– নতুন কিছু জানা গিয়েছে, অফিসার?
– নাহ, কীভাবে তাকে বিষপ্রয়োগ করা হলো তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
– সায়ানাইডেই মৃত্যু হয়েছে তাহলে?
– হ্যাঁ, করোনার তো তা-ই বললো।
– শরীরের আর কোথাও সায়ানাইডের চিহ্ন পাওয়া যায়নি?
– বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ডগায় সামান্য পাওয়া গিয়েছে।
– আঙুলে? আর কোথাও নয়?
– না। করোনারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, খাবার খাওয়ার অনেক পরে মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং, খাবারে সায়ানাইড মেশানোর ফলে মৃত্যু হয়েছে, এটা নাকচ করে দেওয়া যায়। আর ঘরের সব জায়গাতেই দেখা হয়েছে, সায়ানাইডের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি!
“তাহলে সায়ানাইড মুখে প্রবেশ করলো কীভাবে?” বলতে বলতে টেবিলের উপর থেকে লাল বইটা তুলে নিলো প্রাইভেট ডিটেকটিভ। “বাহ, শার্লক হোমস!” হাতে দস্তানা পরে সাবধানে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টোতে লাগলো সে।
– টেবিলের উপরেই মৃতদেহটা পড়ে ছিল না?
– হ্যাঁ, চেয়ারে বসা অবস্থায় ছিল, মাথাটা টেবিলের উপরে পড়ে ছিল।
– অফিসার! এখনই এই বইটা ল্যাবরেটরিতে পাঠান। পৃষ্ঠাগুলো পরীক্ষা করে দেখুন, সম্ভবত এর পৃষ্ঠাতেই সায়ানাইড লাগানো ছিল।
– মানে…? জ্বি, হ্যাঁ, অবশ্যই।
– আর ডেভনশায়ার বুক কর্নারে খোঁজ করুন। এই বইটা কে কিনেছে খুঁজে বের করুন। খুনিকে পেয়ে যাবেন। আমি চললাম।
– কিন্তু খুন হলো কীভাবে?
“এখনো বোঝেননি? বইয়ের পাতায় সায়ানাইড মাখানো ছিল। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানোর সময়েই তার আঙুলে সায়ানাইড লেগে যায়, তারপর জিহ্বায় হাত লাগতেই সব শেষ। বইয়ের পাতায় উল্টানোর সময় হাতে থুথু লাগানো খুবই খারাপ অভ্যাস, এরপর থেকে খেয়াল রাখবেন বিষয়টা,” বলে অফিসারের দিকে চোখ টিপে বের হয়ে গেলো ডিটেকটিভ।
সায়ানাইড নিয়ে গোয়েন্দা সাহিত্যে উৎসাহের কমতি নেই। আর্থার কোনান ডয়েল কিংবা আগাথা ক্রিস্টি, বিখ্যাত গোয়েন্দা লেখকেরা নিজেদের গল্পে খানিকটা হলেও সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়েছেন। এই বিখ্যাত বিষ নিয়ে মানুষের আলোচনাও কম নয়। এমন গুজবও রটেছে যে, মানুষ সায়ানাইড মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এর স্বাদ কেমন তা কেউ বলতে পারেনি। তা বলার আগেই সে মারা গিয়েছে। এরকম একটা খুবই প্রচলিত গুজব হলো কেউ একজন কলম হাতে ধরেই সায়ানাইডের স্বাদ পরীক্ষা করতে যান, কিন্তু ‘S’ শব্দটি লেখার পরপরই তিনি মারা যান। ‘S’ দিয়ে Sour (টক) বা Sweet (মিষ্টি), এমনকি Salty (লবণাক্ত)-ও হতে পারে। এই হচ্ছে সায়ানাইডের স্বাদ সম্পর্কে মানুষের সর্বোচ্চ জ্ঞান। কিন্তু আসলেই কি তা-ই?
