
It just says click – and the molecules are coupled together
নোবেল কমিটির প্রেস রিলিজের এই একটি বাক্যই যেন ২০২২ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কারের সারমর্ম। এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ক্যারোলিন আর. বার্টোজি, মর্টেন মেলডাল এবং কে. ব্যারি শার্পলেস। ক্লিক রসায়ন এবং বায়োঅর্থোগোনাল রসায়নে অবদানের জন্য তাদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
রসায়নবিদরা সবসময়ই জটিল কোনো জৈব রাসায়নিক অণু স্বল্প সময়ে ও সহজভাবে তৈরির পন্থা অবলম্বন করতে চান। কিন্তু খুব কম সময়ই পরিকল্পনা অনুযায়ী ফলাফল পাওয়া যায়। ধাপে ধাপে পরিচালিত এসব বিক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত উৎপাদের পাশাপাশি ক্ষতিকর উপজাত হিসেবে তৈরি হয় নানা রাসায়নিক বর্জ্য। তাই এ প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন সময় অনেক বেশি প্রয়োজন, তেমনি আর্থিক দিক দিয়েও তা লাভজনক নয়। আর এজন্যই দরকার এমন একটি বিক্রিয়া যা খুব সহজেই স্বল্প সময়ে দরকারি উৎপাদ পেতে সাহায্য করবে।
ঠিক এই জায়গাতেই ‘ক্লিক’ করে গেছে ‘ক্লিক রসায়ন’। এখানে কাঙ্ক্ষিত জটিল উৎপাদের উপাদানগুলো ভাগে ভাগে বানিয়ে ফেলতে হবে আগে। এরপর উপাদানগুলো একসঙ্গে রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জোড়া দিলেই হলো! শত শত বিক্রিয়কের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত দুজনের মিলনের ফলে তৈরি হয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত সেই উৎপাদ। ব্যারি শার্পলেস ও মর্টেন মেলডালের হাত ধরে এ প্রক্রিয়া ‘ক্লিক রসায়ন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে ঔষধশিল্প, ডিএনএ ম্যাপিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। অন্যদিকে, ক্যারোলিন বার্টোজি এই ক্লিক রসায়নকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। জীবদেহের কোনো ক্ষতি ছাড়াই জীবকোষে ক্লিক বিক্রিয়া ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বায়োঅর্থোগোনাল এ বিক্রিয়ার দ্বারা ক্যানসার চিকিৎসা অনন্য এক মাত্রা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ক্লিক রসায়ন
আঠারো শতকে আধুনিক রসায়নের জন্মের পর থেকেই রসায়নবিদগণ প্রকৃতির পথ অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। কেননা, বিভিন্ন উদ্ভিদ, অণুজীব কিংবা প্রাণীদেহেই যে প্রকৃতির সবচেয়ে জটিল রাসায়নিক অণুগুলো পাওয়া যায়। আর ঔষধশিল্পে এসব রাসায়নিকের জুড়ি মেলা ভার। তাই বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে সবসময়ই কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক রাসায়নিক অণুগুলো তৈরির চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আধুনিক সব কৌশল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা অবশ্য সফলতার মুখ দেখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু ঝামেলা এখনও পিছু ছাড়েনি। একের পর এক ধাপে এসব বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার ঝামেলা যেমন আছে, তেমনি প্রধান উৎপাদের পাশাপাশি উৎপাত হিসেবে দেখা দিয়েছে নানা রাসায়নিক বর্জ্য।
এতে সময়ের অপচয়ের সাথে আর্থিক ক্ষতির ব্যাপারটাও সামনে এসে পড়ে। আর তাই বিজ্ঞানীরা চেয়েছেন সহজ কিছু। এই সহজ কিছুর প্রণালী নিয়েই হাজির হয়েছিলেন একজন। ২০০১ সালে রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের একজন ব্যারি শার্পলেস যেন জানান দিলেন, “এখনও ফুরিয়ে যাইনি।আরেকটি নোবেল জয়ের ফর্মুলা আমি ইতোমধ্যেই বের করে ফেলেছি!” কাইরাল প্রভাবক ব্যবহার করে জারণ ঘটানোর উপায় আবিষ্কারের জন্য প্রথম নোবেলটি পান ড. ব্যারি শার্পলেস।
