অধ্যাপক ইউভাল নোয়াহ হারারি বর্তমান বিশ্বের একজন প্রভাবশালী চিন্তক, ঐতিহাসিক এবং বুদ্ধিজীবী। তার পেশাগত পরিচয় তিনি জেরুজালেমস্থ হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। তবে তিনি সর্বাধিক আলোচিত তার রচিত আন্তর্জাতিকভাবে বেস্টসেলার বই ‘স্যাপিয়েন্স: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অভ হিউম্যানকাইন্ড’ এর জন্য। এ বইয়ে তিনি বর্ণনা করেছেন মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ পথচলার এক অভিনব জ্ঞানভাষ্য। ২০১৫ সালে দেওয়া তার টেড-টকটি রোর বাংলার পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হলো—
প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে, আফ্রিকার নির্জন-নিঃসীম প্রান্তরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো আমাদের পূর্বপুরুষ আদি হোমিনিডরা ছিল জেব্রা, বাইসন, হরিণ কিংবা বাঘের মতোই তুচ্ছ-অগুরুত্বপূর্ণ এক জন্তু। পৃথিবীতে তাদের প্রভাব একটা জেলিফিশ, একটা জোনাকি কিংবা একটা দোয়েল পাখির চেয়ে খুব বেশি ছিল— তা বলা যায় না। আজকে, তাদের উত্তরপুরুষ আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষ পৌঁছে গেছে পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে পশ্চিম-ঈশান থেকে নৈঋতে, গোটা পৃথিবীর টিকে থাকা না থাকা আজ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাদের কর্মকাণ্ডের উপর; মানুষ আজ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট অস্তিত্ব। কীভাবে আমরা ওখান থেকে আজকের জায়গায় এলাম? কীভাবে আফ্রিকার সাদামাটা এক শ্রেণির নরবানর পরিণত হলো পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে খুনে-সবচেয়ে দুর্ধর্ষ, আবার সবচেয়ে রোম্যান্টিক-সবচেয়ে ভাববিলাসী, সর্বোপরি সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রজাতিতে?
গতানুগতিক পদ্ধতিতে এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে থাকি ব্যক্তিপর্যায়ে অন্য প্রাণীর সাথে আমাদের তফাতের ভিত্তিতে। যে কারণেই হোক, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আমার মধ্যে, আমার দেহে, মগজে, মনে, মননে এমন ‘বিশেষ’ কিছু আছে, যা কিনা আমাকে একটা কুকুর, একটা ভেড়া কিংবা একটা শিম্পাঞ্জি থেকে স্বতন্ত্র করেছে, উন্নত করেছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, জীববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে একজন ব্যক্তি মানুষ আর একটা শিম্পাঞ্জির মধ্যে বিশেষ প্রভেদ নেই। কে ভালো টিকে থাকতে পারে, তা দেখার জন্য একটা মানুষ আর একটা শিম্পাঞ্জিকে যদি কোনো বিপদসঙ্কুল-নির্জন দ্বীপে ছেড়ে আসা হয়, তাহলে কিন্তু মানুষটা নয়, শিম্পাঞ্জিটাই জিতবে!
