
মানব সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত মানুষের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোর সাথে সাথে ঘটে গেছে তিনটি শিল্প বিপ্লব। লোহা, বাষ্পীয় ইঞ্জিন অথবা জীবাশ্ম জ্বালানির আবিষ্কারকে আবর্তন করে ঘটে যাওয়া এসব আধুনিকায়ন আমাদের জীবনে যতটা স্বস্তি এনে দিয়েছে, তারচেয়ে অস্বস্তির পরিমাণও কম নয়। নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী, “প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে”। সূত্রটির জাজ্বল্যমান উদাহরণ যেন এই আধুনিকতার সুফল ও কুফল।
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, বেশিরভাগ স্মার্টফোনের কোম্পানিগুলো তাদের ফোনের ব্যাটারির ধারণ ক্ষমতাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আবার বর্তমানে বাজারে যেসব ব্র্যান্ডের বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি প্রচলিত তাদের মধ্যে অন্যতম ‘টেসলা’। আমেরিকান এই গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দাবি অনুযায়ী, তাদের গাড়িগুলো ১০০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব; কারণ এতে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয় না। এই গাড়িতে ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তির ব্যাটারিগুলো একবার সম্পূর্ণ চার্জ করলেই অনায়াসে চলতে পারে ৪৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত। আপনার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ অথবা বাড়ির ছাদে লাগানো সৌর বিদ্যুতের পাওয়ার প্যানেলগুলো সবকিছুরই কার্যকারিতা শূন্য হয়ে যাবে এই ব্যাটারি ছাড়া। বলছিলাম লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির কথা। মৌলের পর্যায় সারণির তৃতীয় অবস্থানে থাকা সবচেয়ে হালকা এই ধাতুর প্রভাব বলয় যে এত বেশি হবে, তা হয়তো এর আবিষ্কারক জন অগাস্ট অর্ফায়েডসনও জানতেন না।

পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই কম-বেশি লিথিয়াম পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানীদের ধারণা দক্ষিণ আমেরিকার চিলি, বলিভিয়া এবং আর্জেন্টিনায় পৃথিবীপৃষ্ঠের ৭৫ শতাংশ লিথিয়াম মজুদ আছে। একত্রে দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলটি ‘লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গল’ নামেই পরিচিত।
১৮১৭ সালে জন অগাস্ট অর্ফায়েডসন বিভিন্ন ধরনের খনিজের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে লিথিয়াম আবিষ্কার করেন, এবং গ্রিক শব্দ ‘লিথোস’ (যার অর্থ পাথর) অনুযায়ী এর নামকরণ করেন। পর্যায় সারণিতে অ্যালকালাই ধাতুগুলোর গ্রুপে তৃতীয় অবস্থানে থাকা এই মৌলের ঘনত্ব মাত্র ০.৫৩ গ্রাম/ সেন্টিমিটার। লিথিয়ামের উচ্চ গলনাংক (যা প্রায় ১৮১০ C) এবং পজিটিভ ধনাত্মক চার্জ একে উচ্চ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারি তৈরিতে আদর্শ করে তোলে। কিন্তু অত্যধিক মাত্রায় সক্রিয়তার কারণে প্রকৃতিতে পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ রূপে এটিকে পাওয়া যায় না, বরং মাটি থেকে উত্তোলিত বিভিন্ন খনিজ লবণ পরিশোধন করে উৎপাদিত হয় এই লিথিয়াম মৌল। তবে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত লিথিয়ামের পরিমাণ এতই কম যে বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীপৃষ্ঠে অন্যান্য উপাদানের তুলনায় এর পরিমাণ মাত্র ০.০২ শতাংশ। অতএব যত বেশি পরিমাণ লিথিয়াম উৎপাদিত হবে, তত বেশি পৃথিবীপৃষ্ঠে এর পরিমাণ কমে যাবে এবং মূল্য বৃদ্ধি পাবে।

