ক্লাসে শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আয়নাবাজি মুভিটা দেখেছো কয়জন?” শিক্ষার্থীরা একে অন্যের মুখের দিকে চাইতে লাগলো, কিন্তু কেউ হাত তুললো না। শিক্ষক খুবই অবাক হয়ে আবারও বললেন, “কী আশ্চর্য! এত জনপ্রিয় একটা মুভি, অথচ তোমরা কেউই দেখোনি!” এবার সাহস করে একজন হাত তুললো। তার দেখাদেখি আরও দুজন তুললো। সেই দুজনকে দেখে আরও চারজন। সেই চারজনকে দেখে আরও ছয়জন… এভাবে একপর্যায়ে গোটা ক্লাসের সবাই হাত তুলে ফেললো। এমন কেউ নেই যে আয়নাবাজি দেখেনি!
মানুষের চিরাচরিত এই প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করা যায় স্নোবল ইফেক্টের সাহায্যে। শুরুতে যে জিনিসের সম্ভাবনা একদম শূন্য মনে হবে, এবং একদমই ন্যূনতম পর্যায় থেকে যাত্রা শুরু করবে, দিনশেষে দেখা যাবে সেটিই বিশালাকার ধারণ করেছে।
স্নোবল ইফেক্টের প্রয়োগ দেখা যায় সমাজবিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে, মনোবিজ্ঞানে, গবেষণা কাজে, এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই!
‘স্নোবল ইফেক্ট’ নামকরণ কেন?
অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন, এত কিছু থাকতে এই তত্ত্বের নাম ‘স্নোবল ইফেক্ট’ কেন? সমস্যা হলো, আমাদের দেশে তুষারপাত হয় না। নতুবা অনেক আগেই আপনারা বিষয়টি ধরে ফেলতে পারতেন।
যা-ই হোক, কল্পনা করুন আপনি পশ্চিমা বিশ্বের কোনো একটি দেশে বাস করেন, আর সেখানে সারারাত ধরে প্রচুর তুষারপাত হয়েছে। সকালে উঠে আপনার মন চাইলো, একটু তুষার দিয়ে খেলি তো! যে-ই ভাবা সেই কাজ। আপনি বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। সামান্য তুষার হাতে তুলে নিয়ে ছোট্ট বলের মতো একটি গোলক বানালেন, ইংরেজিতে যেটিকে বলে স্নোবল। এবার সেই স্নোবলটি ঢালু কোনো জায়গা থেকে ছেড়ে দিলেন।
সেটি গড়াতে গড়াতে নীচে সমতল কোনো জায়গায় গিয়ে থামলো। এবার আপনি সেই সমতল জায়গায় গিয়ে কী দেখবেন? দেখবেন স্নোবলটি আকারে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আপনি ক্ষুদ্রাকৃতির যে স্নোবল উপর থেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, গড়িয়ে আসার সময় পথিমধ্যে সে আরও অনেক তুষার নিজের গায়ে জড়িয়ে এখন বৃহদাকৃতি ধারণ করেছে।
তার মানে দাঁড়ালো, শুরুতে যে স্নোবলের আকৃতি ছিল এই এতটুকুন, সেটিই সময়ের সাথে সাথে অনেক বড় হয়ে গেছে। এভাবে একদম ন্যূনতম অবস্থা থেকে সময়ের ব্যবধানে কোনো জিনিসের বিশাল কিছুতে পরিণত হওয়ার নামই হলো ‘স্নোবল ইফেক্ট’।
শুরুর উদ্দীপকে যেমনটা বলা হয়েছিলো, শুরুতে কেউ হাত তুলতে রাজি হচ্ছিলো না। অথচ পরে একসময় মাত্র একজন সাহস করে হাত তুলতেই একপর্যায়ে গোটা ক্লাসের সকলে হাত তুলে বসলো।
আগেই বলা হয়েছে, দৈনন্দিন জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই স্নোবল ইফেক্টের বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায়। তেমনই কিছু উদাহরণ এখন তুলে ধরা হবে আপনাদের সামনে।
শরীরচর্চায়
