আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সংক্ষেপে AI। এটি প্রকৌশল বিদ্যার সেই শাখা যেখানে যন্ত্রকে দেওয়া হয় মানুষের সমতুল্য বিচারবুদ্ধি। একটি যন্ত্র নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি কাজ করবে, এটাই তার বুদ্ধিমত্তা। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। কয়েক বছর পরই হয়তো দেখা যাবে যে, দুপুরবেলা পাশের বাড়ির রোবট গৃহকর্মী চেঁচিয়ে ডেকে একটু জিরার গুঁড়া চাচ্ছে। তখন যেন অবাক হবেন না! কেননা তাকে ঐ বাসার ভাবী এমন কথাই শিখিয়েছেন! কৃত্রিম বুদ্ধি মানেই যন্ত্রকে শেখানো। যা জানাবেন, তা-ই জানবে সে, তা থেকে শিখেই সে ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
বিজ্ঞানের এই শাখাটা বেশ বিস্তৃতি নিয়ে ডালপালা মেলছে। যন্ত্র যতই নিজে থেকে কাজ করা শিখবে, তত বিশ্রাম পাবে মানুষ। তাই হয়তো গোটা দুনিয়ায় যন্ত্রদের শেখানোর এত আয়োজন! এই শাখার পড়াশোনা সংক্রান্ত কথাবার্তা নিয়ে সাজানো হয়েছে লেখাটা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাঠ্যক্রমে কোন বিষয়গুলো রয়েছে, তার মধ্যে থেকেই কিছু জিনিস আলোচনা করবো আজ।
নলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং
জ্ঞান নিয়েই এই শাখার যত কারবার। নামটা পড়ে কী মনে হচ্ছে আপনার? লেখাপড়ার সবটা জুড়েই তো জ্ঞানচর্চা, তার আবার আলাদা করে প্রকৌশলবিদ্যা কেন! এই নলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা ইনফরমেশন টেকনোলজির এমন এক শাখা যেটা নলেজ বেজড সিস্টেম বা জ্ঞান ভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরি করা এবং সেটার রক্ষণাবেক্ষণ আর কার্যকারণ নিয়ে কাজ করে। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা, দরকারি তথ্যাদি বাছাই করা, সেগুলোকে যথাযথ জায়গায় সঠিক উপায়ে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত করা, নলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং হলো এসব কাজের সমষ্টি।
নলেজ বেজড সিস্টেমগুলোর মধ্যে আছে এক্সপার্ট সিস্টেম, নিউরাল নেটওয়ার্ক, কেস বেজড রিজনিং, ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট ইত্যাদি। কেস বেজড রিজনিং যেমন এর কাজ হচ্ছে নতুন পরিস্থিতিতে পুরনো কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। একটা ভিত্তি থাকে যেখানে তথ্যাদি থাকে একেকটা কেস বা ঘটনার আদলে। তার উপর ভিত্তি করে ভিন্ন কোনো কাজে নতুন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া, এটাই কেস বেজড রিজনিংয়ের মূল কথা। নতুন পরিস্থিতে সিস্টেম তার নলেজ বেজে সংরক্ষণ করে রাখা কেসগুলো ঘেঁটে দেখে কোনোটার সাথে নতুন কাজের মিল আছে কিনা, আর মিল পেয়ে গেলে সেটাকে কাজে লাগানো হয়।
মেশিন লার্নিং
মেশিন অর্থাৎ যন্ত্র, যাকে আপনি কৃত্রিম উপায়ে বুদ্ধিসম্পন্ন করতে চাচ্ছেন, সেটিকে ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট বা বুদ্ধিমান সত্ত্বা বলা হয়। এই এজেন্টের কিছু শেখার পদ্ধতিটি হচ্ছে মেশিন লার্নিং। সম্পূর্ণভাবে প্রোগ্রাম করা না হয়ে নিজে থেকে কাজ করা, আগেকার করা কাজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে উন্নত করা, মেশিন লার্নিং বিষয়ের মূল প্রতিপাদ্য এটাই। মূলত দু’ভাবে শিখতে পারে একটা যন্ত্র। একটি হলো সুপারভাইজড লার্নিং, অন্যটি আনসুপারভাইজড লার্নিং।
লার্নিং বা শেখার এই দুইটি উপায় কী নির্দেশ করে? সহজ ভাষায়, সুপারভাইজড লার্নিংয়ে একটি কাঠামো থাকে, আগে থেকেই জানা আছে এমন কিছু তথ্য সাজানো থাকে সেখানে, সেটি ব্যবহার করে নতুন কোনো কাজ করা হয়। আনসুপারভাইজড লার্নিংয়ে ঘটে উল্টোটা। যে কাজটা করা হচ্ছে সে সংক্রান্ত পূর্বের কোনো তথ্য মেশিন জানে না, অর্থাৎ কাজটা সম্পূর্ণই নতুন তার কাছে।
কম্পিউটার বিজ্ঞান যেহেতু অ্যালগরিদমের উপর ভিত্তি করে কাজ করে, কাজেই এআই শাখায়ও রয়েছে বহু অ্যালগরিদম। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমগুলো আলাদা করা হয় সুপারভাইজড ও আনসুপারভাইজড লার্নিংয়ের সূত্রে।
ডাটা মাইনিং