আসলে, আমাদের সাথে অন্যান্য প্রাণীর সূক্ষ্ম এবং প্রকৃত প্রভেদটা সামষ্টিক পর্যায়ে। মানুষ আজ পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার কারণ, আমরাই একমাত্র প্রজাতি, যারা বৃহৎ পরিসরে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে একসাথে সহাবস্থান করতে পারি। বলতে পারেন, পিঁপড়া কিংবা মৌমাছিও তো অনেকে একসাথে মিলে কাজ করতে পারে। সত্য, তারা পারে। কিন্তু তাদের সেই কাজ একদমই বাঁধা-ধরা, অর্থাৎ তাতে কোনো সৃজনশীলতা নেই। মৌচাকে যদি হঠাৎ করে কোনো ঝামেলা দেখা দেয়— প্রাকৃতিক কারণে, বা অন্য কোনো প্রাণীর উপদ্রবে, তাহলে মৌমাছিরা কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে তাদের সামাজিক-ব্যবস্থাকে রাতারাতি নতুন করে নির্মাণ করতে পারবে না। আপনি কখনোই দেখবেন না, সব মৌমাছি মিলে বিদ্রোহ করেছে এবং ইংরেজ বিপ্লবের মতো রানী মৌমাছির শিরশ্ছেদ করে মৌচাককে নয়া-গণ প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছে।
নেকড়ে, ডলফিন, হাতি এবং শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে খানিকটা উন্নত সামাজিক ব্যবস্থার দেখা মেলে, কিন্তু তাদের সেই সামাজিকতা, সাহায্য-সহযোগিতা সীমাবদ্ধ থাকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হাতেগোনা কয়েকটা প্রাণীর মধ্যে। নেকড়ে আর শিম্পাঞ্জির সামাজিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয় ব্যক্তিগত জানাশোনার মাধ্যমে। আমি যদি একটা শিম্পাঞ্জি হই, এবং আমাকে যদি আরেকটা শিম্পাঞ্জির সাথে যোগাযোগ করতে হয়, সহাবস্থান করতে হয়, আমাকে ব্যক্তিগতভাবেই জানতে হবে— অপর জন্তুটি কেমন শিম্পাঞ্জি? ভালো, না খারাপ? অন্য শিম্পাঞ্জি গোত্র আক্রমণ করলে তার কাছ থেকে কি সাহায্য পাওয়া যাবে নাকি যাবে না?
এরকম জানাশোনা ছাড়া শিম্পাঞ্জিরা কখনোই কোনো যোগাযোগের ‘ঝুঁকি’ নিতে চাইবে না, পাছে বিপদ ঘটে কোনো!
জীবজগতে কেবলমাত্র হোমো স্যাপিয়েন্সই অত্যন্ত কার্যকর উপায়ে অসংখ্য চেনা, অর্ধচেনা ও অচেনা আগন্তুকের সাথে একসাথে কাজ করতে পারে, সহাবস্থান করতে পারে। একটা শিম্পাঞ্জি-বনাম একজন স্যাপিয়েন্স, কিংবা দশটা শিম্পাঞ্জি-বনাম দশজন স্যাপিয়েন্সের দ্বন্দ্বে শিম্পাঞ্জিরাই আমাদের চেয়ে ভালো করবে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাটা হাজারে নিয়ে যান, দেখবেন, স্যাপিয়েন্স অনায়াসেই জিতে যাবে। কারণটা খুবই সহজ। এক হাজার শিম্পাঞ্জি কখনোই নিজেদের মধ্যে কার্যকর, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারবে না।
দশ হাজার শিম্পাঞ্জিকে ওয়াল স্ট্রিট, তিয়েন আনমেন স্কয়ার, ভ্যাটিকান কিংবা ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে জমায়েত করুন, আপনি কেবল বিশৃঙ্খলাই দেখবেন। উল্টোদিকে, হাজার হাজার মানুষ কিন্তু ঐ জায়গাগুলোতে প্রতিনিয়তই জড়ো হচ্ছে-একইসাথে কাজ করছে এবং আমরা তো সচরাচর সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখছি না; বরং দেখছি, নানা স্বার্থের, নানা মতের, নানা পথের মানুষের অদ্ভুত জটিল কিন্তু কার্যকর নেটওয়ার্ক। তারা সফলভাবে গড়ে তুলছে কসমোপলিটন, বাণিজ্য যোগাযোগ এবং ফুটবল বা ক্রিকেটের বিশ্বকাপ!