পৃথিবীপৃষ্ঠে লিথিয়ামের পরিমাণ কম হলেও লিথিয়াম উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি কিন্তু বেশ সহজ। দক্ষিণ আমেরিকার লিথিয়াম উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ লোনা পানি পাম্পের মাধ্যমে বের করে তা পূর্বনির্ধারিত সল্টবেডগুলোতে সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত হওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এই সল্টবেডগুলো ‘সালার’ নামে পরিচিত। পর্বতবেষ্টিত অঞ্চল হওয়ার কারণে প্রখর সূর্যের তাপেও এখানে বাষ্পীভবনের হার বেশ কম। ফলে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে লিথিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদনে অনেকটা সময় লাগে।
আমরা সবাই জানি, লিথিয়াম ব্যাটারিগুলো পরিবেশে কোনো দূষণ ছড়ায় না। কিন্তু ঠিক কতটা পরিবেশ বান্ধব এই লিথিয়াম তার উত্তর পাওয়া যাবে লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গলের দিকে তাকালেই।

১৯৯৭ সাল থেকে আর্জেন্টিনা তাদের লিথিয়াম উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে যেসব দেশ বৈশ্বিক বাজারে প্রধান লিথিয়াম সরবরাহকারী তাদের মধ্যে আর্জেন্টিনার অবস্থান অন্যতম। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৪৬টি প্রজেক্ট অনবরত উৎপাদন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের লিথিয়াম চাহিদার প্রায় ১১ থেকে ১৬ শতাংশ পূরণ করছে দেশটি। কিন্তু বাজারে চাহিদা অনুযায়ী লিথিয়াম সরবরাহ করতে পারলেও, স্থানীয়দের চাহিদা অনুযায়ী লিথিয়াম উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রভাব কমাতে পারছে না প্রশাসন।
Sales de jujay হলো বর্তমানে আর্জেন্টিনার অন্যতম প্রধান উৎপাদনশীল লিথিয়াম প্রজেক্ট, আর এখানেই বাস করে আদিবাসী Colla জনগোষ্ঠী। এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, আর্জেন্টিনা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন ১৬৯ এবং আদিবাসী গোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের সনদে সমর্থন করেছে। এই সনদ অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাদের ভূমির ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং এই ভূমি থেকে কোনো রকম খনিজ, পানি বা অন্যান্য উপকরণ আহরণের জন্য, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়নমূলক কাজ করতে সরকারকে স্থানীয় সমাজের সমর্থন নিতে হবে।

কিন্তু স্থানীয় জনগণের মতে, লিথিয়াম উৎপাদনের শুরুতে তাদের কোনো রকম মতামত নেয়া হয়নি। এছাড়াও কারখানাগুলো তৈরির পর তাতে স্থানীয় জনগণের কাজের সুযোগ তৈরি করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। অল্প কিছু মানুষ এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজের সুযোগ পেলেও উচ্চস্তরের কাজগুলো বেশিরভাগই করছে নিয়োগকৃত কোম্পানির বিদেশি জনবল। ফলে আর্জেন্টিনায় যেখানে বেকারত্বের উচ্চহার সেখানে বিদেশি লোকজন তাদের মাটিতে ধ্বংস করে দিচ্ছে স্থানীয় শ্রমবাজার।

এবার এই ত্রিভুজটির আরেকটি দেশ বলিভিয়ার দিকে তাকানো যাক। নানা ধরনের ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বলিভিয়া কিন্তু বরাবরই একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে বিশ্বে বিবেচিত হয়ে আসছে। চার হাজার বর্গ মাইলের Salar de Uyuni রয়েছে বলিভিয়ার। বিজ্ঞানীদের ধারণানুসারে, পৃথিবীর মোট লিথিয়ামের প্রায় ১৭ শতাংশ মজুদ রয়েছে এই সল্টবেডগুলোর নিচের লবণাক্ত পানিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বলিভিয়ার লিথিয়ামের বিনিয়োগ করতে বেশ অনিচ্ছুক। কোম্পানিগুলোর ভাষ্যমতে, বলিভিয়ার সালারগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি হওয়ায় পানিকে সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত করতে এখানে অনেকটা সময় লাগে। এছাড়াও এখানে উৎপাদিত লিথিয়ামের লবণে প্রচুর পরিমাণে বাহ্যিক পদার্থও (যেমন- কপার, সালফার, ম্যাংগানিজ) থাকে। ফলে অতিরিক্ত সময়সাপেক্ষ ও অপদ্রব্য দূর করতে যে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ তাদের করতে হয়, সে তুলনায় অন্যান্য লিথিয়ামপ্রতুল অঞ্চলে খরচ বেশ কমই বলা যায়।