অনেকগুলো তথ্য থেকে আপনি প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য বের করে নেবেন, মূলত এটিই ডাটা মাইনিংয়ের আলোচ্য বিষয়। অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে কাজে লাগানোর বিদ্যা শেখায় ডাটা মাইনিং। নলেজ ডিসকভারি ফ্রম ডাটা নামক একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, সংক্ষেপে (KDD) কেডিডি, ডাটা মাইনিংকে অনেকেই কেডিডির অপর নাম হিসেবে জানেন। আবার কারো কারো মতে, এই নলেজ ডিসকভারি প্রক্রিয়ার একটা জরুরি ধাপ হচ্ছে ডাটা মাইনিং। ডাটা থেকে নলেজ ডিসকভারি অর্থাৎ তথ্য থেকে জ্ঞান লাভের এই যে প্রক্রিয়া, এর ধাপসমূহ হচ্ছে ডাটা ক্লিনিং, ডাটা ইন্টিগ্রেশন, ডাটা সিলেকশন, ডাটা ট্রান্সফরমেশন, ডাটা মাইনিং, প্যাটার্ন ইভাল্যুশন এবং নলেজ প্রেজেন্টেশন।
ডাটা মাইনিং পদ্ধতিগুলোর মধ্যে আছে ক্লাসিফিকেশন অ্যানালাইসিস, ক্লাস্টার অ্যানালাইসিস, রিগ্রেশন অ্যানালাইসিস, আউটলায়ার ডিটেকশন, অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড কো-রিলেশন অ্যানালাইসিস ইত্যাদি। যেমন অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড কো-রিলেশন অ্যানালাইসিস পদ্ধতিতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভব। আর সে অনুযায়ী একটি কাজের ধারা তৈরি করা সম্ভব।
ব্যবসা সংক্রান্ত একটি ছোট উদাহরণ দিয়েই বোঝানো যাক। একটি দোকানে ক্রেতারা প্রায় সময়ই যেকোনো দুটি জিনিস একসাথে কেনেন। হতে পারে সেটা রুটি আর মাখন, খাতা আর কলম কিংবা সুপারশপের মাছ আর সবজি! যখন ক্রেতাদের কেনাকাটার ধারা বিশ্লেষণ করে এই প্যাটার্ন বা ধরনটা জানা যাবে যে, তারা ঐ দুটো জিনিস বেশিরভাগ সময়ই একত্রে কিনছেন, তখন দোকান কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে কৌশল অবলম্বন করতে পারে। যেমন তারা দোকানের বিন্যাস বদলালো যাতে একসাথে বিক্রি হওয়া জিনিসগুলো পাশাপাশিই থাকে। কিংবা কোনো একটি পণ্যতে ছাড় দেওয়া হলো যাতে ক্রেতারা একসাথে দুটো পণ্য কিনতে আরো আগ্রহী হয়। এই বিষয়টাকে বলা হয় মার্কেট বাস্কেট অ্যানালাইসিস, যা ব্যবসাক্ষেত্রে বেশ কার্যকর।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের পাঠ্যক্রমে আছে আরো অনেক বিষয়। সেগুলোর মাঝে কিছু হচ্ছে প্যাটার্ন রিকগনিশন, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, রোবোটিকস, কম্পিউটার ভিশন ইত্যাদি।
প্যাটার্ন অর্থ ধরন বা বৈশিষ্ট্য। সেটিকে চিহ্নিত করার বিদ্যাই প্যাটার্ন রিকগনিশন। একটি বস্তুর বৈশিষ্ট্যাবলী পর্যবেক্ষণ করে তাকে শ্রেণীভুক্ত করা নিয়ে প্যাটার্ন রিকগনিশন কাজ করে থাকে। ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং বা এনএলপি, মানবজাতি এবং যন্ত্রসমাজ, এই দুইয়ের যোগাযোগের ভাষার মাঝে সামঞ্জস্য রাখাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই শাখার কাজ।
রোবোটিকস শাখায় রোবট কিংবা ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট তৈরির কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়। আর কম্পিউটার ভিশন কাজ করে যন্ত্রের দেখার ক্ষমতার উপর। কম্পিউটারের ইমেজ প্রসেসিং ক্ষমতা, ভিশন ক্ষমতা থেকে তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা ইত্যাদি নিয়েই এর কারবার।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা বাড়ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও। কম্পিউটার বিজ্ঞানের বহু শিক্ষার্থীর আগ্রহের কেন্দ্রে জায়গা করে নিচ্ছে এআই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদানে যুক্ত হচ্ছে এই বিষয়গুলো। আর সব জায়গায় অটোমেশনের কদর বাড়ার এই সময়ে এআই কতটা দরকারি, তা নিয়ে বাক্যব্যয় না করলেও চলে। এই সংক্রান্ত ওয়ার্কশপ আর সেমিনার আয়োজিত হয়ে থাকে, সেসবে অংশ নিয়েও কেউ চাইলে নিজের আগ্রহকে আরো অনেকটাই পাকাপোক্ত করে তুলতে পারে। আর অবশ্যই, নিজের ভালোলাগার বিষয় নিয়ে জ্ঞান থাকা উচিত পাঠ্যসূচীর বাইরেও। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মত চমৎকার বিষয় নিয়ে খানিক বাড়তি পড়াশোনা খুব একটা খারাপ ব্যাপার হবে না সম্ভবত!
তথ্যসূত্র:
১/ An Introduction to Knowledge Engineering; Simon Kendal; Malcolm Creen; Page: 21, 55
২/ Data Mining Concepts and Techniques; Jiawei Han; Micheline Kamber; Jian Pei; Page: 6,7, 244
ফিচার ইমেজ: lanner-america.com