১৯৮৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মেক্সিকোতে অনুভূত ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সেখান থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে। সেদিন সকালবেলাতেই প্রথম ভূকম্পন হয় যার মাত্রা ছিল ৮.১। এরপর যে আফটার শক বা কম্পন হয় তার মাত্রা ছিল ৭.৫। কিন্তু কম্পন তরঙ্গটি মেক্সিকো পর্যন্ত আসায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখা দেয়। ব্যাপারটি একটু আশ্চর্যের। কারণ ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল থেকে তরঙ্গ যত দূর পর্যন্ত ছড়াতে থাকে, তরঙ্গটি তত দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু মেক্সিকো থেকে এত দূরে তৈরি হওয়া কম্পনটি দেশটির একটি অংশের এত বড় ক্ষতি করে ফেলবে সেটা কেউ ভাবেনি [১]। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ভূমিকম্পের ফলে মাঝারি উচ্চতার দালানগুলো ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু এর থেকে নিচু এবং উঁচু দালানগুলোর কোনো ক্ষতিই হয়নি। এমন ঘটনা ঘটার কারণ কী?
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, এই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল অনেক। কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শুধু তীব্রতার উপর নির্ভর করে না। ভূমিকম্প যে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে সেই এলাকায় অবস্থান করার সময় কম্পনটির তীব্রতা কেমন ছিল সেটা মাথায় রেখেই সাধারণত হিসাবনিকাশ করা হয়। আবার এই কম্পনের তীব্রতা সেই জায়গার পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের উপরও নির্ভর করে।
মেক্সিকোতে অনুভব হওয়া এই ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার কথা ছিল। তার কারণ, এর উৎপত্তিস্থল ছিল অনেক দূরে। সেখান থেকে কম্পন তরঙ্গ আসতে আসতে দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অনুসন্ধান করার দরুন এটা প্রমাণিত হয় যে, তরঙ্গটি আসতে আসতে দুর্বল হয়েই পড়েছিল। কিন্তু মেক্সিকো যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে, সেই মাটি ছিল অনেক প্রাচীন হ্রদের অংশ যা তখনও পর্যন্ত নরম মাটিতে ভরা ছিল [২]। ভূমিকম্পের তরঙ্গটি যখনই এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, প্রায় সাথে সাথেই সেই তরঙ্গের শক্তি অনেক গুণ বেড়ে যায়। কারণ, নরম মাটিতে তরঙ্গের বিস্তার বেড়ে যায় আর বিস্তার বেড়ে যাওয়া মানে তরঙ্গের শক্তি বেড়ে যাওয়া যা মাটির কণাগুলোকে প্রভাবিত করে।
আবার কম্পন তরঙ্গ নরম মাটির কিছু কিছু স্থানে প্রতিফলিত হয়। সেই স্থানের উপরের মাটি এবং নীচের দিকে শক্ত মাটির মধ্যে এই প্রতিফলন ঘটতে থাকে। এভাবে তরঙ্গ উপরিস্থাপনের (Superposition) কারণে তরঙ্গগুলো একে অপরকে শক্তিশালী করে তোলে। যার ফলে মাটির কণাগুলো অনেক বেশী পরিমাণে গতিশীল হয়ে পড়ে এবং প্রবাহিত হতে থাকে। কণাগুলোর এই প্রবাহের কারণে যে ত্বরণের উৎপত্তি হয়, মেক্সিকোতে তা ছিল অভিকর্ষজ ত্বরণের প্রায় ০.২০ গুণ এবং কম্পন ছিল ০.৫ হার্জ অর্থাৎ ১০ সেকেন্ড পরপর সেখানকার মাটি স্পন্দিত হচ্ছিলো। এই উপাত্ত থেকে ধারণা করা যায় কতক্ষণ যাবত মেক্সিকো কম্পন অনুভব করছিলো। অর্থাৎ স্পন্দনের পর্যায়কাল ছিল অনেক বেশি।
অদ্ভুত হলেও সত্য যে, সেখানকার মাঝারী উচ্চতার দালানগুলোর স্বাভাবিক স্পন্দিত কম্পনও (Natural Oscillating Frequency) ছিল ০.৫ হার্জ। অর্থাৎ ভূমিকম্পনটি হবার সময় অনুরণনের (Resonant Frequency) কারণে মাঝারী উচ্চতার দালানগুলো ভেঙে যায়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার দালানগুলো, যাদের অনুরণন ০.৫ হার্জের বেশি এবং তার চেয়েও ছোট দালানগুলোর যাদের অনুরণন ০.৫ হার্জের কম ছিল, সেসব দালানের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি [৩]।
অনেকটা এরকমই আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিলো ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড সিরিজ চলাকালে। সেদিন ছিল সিরিজের তৃতীয় খেলা। মাঠে খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.১। লোমা প্রিয়েটা নামক ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি স্থান থেকেই ভূকম্পনটির উৎপত্তি। এই ভূমিকম্পের ফলে শহরটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এর ফলে ৬৭ জন মানুষ মারা যায়। সে সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ভূমিকম্পটি নিয়ে বেশ খবর তৈরি হয় এবং ছবি হিসেবে প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমেই নিমিৎস ফ্রিওয়ের একটি ধ্বসে যাওয়া রাস্তার চিত্র ব্যবহার করা হয়।
আমেরিকা, জাপান সহ বিভিন্ন দেশের হাইওয়েগুলোকে ফ্রিওয়ে বলা হয়ে থাকে। এই ফ্রিওয়ের যে অংশটি ধসে পড়েছিল সেটা ছিল একটি দ্বিতল উড়াল সড়ক (Double Decker Elevated Freeway)। উড়াল সড়কের প্রতিটি স্প্যান ছিল হুবহু একে অপরের অনুরূপ। কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে সড়কটির একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উপরের ডেক নিচের ডেকের উপর পড়ে যায়। ফলে কয়েকজন মানুষ ভিতরে আটকা পড়ে যান [৪]।
এখানে একটি কথা অনস্বীকার্য যে, ভূকম্পনের দরুন প্রচণ্ড ঝাঁকুনির ফলেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অন্যান্য অংশে কোনো ক্ষতি না হয়ে শুধুমাত্র এই একটা অংশে কেন ক্ষতি হলো? এটা বিজ্ঞানীদেরও ভাবিয়ে তুলেছিল। যেহেতু ভূকম্পের তীব্রতা প্রতিটি স্প্যানের উপর দিয়েই গিয়েছে, তাহলে অন্য স্প্যানগুলোর ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু ক্ষতি হলো শুধুমাত্র একটির। এমন হওয়ার কারণ কী?