আপনার শরীরে প্রচুর মেদ জমে গেছে। শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের বাড়তি মেদ নিয়ন্ত্রণে না আনলে চলছেই না। তাই সবার উপদেশ মোতাবেক এক শীতের সকালে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমদিনই প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটলেন আপনি। যে আপনি দিনে দশ মিনিটও হাঁটেন না, সেই আপনিই প্রথম দিনে টানা দুই ঘণ্টা হেঁটে ফেলেছেন! আপনি তো বেজায় খুশি। আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছেন। এভাবে স্রেফ এক সপ্তাহ হাঁটলেই আপনার মেদ সব উধাও হয়ে যাবে। সিনেমার নায়কদের মতো ফিট হয়ে যাবেন আপনি।
এরকম সাত-পাঁচ চিন্তা করতে লাগলেন আপনি। কিন্তু সময় যত এগোতে লাগল, সারা শরীরজুড়ে অসহ্য ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন আপনি। বিশেষ করে দুই পায়ে এত বেশি ব্যথা অনুভূত হতে লাগল যে স্বাভাবিক হাঁটাচলাই অসম্ভব হয়ে পড়ল আপনার জন্য। আর হবে না-ই বা কেন, বলুন! প্রথমদিনেই এত পরিশ্রম কি সহ্য করতে পারে কারও শরীর? যে ব্যক্তি দিনে দশ মিনিটও হাঁটে না, সে কী করে টানা দুই ঘণ্টা হেঁটেও সুস্থ-স্বাভাবিক থাকবে? বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তাই তো প্রথমদিন দুই ঘণ্টা হেঁটে ফেলার পর এক সপ্তাহ আপনি আবারও মর্নিং ওয়াকে যাওয়া তো দূরে থাক, স্বাভাবিকভাবে পা-ই ফেলতে পারলেন না।
এবার চলুন নিজেদের চিন্তাধারাকে একটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করি। প্রতিদিন আপনি গড়ে দশ মিনিট হাঁটেন, তাই তো? তাহলে প্রথমদিন মর্নিং ওয়াকে গিয়ে যদি আপনি সেই দশ মিনিটই হাঁটতেন, তাহলে তাতে কি আপনার শরীরে কোনো বাজে প্রভাব পড়তো? পড়তো না। এভাবে দিন কয়েক যাওয়ার পর আপনার শরীর যখন মর্নিং ওয়াকের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে, তখন যদি আপনি পনেরো মিনিট হাঁটা শুরু করেন, সেটি কিন্তু আপনার শরীরে ঠিকই সয়ে যাবে। এভাবে কিছুদিন পনেরো মিনিট হাঁটার পর একদিন যদি বিশ মিনিট হাঁটেন, সেটিও কিন্তু আপনার শরীর বেশ ভালোভাবেই সহ্য করতে পারবে।
এভাবে কয়েকদিন বিশ মিনিট হাঁটার পর ত্রিশ মিনিট… এরপর একদিন চল্লিশ মিনিট… এরপর এক ঘণ্টা… তারপর এক ঘণ্টা বিশ মিনিট… পরবর্তীতে এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট… এবং সবশেষে দুই ঘণ্টা…। এভাবে আপনি যদি একটি পদ্ধতিগত উপায়ে এগোতন, তাহলে একদিন ঠিকই কোনো প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই টানা দুই ঘণ্টা হাঁটার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন। এবং এভাবে একসময় আপনার শরীরও নিজের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
অর্থনীতিতে
এবার আরেকটু গুরুগম্ভীর আলোচনায় ঢোকা যাক। স্নোবল ইফেক্টের প্রয়োগ এখন আমরা দেখবো কম্পাউন্ডিং মুনাফা শক্তির ক্ষেত্রে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতে, “The most powerful force in the world is compound interest“।
মনে করুন, আপনার হাতে এক ডলার রয়েছে। সেই এক ডলার আপনি বিনিয়োগ করলেন দৈনিক এক শতাংশ কম্পাউন্ড মুনাফায়। পাঁচ বছর পর মুনাফাসহ আপনার বিনিয়োগকৃত অর্থের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৭ মিলিয়ন ডলারে। এবং বছর সাতেকের মধ্যেই আপনি পরিণত হবেন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে!