২০০০ সালের দিকে সহজভাবে স্বল্প সময়ে জটিল সব বিক্রিয়া ঘটানোর উপায় নিয়ে হাজির হন তিনি। কার্বন পরমাণুর বন্ধন গঠনের উদাসীনতাকে পাশ কাটিয়ে তিনি এমন কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু তৈরি করলেন, যাদের মধ্যে কার্বন কাঠামো বিদ্যমান। কৃত্রিমভাবে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক অণুটি যদিও তিনি তৈরি করতে পারেননি, তবে যা তৈরি করলেন তা দিয়ে অনায়াসেই ঐ প্রাকৃতিক অণুর কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। তিনি এই প্রক্রিয়ার নাম দিলেন ক্লিক রসায়ন। ক্লিক বিক্রিয়ার কিছু শর্তও আরোপ করে দিলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে- অবশ্যই বিক্রিয়াটি পানি ও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে হতে হবে। এভাবে স্বল্প মূল্যে সহজভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু থেকে বৃহৎ পরিসরে ক্লিক রসায়নকে কাজে লাগানোর চিন্তা করলেন তিনি। তবে বিশ্বব্যাপী গবেষকদের কেউই তখনও ক্লিক রসায়নের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হতে পারেননি!
‘আদর্শ’ ক্লিক রসায়ন
ক্লিক রসায়ন যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনও মর্টেন মেলডাল জানতেন না যে তার হাত ধরেই এ ক্লিক রসায়ন পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। ডেনমার্কের একটি পরীক্ষাগারে চলছে নানা রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া। মেলডাল তখন ঔষধ আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। নিজের তৈরি হাজার হাজার বিক্রিয়কের ‘আণবিক লাইব্রেরি’ থেকে একটির সাথে অপরটি মিশিয়ে দেখছিলেন তিনি। ঠিক কোন অণু দিয়ে রোগসৃষ্টির প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়া যায়- সেটাই বের করতে চাইছিলেন যেন। এমন একদিন অ্যালকাইন অণুর সাথে অ্যাসাইল হ্যালাইডের বিক্রিয়া ঘটাতে চাইলেন ড. মেলডাল। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? বিক্রিয়া পাত্রে অনুঘটক হিসেবে কপার ঢালতে ঢালতে আশ্চর্য চোখে লক্ষ্য করলেন- অ্যাসাইল হ্যালাইডের অপরপাশে যুক্ত অ্যাজাইড কার্যকরী মূলকের সাথে অ্যালকাইন যুক্ত হয়ে তৈরি করছে ট্রায়াজল। এ যেন ভুল থেকেই দারুণ কিছু!

ঔষধ ও রঞ্জক শিল্প এবং কৃষি কাজে এই ট্রায়াজলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা তাই পূর্বে অ্যালকাইন ও অ্যাজাইডের সাথে বিক্রিয়া ঘটিয়ে ট্রায়াজল তৈরির বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অবশেষে এভাবে ট্রায়াজল পাওয়া গেল উপজাত দ্রব্য হিসেবেই! এখানে একটি দ্রব্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে- কপার। আর এখানেই ক্লিক রসায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিক্রিয়াটি আবিষ্কার হলো “Copper catalysed azide-alkyne cycloaddition.”
এ বিক্রিয়া এত পরিমাণে বিক্রিয়ক নির্দিষ্ট যে- যেকোনো দুটি বিক্রিয়ককে যুক্ত করতে চাইলে বিক্রিয়ক দুটির দুই প্রান্তে অ্যালকাইন ও অ্যাজাইড অণু যোগ করে দিলেই কাজ শেষ। কপারের উপস্থিতিতে চট করে তারা জোড়া লেগে যাবে। এ যেন এক ক্লিকেই সমাধান! ঔষধ শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হিসেবে ধরা দিলো এই ক্লিক রসায়ন। ২০০২ সালে এ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন মর্টেন মেলডাল। একই বছর এই কাজে ব্যারি শার্পলেসও সফল হলেন পৃথকভাবে। তিনিও গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। ক্লিক রসায়ন যেন তার প্রতিষ্ঠাতার সংস্পর্শে থেকেই ‘আদর্শ’ মাত্রা পেতে চাইল!