ইভো মোরালেস, যিনি ২০০৬ সালে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং একটা লম্বা সময় ধরে বলিভিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন, নির্বাচিত হবার পরপরই দেশের গ্যাস, পানি, ভূমি, বিদ্যুৎ এবং খনিজ সম্পদ সব কিছুরই জাতীয়করণ শুরু করেন, যাতে কেবলমাত্র বলিভিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ফলে কাগজে-কলমে বলিভিয়ার সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ সেখানকার জনগণের হলেও বাস্তবে লভ্যাংশ জমা হতে থাকে দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসনের একাউন্টে। কিন্তু দুর্গম Salar de Uyuni থেকে লিথিয়াম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির সক্ষমতা বলিভিয়ার ছিল না। ফলে মোরালেস সরকার এক জার্মান কোম্পানির সাথে ৭০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে।
চুক্তি অনুযায়ী, কোম্পানিটি বলিভিয়ায় শুধুমাত্র লিথিয়াম কার্বনেটই নয়, বরং লিথিয়ামজাত বিভিন্ন পণ্যও উৎপাদন করবে। কিন্তু ২০১৯ সালে সেখানকার অধিবাসীরা লিথিয়াম লভ্যাংশের অংশীদারিত্ব ৩ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে সরকার কোম্পানিটির সাথে চুক্তি বাতিলে বাধ্য হয়। সপ্তাহখানেক বাদে এক আকস্মিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মোরালেস পদত্যাগ করেন ও দেশ থেকে পালিয়ে যান।

এছাড়াও লিথিয়াম উৎপাদনের সময় উৎপন্ন প্রচুর পরিমাণে অপরিশোধিত ম্যাগনেসিয়াম বর্জ্যের দূষণ এবং ক্রমাগত ভূগর্ভের পানি উত্তোলন ল্যান্ডলকড (Landlocked) এই দেশটির লিথিয়াম করছে অভিশপ্ত।
লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গলের আর্জেন্টিনা এবং বলিভিয়া যখন আমদানিকারকদের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ, তখন চিলি কিন্তু তাদের ব্যবসায়িক নীতিগুলোকে সুন্দরভাবে বিন্যাস্ত করে নিয়েছে; শুধুমাত্র বেশি মূলধনের কোম্পানিগুলোকে নয়, বরং ছোট কোম্পানিগুলোকেও ব্যবসার সুযোগ দিয়েছে। ফলে চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদক কোম্পানিগুলোর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায় চিলি। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশটি নিজেদের সম্পদ ও তা থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের মতো করে যেন পুরোপুরি অভিযোজিত। তাই তো টেসলা বা বিএমডব্লিউ এর দৃষ্টি এখন চিলির ওপর। এছাড়াও চিলির ভৌগলিক অবস্থান এবং শুষ্ক মরুভূমি লিথিয়াম উৎপাদনের পরিবেশগত ঝুঁকিকে হ্রাস করেছে। ফলে লিথিয়াম বাজারে সর্বোচ্চ সম্পদ না থাকলেও সঠিক নীতির মাধ্যমে চিলি এখন সর্বোচ্চ লিথিয়াম রপ্তানিকারক।

নব্বইয়ের দশকে আমরা যারা বড় হয়েছি, সবাই সেসময়ে বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্যাটারির সাথে কম-বেশি পরিচিত। খেলনা থেকে শুরু করে টিভির রিমোট অথবা ঘড়ি সবখানেই থাকত সেসব ব্যাটারি। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ক্রমেই তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কারণ, লিথিয়াম ব্যাটারি আকারে ছোট হলেও তা অনেক বেশি পরিমাণে বৈদ্যুতিক চার্জ ধারণ করে রাখতে সক্ষম এবং একবার চার্জ শেষ হয়ে গেলে একে পুনরায় চার্জ করা যায়। ২০২৫ সাল নাগাদ এই লিথিয়ামের চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে চাহিদা পূরণে উৎপাদনশীল দেশগুলোর চাহিদার দিকেও নজর রাখতে হবে। কারণ, লিথিয়াম যত উৎপাদিত হবে ততই এর পরিমাণ কমবে। ফলে দরিদ্র এই দেশগুলোর যে বৈশ্বিক সম্পদ আছে তা রক্ষার দায়ভার আমাদের সবার।