মানবসভ্যতার বড় বড় অর্জন; পিরামিড থেকে চন্দ্রাভিযান— কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিপর্যায় থেকে আসেনি, এসেছে সামষ্টিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে। আবার ইতিহাসে যত ভয়ঙ্কর ঘটনা মানুষ এ পর্যন্ত ঘটিয়েছে, সেগুলোও কোনো না কোনোভাবে এই বৃহত্তর গণসহযোগ গণযোগাযোগের লঘু কিংবা গুরু ফসল। এর সাহায্যে মানুষ একদিকে যেমন গড়েছে দেশ, সমাজ, জাতিরাষ্ট্র— তেমনি বাঁধিয়েছে যুদ্ধ, গড়েছে জেলখানা আর শরণার্থী শিবির।
ধরা যাক, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পেরেছি যে, হ্যাঁ, আমরা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছি— কারণ আমরা সার্থকভাবে একসাথে কাজ করতে পারছি। উৎসুক শ্রোতার পরবর্তী প্রশ্ন হবে, কীভাবে মানুষ এই অসাধ্য সাধন করতে পারছে? অন্যসব প্রজাতিকে ছাড়িয়ে কীভাবে মানুষ এত সফলভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারছে; সে খেলাধুলার ব্যাপারেই হোক, বাণিজ্যের ব্যাপারেই হোক, বা যুদ্ধে একে অপরকে নিধনের ব্যাপারে?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আমাদের কল্পনা।
অন্যসব প্রাণী তাদের যোগাযোগ ব্যবহার করে থাকে বাহ্যিক ভৌত বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। একটা শিম্পাঞ্জি বলতে পারে, “দেখো, একটা সিংহ, চলো পালাই!” অথবা, “দেখো, কী সুন্দর কলার বাগান, চলো কলা খাই গিয়ে”। বিপরীতভাবে মানুষ তার ভাষাকে কেবল তার চারপাশের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতেই ব্যবহার করে না, বরং নতুন বাস্তবতা তৈরি করতেও ব্যবহার করে— যাকে আমরা বলতে পারি ‘কাল্পনিক বাস্তবতা’। আমরা অসংখ্য পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সাথে এক হয়ে কাজ করতে পারি, কেননা আমরাই কেবল তৈরি করতে পারি বিভিন্ন মিথ বা গল্প। শুধু তৈরিই করি না, আমরা সেগুলোকে কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং সকলকে আশ্বস্ত করতে পারি সেই মিথে বিশ্বাস স্থাপন করতে।
সমাজ, দেশ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা যা বুঝি, তার কোনোটাই তো ঐ অর্থে বস্তুগত নয়— এদের সৃজন, উন্মেষ, ধ্বংস সবই আমাদের চিন্তায় আর মননে। একটা ভালো গল্প সামাজিক বন্ধন তৈরি করে দেয়। সেই গল্পে যখন বিশ্বাস স্থাপন করে লাখো মানুষ, তখন সকলে বাঁধা পড়ে অভিন্ন নিয়ম-শৃঙ্খলা-মূল্যবোধের শেকলে; তখন আর একজন নয়, ঐ লাখো মানুষের সবার মনে একত্রে জন্ম নেয় এক কাল্পনিক বাস্তবতা, যার মূর্ত রূপ আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো— মানে গোত্র, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—যেখানে আমরা পারস্পরিক সাহায্য-সহাবস্থান গড়ে তুলি সহজেই। রাষ্ট্র সেই অর্থে কোটি মানুষের এক মহা মিলনক্ষেত্র, যারা পরস্পর পরস্পরের কাছে আগন্তুক; কিন্তু তাদের বিশ্বাস অভিন্ন মিথে।
