১৯৮৬ সালের এক ভয়ংকর সন্ধ্যা। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় অবস্থিত লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল প্রায় দুই হাজার লোক। তখনই লেক থেকে উঠে আসা হঠাৎ একধরনের গ্যাস প্রায় ১৭০০ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। মানুষের পাশাপাশি অগণিত পশুপাখির মৃত্যুর পেছনেও রাখে ভূমিকা। সেখানে প্রায় ৪,০০০ গরু, ৫৫০টি ছাগল, ৩০০টি ভেড়া এবং ৩,০০০ এর উপর বুনোপাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।
পরে যখন এ ঘটনার তদন্ত শুরু হয় তখন অনুসন্ধানকারীরা ঘোষণা দেয়, লেক নিজেই এত বড় বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর বোঝা যায়, এই লেক থেকেই একধরনের প্রাণঘাতী গ্যাস বের হয়ে থাকতে পারে কিংবা কোনো অ্যারোসল মেঘ পুরো জায়গাটিতে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রাণনাশক ঘটনা ঘটায়।
লেকটি ছিল ক্যামেরুন নামক আফ্রিকার একটি দেশের উত্তর-পশ্চিম দিকে, যার নাম লেক নায়োস। উপত্যকার উপর অবস্থিত হওয়ায় জায়গাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত ছিল। অনেক মানুষ সেখানে অবকাশ যাপন করতে যেত। কিন্তু প্রকৃতির নির্মম পরিহাসে সেদিন যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই সেই লেকে ডুবে, নাহয় গ্যাসের প্রকোপের ভেতরে পড়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। [১]
লেকের ঘটনাটি নিয়ে যখন গবেষণা শুরু হয় তখন ধারণা করা হয়েছিল, হয়তো কোনো বিষাক্ত আগ্নেয়গিরি থেকে আগত গ্যাসের কারণে এমনটি হয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, লেক থেকেই এই গ্যাস বের হয়ে, নিজেকে প্রাণীকুলের জন্য বিষাক্ত করে লেকের পানির মধ্যেই মিশে গিয়েছিল। একটি লেক থেকে কীভাবে বিষাক্ত গ্যাস বের হতে পারে? কী কারণ থাকতে পারে এরকম হওয়ার পেছনে?
এমন হওয়ার পেছনে একটি বৈজ্ঞানিক কারণ ছিল। অনুসন্ধানে দেখা যায়, লেকের পানিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড দ্রবীভূত ছিল। বিশেষ করে লেকের নিচের দিকে এর পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, কারণ সেখানে পানির চাপ লেকের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি ছিল। কিছু না কিছু একটা সেই লেকের ভেতরের দিকে হয়েছিল, যার কারণে নিচের দিকের পানি উপরের দিকে উঠে এসেছিল এবং উপরের দিকে উঠে আসতে আসতে পানির সাথে মিশে যাওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড সেখানে বুদবুদ তৈরি করছিল। সেই বুদবুদগুলো আবার প্লবতা সূত্র মেনে লেকের পানির পৃষ্ঠভাগে উঠে এসেছিল। বুদবুদগুলোর তেজ এত বেশি ছিল যে লেকের ভেতর একটি স্রোতের মতো তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং স্রোতগুলো পুরো লেক জুড়ে অবস্থান করছিল। [২]
পানিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকার কারণে তা পানিকে বার বার টেনে ধরছিল এবং লেকের সীমানার উপর আছড়ে ফেলছিল। পানিগুলো তখন লেকের সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে দিয়েছিল। উপত্যকার উপর আছড়ে পড়া এই বিষাক্ত পানি সেখানে অবস্থান করা মানুষগুলোকে শ্বাসরোধ করে দেয়। যার কারণে এতগুলো মানুষের মৃত্যু ঘটে।
এই লেকের বিষাক্ত পানির শিকার হওয়া মানুষগুলো সেই পানির ভেতর ডুবে যায় এবং অক্সিজেন না পাওয়ায় সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। শুধু মানুষই নয়, অনেক প্রাণীও সেখানে মৃত্যুবরণ করে, যাদের সংখ্যা গুণে শেষ করা যায়নি। পরে গবেষণা করে জানা গিয়েছে যে, প্রায় ২ লক্ষ টন পানি সেদিন লেক থেকে উপরে উঠে এসেছিল এবং সেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ ছিল মোটামুটি ৬ হাজার টন। [৩]