বায়োঅর্থোগোনাল রসায়ন
ব্যারি শার্পলেস ও মর্টেন মেলডালের হাত ধরে পরিচিতি পেয়েছে যে ক্লিক রসায়ন, সেটাকেই এবার ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহার করলেন ক্যারোলিন বার্টোজি। বিশ শতকের শেষ দিকে যখন প্রাণ রসায়ন ও মলিকুলার বায়োলজি অবিশ্বাস্যরকম উন্নতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন বিজ্ঞানীরা কোষে প্রোটিন ও জিন ম্যাপিংয়ের সাহায্যে কোষের কার্যবিধি খেয়াল করছিলেন নিবিষ্টচিত্তে।
তবে তখনও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে গিয়েছিল ‘গ্লাইক্যান’। গ্লাইক্যান একধরনের শর্করা যা সাধারণত কোষের পৃষ্ঠে অবস্থান করে। দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হলে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যারোলিন বার্টোজি এই গ্লাইক্যানকেই কাজে লাগিয়ে দারুণ কিছু উদ্ভাবনের স্বপ্ন দেখলেন। এ কাজে তার দরকার হলো এমন এক রাসায়নিক অণুর যা কোষের অভ্যন্তরে গ্লাইক্যানের সাথে কোনো ফ্লুরোসেন্টকে যুক্ত করবে, অথচ কোষের অন্যান্য কাজে কোনো ক্ষতি করবে না। পরে ফ্লুরোসেন্টের আলো দেখে গ্লাইক্যানের গতিবিধি লক্ষ্য করা যাবে। তার এ কাজে সহায়তা করতে পারে এমন গবেষণাপত্র নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলেন তিনি। অবশেষে পেয়েও গেলেন- ‘অ্যাজাইড’ই সেই কাঙ্ক্ষিত কিছু যা তাকে সাহায্য করতে পারে।

এখানেই থেমে থাকেননি ড. বার্টোজি, ভাবলেন- জীবজগৎকে এই অ্যাজাইডের এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। এখানেই আসে ক্লিক বিক্রিয়ার প্রসঙ্গ। এবার ক্লিক বিক্রিয়াকে জীবদেহে কাজে লাগাতে চাইলেন তিনি। কিন্তু জীবকোষের জন্য কপার খুবই বিষাক্ত। তাই কপারের অনুপস্থিতিতে অ্যাজাইড ও অ্যালকাইনের সাহায্যে কীভাবে জীবকোষে ক্লিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়- সেটিই এখন ভাবনার বিষয়।
আরও একবার গবেষণাপত্রের সমুদ্রে ডুব দিলেন ক্যারোলিন বার্টোজি।
এবারও সফল হলেন তিনি, দেখলেন- অ্যালকাইনকে যদি একটি চক্রাকার রূপ দেওয়া যায়, তাহলে কপারের অনুপস্থিতিতেও কোনো প্রকারের ক্ষতি ছাড়া জীবদেহের অভ্যন্তরে ক্লিক বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব। ২০০৪ সালে এ বিষয়ে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করলেন তিনি। জীবদেহের অভ্যন্তরের পরিবেশকে প্রভাবিত না করে ক্লিক বিক্রিয়া সংঘটনের দারুণ এক প্রক্রিয়া তৈরি হয়ে গেল। জীবদেহের অভ্যন্তরে সার্বিক এ প্রক্রিয়ার জন্য তিনি ‘বায়োঅর্থোগোনাল’ টার্মটি ব্যবহার করলেন।

ড. বার্টোজির উদ্ভাবিত এই ‘বায়োঅর্থোগোনাল’ বিক্রিয়ার সাহায্যে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা নিখুঁতভাবে কোষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন। এর সাহায্যে ক্যানসারের চিকিৎসায় ঔষধও তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা, যা এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে।
কে. ব্যারি শার্পলেস, মর্টেন মেলডাল ও ক্যারোলিন আর. বার্টোজির হাত ধরে ক্লিক রসায়ন ও বায়োঅর্থোগনাল রসায়ন এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে। এ দুই বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে অনন্য কিছু উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া সবে শুরু বলা যায়।