উদাহরণস্বরূপ, আমার দেশ ইসরায়েলের জনসংখ্যা মোটামুটি আট মিলিয়ন, যারা সকলে আমার মতো ইসরায়েলি নাগরিকত্ব সনদ ধারণ করেন। আমি কিন্তু তাদের সবাইকে চিনি না, জানি না। তবু ‘জাতীয়তাবোধ’ নামক মিথের সুবাদে আমরা নিজেদের এক চিন্তা করি, একসাথে কাজ করি, পরস্পর সহাবস্থান করি।আমাদের আট মিলিয়ন ইসরায়েলির সত্যিই কোনো ভৌত-অস্তিত্বশীল দেশ নেই, দেশ আছে আমাদের কাল্পনিক বাস্তবতায়— যার ভিত্তি ঐ জাতীয়তাবোধ, অভিন্ন ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। এটা নিঃসন্দেহে অসাধারণ ব্যাপার! এই মিথ তৈরির ক্ষমতা মানুষের এক অনন্য-অসামান্য গুণ। আপনি কিন্তু কখনোই একটা শিম্পাঞ্জিকে এরকম কোনো মিথে বিশ্বাস করাতে পারবেন না।
একই ব্যাপার সত্য অন্যান্য বৃহৎ মানব-সংযোগ ক্ষেত্রগুলোতেও। আমাদের আইন ব্যবস্থাগুলোর দিকেই তাকান। অধিকাংশ আইনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সর্বজনীন মানবাধিকারের ভিত্তিতে। কিন্তু মানবাধিকারের তো কোনো জৈব বা ভৌত কোনো অস্তিত্বই নেই। একজন মানুষকে কেটে দেখুন। বৃক্ক পাবেন, হৃৎপিণ্ড পাবেন, হরমোন পাবেন। কিন্তু কোথাও মানবাধিকার বলে কোনো বস্তু পাবেন না। বস্তুগত পৃথিবীতে ‘অধিকার’ বলে কোনো বস্তু নেই— সে শিম্পাঞ্জিরই হোক, বা মানুষের।
বস্তুগত বিশ্বে অস্তিত্ব আছে পাহাড়-পর্বতের কিংবা গাছপালার, যেগুলো আপনি ছুঁতে পারেন দেখতে পারেন ঘ্রাণ নিতে পারেন। পক্ষান্তরে ‘অধিকার’-এর অস্তিত্ব কেবল ঐসব ‘আকর্ষণীয়’ গল্পে, যেগুলো আমরা আবিষ্কার করেছি গত কয়েক শতাব্দীতে এবং সকলে মিলে বিশ্বাস করেছি, একটা সুন্দর-সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের জন্য। একইভাবে ইসরায়েল, চীন বা আমেরিকা’র কোনো ভৌত অস্তিত্ব নেই, আপনি তাকে ছুঁতে-দেখতে পারবেন না। ইসরায়েল, চীন আর আমেরিকা কেবলই মিথ, যেগুলো আমরা তৈরি করেছি এবং সকলে মিলে এর সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছি গভীরভাবে।
একই ব্যাপার অর্থনীতির জন্যেও। একটা ডলার নোটের কথা ভাবুন, এর কি নিজের কোনো গুরুত্ব আছে? এই সামান্য সবুজ কাগজটা আপনি খেতে পারবেন না, পান করতে পারবে না, পরিধানও পারবেন না, কেননা এটা শুধুই একটা কাগজের টুকরো। কিন্তু যখনি কোনো মহাগল্পকার— ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বা বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের একটা শক্তিশালী গল্প বলেন, “দেখো, এই সবুজ কাগজটা কেবল সামান্য কাগজ নয়, আমি এখানে সিল দিয়ে দিচ্ছি, এটা এখন চারটে কলার সমান মূল্যবান।” আর সেই গল্পে যখন আমি বিশ্বাস করি-আপনি বিশ্বাস করেন-আমরা সবাই বিশ্বাস করি, তখন একটা বড় গোষ্ঠীর সহস্র মানুষের কাছে সেটা সত্যিই চারটে কলার সমান হয়ে ওঠে।
তখন তারা ঐ মূল্যহীন কাগজের টুকরোটা নিয়ে সুপারমার্কেটে যেতে পারে, দোকানে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে মিষ্টি করে সম্ভাষণ জানিয়ে সেই কাগজটা দিলে তার বদলে পেয়ে যেতে পারে আস্ত এক হালি কলা। এই অসাধারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষ ছাড়া আপনি কোত্থাও কক্ষণো পাবেন না! শিম্পাঞ্জিও বিনিময় করে অবশ্য, অপর একটা শিম্পাঞ্জি যদি তাকে একটা কলা দেয়, সে হয়তো একটা কলা বা একটা নারকেল দেবে তাকে। কিন্তু একটা শিম্পাঞ্জি যদি কোনোভাবে একটা ডলার নিয়ে গিয়ে আরেক শিম্পাঞ্জিকে দিয়ে বলে, “আমাকে এবার এক কাঁদি কলা দাও!”, তাহলে খুব সম্ভব অপর শিম্পাঞ্জিটা মৃদু গালি দিয়ে বলবে “আমাকে কি ঐ গবেট মানুষগুলো পেয়েছো?”