কীসের জন্য কিংবা কীভাবে লেকের নিচের দিককার পানি উপরের দিকে উঠে আসলো- তার সঠিক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ রিপোর্টে উঠে এসেছিল। তার মধ্যে একটি কারণ ছিল বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন এবং লেকের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র বায়ুপ্রবাহ। সম্ভাব্য অনেকগুলো কারণের মাঝে এ দুটি কারণ একসাথে ঘটার সম্ভাবনা বেশি পাওয়া গিয়েছে এবং এ দুটি একসাথে ঘটলেই এত বড় বিপর্যয় ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ দুটি সম্ভাবনা বাস্তব, কারণ লেকের আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এ দুটি কারণ ঘটানোর জন্য উপযুক্ত এবং বেশ অনুকূলও।
এবার সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় আসা যাক। লেকের পানির তুলনায় বৃষ্টির পানির তাপমাত্রা একটু কম হয়ে থাকতে পারে। যে কারণে বৃষ্টির পানি যখন লেকের পানির উপর পড়ছে তখন সেখানে অস্থিত অবস্থায় থাকতে পারে। বৃষ্টির পানি শুধু ঠাণ্ডাই নয়, এর ঘনত্বও লেকের পানির তুলনায় বেশি। তাই লেকের উপরে এই অস্থিতি অবস্থা খুবই স্বাভাবিক। ঠিক এমন সময় যদি কোনো তীব্র এবং শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ এই বৃষ্টির পানির স্তরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তাহলে সেখানে বৃষ্টির পানি খুব সহজেই লেকের পানির ভেতর ডুবে যাবে এবং বেশি ঘনত্বের এই পানি ডুবে যাওয়ার সময় প্লবতার কারণে লেকের নিচের পানিগুলো বৃষ্টির পানিকে জায়গা করে দিতে নিজেরা উপরের দিকে উঠে আসতে থাকবে।
যেহেতু লেকের নিচের দিকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি ছিল এবং সেই পানি উপরের দিকে উঠে এসেছে, তাই এই বিষাক্ত পানির উপর যে চাপ ছিল সেটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। চাপ কমে যাওয়ার কারণে পানির ভেতর দ্রবীভূত অবস্থায় থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসও দ্রবণ থেকে বের হয়ে এসে বুদ বুদ তৈরি করতে পারছে। গ্যাসের বের হয়ে আসার কারণেই লেকের পানির উপরের দিকে মানুষগুলো অক্সিজেনের কমতিতে শ্বাসরোধে সেখানেই মারা যায় এবং ডুবে যায়। [২]
অনেকে মনে করেছিল কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে হয়তো গ্যাস সেখানে এসে মিশে গিয়েছে। কিন্তু লেকের পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করার পর জানা যায়, সেখানে কার্বন ১৩ এবং কার্বন ১২ আইসোটোপ ছিল, কিন্তু এর ভেতর কোনো জৈব পদার্থের উপস্থিতি ছিল না। কিছু পরিমাণে মিথেন পাওয়া গেলেও কোনো আগ্নেয় গ্যাস ছিল না। [৪]
ক্যামেরুনের লেক নায়োস এখনো কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরপুর। গবেষকরা এখনো সেখানকার অবস্থা নিয়মিত পর্যালোচনা করেন এবং তাদের ভয় যে হয়তো এখন যেকোনো সময় সেখানে আরেকটি এমন প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটতে পারে। আর সেজন্য এই লেকের কাছাকাছি লোকজনকে যেতে বারণ করা হয়েছে, বিশেষ করে বর্ষাকালে সেখানে যাওয়া থেকে স্থানীয়দের কর্তৃপক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
তথ্যসূত্র
[১] Walker, J. (2007). Flying Circus of Physics. John Wiley & Sons, Inc.
[২] Freeth, S. J., and R. L. F. Kay (1987) The Lake Nyos gas disaster, Nature, Vol. 325, pp. 104-105.
[৩] Kerr, R. A. (1987) Lake Nyos was rigged for disaster, Science, Vol. 235, pp.528-529.
[৪] Freeth, S. J. (c1992) Incident at Lake Nyos. Tracking the source of deadly cloud of gas, The Sciences, Vol. 32, Vol. 3, pp. 30-36.
ফিচার ইমেজ: Tripfreakz.com