সায়ানাইডের স্বাদ
২০০৬ সাল, ভারতের কেরালা রাজ্যের পালাক্কাদ জেলার ঘটনা। পুলিশের কাছে খবর আসলো প্রসাদ নামক এক স্বর্ণকার আত্মহত্যা করেছেন। কারণ? নকল সোনার গহনা কিনেছিলেন কয়েকদিন আগে, আর এটি কিনতে গিয়েই ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছিল তাকে। শেষমেশ নকল গহনার মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এই স্বর্ণকার। তবে প্রসাদ তার মৃত্যুর আগে এক অভাবনীয় কাজ করে গিয়েছেন। ভেঙে দিয়েছেন বিজ্ঞানের এতদিনের কিংবদন্তী, যে কেউ সায়ানাইডের স্বাদ বলতে পারেনি। প্রসাদ যে সায়ানাইডের স্বাদ গ্রহণ করে তা শুধু লিখে গিয়েছেন তা-ই নয়, বরং ডাক্তারদের উদ্দেশ্যেও ছোট একটা নোট লিখে গিয়েছেন, এবং ঠিক তারপরেই মারা গিয়েছেন।
প্রসাদকে সায়ানাইড পাওয়ার জন্য দূরে কোথাও যেতে হয়নি, সোনা নিষ্কাশনের জন্য সায়ানাইড একটি বহুল ব্যবহৃত পদার্থ। প্রসাদ সায়ানাইড বেশ বড় একটা পাত্রে রেখে তার মধ্যে কিছুটা অ্যালকোহল ঢেলে দেন, এরপর লেখার কলমের পিছন দিকটার সামান্য অংশ তাতে চুবিয়ে নিলেন। তারপর কলমে জিহ্বা লাগিয়েই তার চিঠি লেখা শুরু করলেন।
“ডাক্তার, এটা হচ্ছে পটাশিয়াম সায়ানাইড। আমি এটার স্বাদ গ্রহণ করেছি। এটা ধীরে ধীরে শুরু হয়, আর তারপরেই জ্বালা শুরু হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো জিহ্বা শক্ত হয়ে যায়। এর স্বাদ হচ্ছে অত্যন্ত কটু … আমি এরকম একটা গোয়েন্দা উপন্যাস পড়েছিলাম, যেখানে একজন লোককে সায়ানাইড প্রয়োগে মেরে ফেলা হয়। খুনী একটা বইয়ের পাতায় সায়ানাইড লাগিয়ে রাখে, আর যখনই সে বইয়ের পাতা উল্টানোর সময় তার হাত জিহ্বায় স্পর্শ করে, তখনই সে মারা যায়, এবং এই ঘটনায় কাউকে সন্দেহও করা যায়নি। আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে এর সাহায্যে সহজেই কাউকে খুন করে ফেলা সম্ভব…”
প্রসাদের ময়না তদন্তকারী ডাক্তার পিবি গুজরাল মন্তব্য করেছেন, “আমরা এখন জানতে পারলাম যে সায়ানাইডের স্বাদ কেমন। তার সুইসাইড নোটটা একটা দলিল। এর আগে কেউ বলে যেতে পারেনি সায়ানাইডের স্বাদ আসলে কেমন।” প্রসাদের এই কাজের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রসাদের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে এক লক্ষ রুপি প্রদান করার ঘোষণা দেয়।
এই ঘটনার কয়েক বছর আগে এক বিজ্ঞানী সায়ানাইডের স্বাদ কেমন তা পরীক্ষা করতে যান, কিন্তু কিছু বলার আগেই তিনি মারা যান। আরেকজন বিজ্ঞানীও একই কাজ করতে কলম ধরার আগেই পরলোকে পাড়ি জমান।
সায়ানাইড কীভাবে কাজ করে?
সহজ কথায় বলা যায়, সায়ানাইড দেহকোষগুলোকে অক্সিজেন থেকে শক্তি উৎপাদন করতে বাধা দেয়। সায়ানাইড আয়ন (CN-) মাইটোকন্ড্রিয়ার সাইটোক্রোম সি-তে অবস্থিত লোহার সাথে যুক্ত হয়ে তাকে আটকে রাখে। ফলে সাইটোক্রোম সি অক্সাইডেজ অক্সিজেনে ইলেকট্রন পরিবহণ করতে পারে না। অক্সিজেন ব্যবহার করতে না পারায় মাইটোকন্ড্রিয়াও এটিপি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। শক্তি উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় হৃৎপিণ্ডের পেশিকোষ আর স্নায়ুকোষ দ্রুত তাদের শক্তি খরচ করে ফেলে আর মারা যেতে শুরু করে। যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ কোষ মারা গেলেই আপনিও মারা যাবেন।
সায়ানাইড আসলে কতটা বিষাক্ত?
এটি নির্ভর করে সায়ানাইড কোন অবস্থায় দেহে প্রবেশ করছে। মুখের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করা কঠিন বা তরল সায়ানাইডের তুলনায় প্রশ্বাসের সাথে টেনে নেওয়া সায়ানাইড গ্যাস আরো বেশি মারাত্মক। প্রতি লিটারে ৩ মিলিগ্রামের চেয়ে বেশি সায়ানাইড কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যেই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। তবে সায়ানাইডই সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত সারিন গ্যাস, খাদ্যের মধ্যে বিষক্রিয়ার ফলে উৎপাদিত বটুলিনাম টক্সিন, এমনকি পারদও সায়ানাইডের তুলনায় বিষাক্ত।
সায়ানাইড ব্যবহারের ইতিহাস
সোনা নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে একটি বহুল ব্যবহৃত উপাদান এই সায়ানাইড। চিকিৎসাক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের জরুরি প্রয়োজনে রক্তচাপ কমানোর প্রয়োজন হলে তাদের দেহে স্বল্পমাত্রায় সায়ানাইড প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপানে যক্ষা আর মৃগীরোগের প্রতিকারের জন্য এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হতো। কীটনাশক হিসেবেও সায়ানাইড একটি বহুল ব্যবহৃত উপাদান।
আত্মহত্যার জন্যও সায়ানাইডের কুখ্যাতি কম নয়। নাৎসি বাহিনীর হিমলার, গোয়ারিং কিংবা হিটলারের স্ত্রী ইভা ব্রাউন থেকে শুরু করে শ্রীলংকার LTTE এর সদস্যরাও আত্মহত্যার জন্য সায়ানাইডকেই বেছে নিয়েছেন। ধরা পড়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বাঁচতে গুপ্তচর কিংবা কমান্ডোরাও সায়ানাইড ব্যবহার করতো।
ফিচার ইমেজ: Wallpaper Abyss