ভূমিকম্পের ফলে এরকম ক্ষতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার খুব গুরুত্বের সাথে অনুসন্ধানে নেমে পড়ে। বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। এর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ছিল অনেকটা এগিয়ে। এই ভূমিকম্পের ফলে ভবন এবং ব্রিজ নির্মাণখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে ভবন এবং ব্রিজের ডাইনামিকস, রেট্রফিটিং ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর গবেষণা পরবর্তীতে আরও উন্নত হয়।
৭.১ মাত্রার এই ভূমিকম্পটি বেশ শক্তিশালী ছিল। মূলত সানআন্দ্রিয়াস ফল্ট লাইনের কারণে এই কম্পনটির সৃষ্টি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯০৬ সালেও একই অঞ্চলে অনেক বড় একটি ভূমিকম্প হয়, যে কারণে বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই এই অঞ্চল নিয়ে সতর্ক ছিলেন। সেই কারণে ভূমিকম্প প্রবণ এই স্থানে ১৯৮৯ সালে অনেকগুলো Accelerometer বসানো হয়। ফলে সেই বছর ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প তরঙ্গের ত্বরণ এবং বিস্তারের লেখচিত্র পাওয়া গিয়েছিল।
সেখান থেকে পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে হলেও এই জায়গাতে কম্পন তরঙ্গের বিস্তার (Amplitude) বেড়ে যায়। বিস্তার বেড়ে গেলে তরঙ্গের শক্তিও বেড়ে যায়। ফলে এই শক্তি যে বস্তুর উপরই প্রয়োগ করা হোক না কেন তার বেশী বিচ্যুতি ঘটে। নিমিৎস ফ্রিওয়ের ধ্বসে যাওয়া অংশটির মাটি ছিল কাদাযুক্ত মাটি। মাটির কণাগুলো ছাড়া ছাড়া বা আলগাভাবে ছিল, শক্ত ছিল না। এই ধরনের মাটিতে প্রকৌশলীয় কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ করে সঠিকভাবে ভিত্তি (Foundation) স্থাপন করে যেকোনো কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব।
কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে মাটির কণাগুলোর মধ্যে ঝাঁকুনি বেশি হওয়ায় কণাগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এই দূরে সরে যাবার কারণে সে জায়গাটিতে তরল অবস্থার তৈরি হয় যা প্রবাহিত হতে থাকে। এই অবস্থাকে লিকুইফেকশন (Liquefaction) বলে। এই ধরণের মাটিতে সিসমিক তরঙ্গের প্রভাব অনেক বেশি। একটি সিসমিক তরঙ্গ থেকে পাওয়া শক্তির কারণে নরম মাটির কণাগুলো যে গতি প্রাপ্ত হয় তা শক্ত মাটির তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি। তাই প্রচণ্ড কম্পনের কারণে ফ্রিওয়ের উপরের ডেক নিচের ডেকের উপর পড়ে যায় এবং প্রায় ৪৭ জন মোটর চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের তরঙ্গকে Forced Oscillation বলে [৫]।
উপরের দুটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দুটি ভূমিকম্পের ফলে যে ক্ষতি হয় তা মূলত ভূকম্পনের সাথে সাথে মাটির কণার প্রভাবের কারণে ঘটে। তার মানে এই নয় যে, অনেক বড় ভূমিকম্প হলেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভূমিকম্পের তীব্রতা ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। তাই সঠিকভাবে বিল্ডিং কোড মেনে, দালান বা ব্রীজ নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করে, ভালো উপাদান ব্যবহার করে যেকোনো কাঠামো নির্মাণ করা উচিত। আমাদের দেশও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। তাই কোনো কাঠামো নির্মাণের আগে অবশ্যই কাঠামোর স্ট্যাটিক হিসাবনিকাশ করার পাশাপাশি ডাইন্যামিক হিসাবনিকাশের উপরও জোর দেয়া উচিত। দেশের ছোট-বড় প্রতিটি কাঠামোর জন্য এই দু’ধরনের হিসাব করা নিরাপত্তার জন্য অনেক জরুরি।
তথ্যসূত্র:
[১] Popov, E. P. (1987) Observations on the Mexico earthquake of 19 September 1985, Engineering Structures, 9, No. 2, 74-83
[২] Rosenblueth, E. (1986) The Mexican earthquake: a firsthand report, Civil Engineering, ASCE, 56, No. 1, 38-40
[৩] Flores, J., O. Novaro, and T. H. Seligman (1987). Possible resonance effect in the distribution of earthquake damage in Mexico City, Nature, 326, 783-785
[৪] Feldman, B. J. (2004) The Nimitz Freeway collapse, Physics Teacher, 42, 400-402
[৫] Hough, S. E., P. A. Friberg, R. Busby, E. F. Field, K. H. Jacob, and R. D. Borcherdt (1990) Sediment-induced amplification and the collapse of the Nimitz Freeway, Nature, 344, 853-855