আজকের দিনে বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় কুশীলব কর্পোরেশন এবং কোম্পানিগুলো। আপনারা অনেকেই হয়তো এর কোনোটার সাথে পেশাগত কাজে যুক্ত আছেন। কিন্তু এগুলোও কি মিথ নয়, যা আমরা কল্পজগতে তৈরি করেছি এবং সযত্নে লালন-পালন করছি সবাই মিলে? আবার এই কর্পোরেশনগুলো কী করে? মূলত তারা টাকা করতে চায়। একটু আগেই বলেছি, ‘টাকা’ মানুষের আবিষ্কৃত সবচেয়ে সফল মিথের নাম। সারা বিশ্বের সব মানুষ হয়তো নির্দিষ্ট মতবাদে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে না সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ-মানববাদে; অথবা ঘৃণা করে, অস্বীকার করে আমেরিকা বা চীনের জাতীয়তাবাদকে। কিন্তু এমন কি কেউ আছে, যে ডলারকে অস্বীকার করে? নেই। এই একমাত্র বস্তু, যাতে সারা বিশ্বের সকলে একযোগে বিশ্বাস স্থাপন করেছে।
তাহলে পুরো ব্যাপারটা যা দাঁড়ালো, অন্য সকল প্রাণী, যেখানে কেবল গাছ, ফুল, পাতা, নদী, সাগর, পর্বত, বাঘ, সিংহের সমন্বয়ে গড়া বস্তুগত বাস্তবতায় বসবাস করে, আমরা, মানুষেরা সেখানে বাস করি এক দ্বৈত জগতে। আমাদের জগতেও নদী আছে, গাছপালা আছে, বাঘ সিংহ আছে— কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মনোজগতের প্রায় অপাংক্তেয় অদৃষ্ট অস্পর্শ উপাদানের সাহায্যে বস্তুজগতের ওপরে আমরা গড়ে তুলেছি কাল্পনিক বাস্তবতার এক নতুন স্তর, যে স্তর জুড়ে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দেশ, ডলার, গুগল কিংবা মানবাধিকারের মতো মিথগুলো।
দৃশ্যমান বস্তুজগতের গাছপালা, নদ-নদী কিংবা পশুপাখির অস্তিত্বও আজ সর্বতোভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আমেরিকা, চীন বা বিশ্বব্যাংকের মতো কাল্পনিক সত্ত্বার ইচ্ছা আর সিদ্ধান্তের ওপর, যাদের অবস্থান কেবলই আমাদের চিন্তালোকে! মিথ বা গল্পে’ শক্তিতেই মানুষ বিপ্লব করেছে ইতিহাস জুড়ে। একজন লেনিন, মাও, চে, লিঙ্কন ইতিহাসের শক্তিশালী গল্পকার ছাড়া কিছুই নন। তাদের রচিত কাল্পনিক বাস্তবতাতে বিশ্বাস করেই একেকটা গোটা জাতি উচ্ছেদ করেছে রাজতন্ত্রের, বন্ধ করেছে ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ কিংবা শত্রুর সামনে জীবন সঁপে দিয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বিশ্বে আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন কোনো বর্ণ-গন্ধহীন অম্লগ্যাস নয়, আমাদের অক্সিজেন এই গল্প আর মিথগুলোই!
টেড টকে দেওয়া হারাহির মূল বক্তব্যটি দেখুন এখানে–