ইসরায়েলি পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত নিরাপত্তা ব্যবস্থারও বিরুদ্ধে।
আল-আক্বসা মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ, ওয়াক্বফের ডেপুটি মিনিস্টার ইবরাহিম আওয়াদাল্লাহ বলেন, ইসরায়েল এই ব্যবস্থা নিয়েছে মুসলমানদেরকে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়ার জন্য। তার মতে, এটা কোনো সুপার মার্কেট বা নাইট ক্লাব না। বিশাল সংখ্যক মানুষ এখানে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়তে আসে। মেটাল ডিটেক্টরের মধ্য দিয়ে তাদেরকে যেতে বাধ্য করার অর্থ হচ্ছে তাদেরকে দেরি করিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে হেনস্থা করা।
মেটাল ডিটেক্টর কি থাকছে না সরানো হচ্ছে?
মেটাল ডিটেক্টর সরানো হবে কিনা এ ব্যাপারে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দ্বিধাবিভক্ত বক্তব্য দিয়ে আসছিল। উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইওয়াভ মোরদেশাই বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা আশা করি, জর্ডান এবং অন্য আরব রাষ্ট্রগুলো ভিন্ন কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার প্রস্তাব দিতে পারবে। যেকোনো সমাধান, সেটা হোক ইলেক্ট্রনিক, সাইবার অথবা অন্য কোনো আধুনিক প্রযুক্তির, ইসরায়েল তার জন্য প্রস্তুত। আমরা নিরাপত্তাজনিত সমাধান চাই, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় না।”
অন্যদিকে ইসরায়েলের আর্মি রেডিওতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির প্রভাবশালী নেতা এবং মন্ত্রী জাকি হানেগবি বলেন, “মেটাল ডিটেক্টরগুলো থাকবে। খুনীরা আমাদেরকে বলতে পারবে না কীভাবে খুনীদেরকে খুঁজে বের করতে হয়। যদি ফিলিস্তিনীরা মসজিদে প্রবেশ করতে না চায়. তাহলে তাদের প্রবেশের দরকার নেই।”
আরেকজন মন্ত্রী এরদান আর্মি রেডিওকে বলেন, মেটাল ডিটেকটর থাকতে পারে, তবে নামাজ পড়তে আসা সবাইকে এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন না-ও হতে পারে। বাইরের প্রবেশপথগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা যেতে পারে। তার মতে, অনেক মুসল্লী আছেন, যারা নিরাপত্তাকর্মীদের পরিচিত অথবা বয়স্ক। তাদেরকে ছাড় দিয়ে শুধু সন্দেহভাজনদেরকে গেটের মধ্য দিয়ে চেক করা হতে পারে।
তবে ওয়াক্বফ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ইসরায়েল কর্তৃক আরোপিত কোনো নতুন ব্যবস্থা মেনে নিবে না। ফিলিস্তিনী গ্র্যান্ড মুফতি, ফিলিস্তিনের প্রধান বিচারপতি এবং ওয়াক্বফ কর্তৃপক্ষ এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, তারা যেকোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক গেট সহ এই পবিত্র স্থানের মর্যাদা হানি করে, দখলদার বাহিনীর এমন সব ধরনের আয়োজন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করবে।
আন্দোলনের মুখে মেটাল ডিটেকটর প্রত্যাহার
নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মানুষ তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখায় এবং ইসরায়েলের উপর ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় অবশেষে ইসরায়েল আল-আক্বসা মসজিদ কম্পাউন্ড থেকে মেটাল ডিটেক্টর সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার পরিবর্তে তারা সেখানে ফেস রিকগনিশন প্রযুক্তি সম্বলিত অত্যাধুনিক সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা স্থাপন করবে। গত ২৪ জুলাই, সোমবার মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আল জাজিরার সংবাদ অনুযায়ী, সিদ্ধান্তের পর সোমবার রাতেই মেটাল ডিটেক্টর সম্বলিত ইলেক্ট্রনিক গেট সরিয়ে নেওয়া এবং একইসাথে নতুন করে সিকিউরিটি ক্যামেরা বসানোর জন্য বুলডোজার দিয়ে মাটি গর্ত করে ইলেক্ট্রিক ক্যাবল বসানোর কাজ শুরু হয়। তবে এ সময় লায়ন গেটের সামনে অবস্থিত ফিলিস্তিনিরা সিকিউরিটি ক্যামেরা স্থাপনের প্রতিবাদে ইসরায়েলি পুলিশের সাথে নতুন করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদেরকে লক্ষ্য করে রাবার কোটেড স্টিল বুলেট এবং স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
আল-আক্বসার মসজিদের পরিচালক, শেখ নাজাহ বাকিরাত আল জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন, এই পদক্ষেপ মুসলমানদের দাবি পূরণ করতে পারেনি। কারণ মেটাল ডিটেক্টর সরানো হলেও সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে যাচ্ছে। আল-আক্বসার আরেক কর্মকর্তা, শেখ রায়েদ সালেহ বলেন, ফিলিস্তিনিরা কখনোই এই অবস্থা মেনে নিবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ১৪ই জুলাইর পর থেকে আরোপিত সবকিছু সরিয়ে নেওয়া না হয়।
চূড়ান্ত বিজয়: সরানো হয়েছে ক্যামেরাও
মেটাল ডিটেকটর সরানোর পরেও আন্দোলন স্তিমিত না হওয়ায় এবং ফিলিস্তিনিরা মসজিদের পরিবর্তে বাইরের খোলা ময়দানে নামাজ আদায় অব্যাহত রাখায়, অবশেষে ইসরায়েল নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আরেকটি রক্তাক্ত শুক্রবার আসার আগেই, বৃহস্পতিবার তারা সিকিউরিটি ক্যামেরা সহ সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেয়। ফিলিস্তিনীদের দুই সপ্তাহের আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখে। অর্জিত হয় তাদের চূড়ান্ত বিজয়।
ক্যামেরা সরিয়ে নেওয়ার পরপরই হাজার হাজার ফিলিস্তিনী নারী-পুরুষ-শিশু বাধ ভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা দলে দলে আল-আক্বসা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। সেখানে ইসরায়েলি পুলিশ আবারও তাদেরকে বাধা প্রদান করলে সংঘর্ষে অন্তত ১২৮ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ মসজিদ প্রাঙ্গণের সর্বশেষ গেটটিও খুলে দিতে এবং ওয়াক্বফ কর্তৃপক্ষের হাতে মসজিদ প্রাঙ্গণের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
বিজয় অর্জিত হওয়ায় মসজিদ প্রাঙ্গণের পরিচালনা কমিটি ওয়াক্বফ কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনীদেরকে দীর্ঘ দুই সপ্তাহ পর মসজিদের ভেতরে নামাজ পড়ার জন্য আহ্বান জানায়। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এখন থেকে মসজিদের ভেতরেই নামাজ আদায় করা হবে।
বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত ফিলিস্তিনিদের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে আল-জাজিরার সংবাদদাতা বলেন, মানুষ অনুভব করছে যে তারা সত্যি সত্যিই জয়ী হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি বিশেষ একটি মুহূর্ত। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এধরনের বিজয় আর কখনও দেখেনি।
ফিচার ইমেজ- wallpapersafari.com