না, বাস্তব দুনিয়ায় এ ধরনের কমপাউন্ড মুনাফার কোনো অস্তিত্ব নেই। এমন কোনো বাণিজ্যিক খাতই নেই যেখানে আপনাকে দৈনিক এক শতাংশ কমপাউন্ড মুনাফা দেবে। তবে বাস্তবিকই এক জায়গায় কম্পাউন্ড সম্পদের দেখা মেলে। সেটি হলো স্টক মার্কেট। সেখানে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে বার্ষিক বিভিন্ন হারে কম্পাউন্ড মুনাফা পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা বলতে পারি ওয়ারেন বাফেটের কথা, যার সম্পদের পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন ডলার। তার এই সুবিশাল সম্পদের সিংহভাগই এসেছে সময়ের সাথে সাথে স্নোবল ইফেক্টের উপর ভর করে।
বাফেট এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ কম্পাউন্ড করেছেন নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে। যেমন-
- শেয়ারহোল্ডার-বান্ধব বাণিজ্যে
- শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সুবিধা রয়েছে এমন ক্ষেত্রে
- ন্যায্য বা এর চেয়ে উচ্চমূল্যের বাণিজ্যে
আরও একটি উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি কোকা কোলার কথা। ১৯৯০ সালে এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কোমল পানীয়ের ব্র্যান্ড, যাদের ঝুলিতে ইতিমধ্যেই জমা হয়ে গিয়েছিল ৯৮ বছর ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা। অথচ সেই সময়ে কোকা কোলায় প্রতি ১ ডলার বিনিয়োগের মূল্যমান ২০১৫ সালে এসে লভ্যাংশসহ দাঁড়িয়েছিল ১৫.২৫ ডলারে। অর্থাৎ ২৫ বছরে বার্ষিক ১১.৫০% কম্পাউন্ড মুনাফা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি! আর এই সব কিছুরই পেছনে ছিল স্নোবল ইফেক্টের ভূমিকা।
মনোবিজ্ঞানে
শেষ করা যাক মনোবিজ্ঞানে স্নোবল ইফেক্টের প্রয়োগ দিয়ে। ধরুন, আপনি খুবই অন্তর্মুখী একজন ব্যক্তি। সামাজিকীকরণে, অর্থাৎ মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আপনার মনে একধরনের ভীতি কাজ করে। শুরুতে হয়তো এই ভীতি খুব একটা জোরালো ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা চরম আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে স্নোবল ইফেক্ট কাজ করেছে।
এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও কিন্তু স্নোবল ইফেক্ট বিশেষ সহায়ক হতে পারে। মানুষের সাথে মেশা আপনার পক্ষে কঠিন হতে পারে ঠিকই, কিন্তু একটা দিন যদি আপনি মনের যাবতীয় সাহস একত্র করে কোনো ব্যক্তির সাথে মন খুলে কথা বলতে পারেন, তাহলে কিন্তু আপনার মনের ভীতি অনেকাংশেই কেটে যাবে। তখন চাইলেই আপনি পরবর্তী সময়েও ঐ ব্যক্তির সাথে কোনোপ্রকার দ্বিধা বা সংকোচ ছাড়াই যোগাযোগ ও ভাবের আদানপ্রদান ঘটাতে পারবেন।
অনুরূপ আরেকটি উদাহরণ দিই। একাডেমিক ক্ষেত্রে তো সবাইকেই কম-বেশি অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে হয়। তো এই অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শুরু করার আগে সব শিক্ষার্থীই কম-বেশি মানসিক চাপ অনুভব করতে থাকে। তার মনে বারবার উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয় যে, এবার হয়তো সে ঠিকঠাক অ্যাসাইনমেন্টটি করতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত সে এর কাজে হাত না দেবে, ততক্ষণ কিন্তু এই উৎকণ্ঠা মনের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকবে। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, সেটি দূর হবে না। কিন্তু একবার অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শুরু করে দিলেই দেখা যায় সব উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেছে। তরতর করে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষার আগের রাতে যে আমরা তুমুল বেগে পড়া শুরু করি, কিংবা ডেডলাইনের আগেরদিন সন্ধ্যায় অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শুরু করি, এবং উভয়ক্ষেত্রেই মোটামুটি সফলতার সাথেই উৎরে যাই, তা কিন্তু স্নোবল ইফেক্টেরই কল্যাণে। কোনো কাজ শুরু করার আগপর্যন্ত কঠিন। কিন্তু একবার মনে জোর এনে কাজটি শুরু করলে তা শেষ হবেই হবে, এবং বেশ ভালোভাবেই হবে।
শেষ কথা
মূলত স্নোবল ইফেক্টের স্নোবল অনেকটা ছোট ছোট বালুকণা কিংবা বিন্দু বিন্দু জলের মতোই। শুরুতে তাকে যতই তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, নগণ্য বলে মনে হোক না কেন, একসময় সেটি থেকেই গড়ে ওঠে মহাদেশ কিংবা অতল সাগর। তাই স্নোবল ইফেক্টকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই!
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/