Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানব কল্যাণে লুই পাস্তুরের কিছু গবেষণা

বিয়ে উপলক্ষ্যে বিশাল আয়োজন। পাত্র ও পাত্রীপক্ষের সবাই উপস্থিত। উপস্থিত নেই শুধু বর। বরের জন্য অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না। হঠাৎ বরের এক বন্ধুর মনে হলো, তার বন্ধুটি যে পরিমাণে কাজপাগল, হয়তো বিয়ের কথা দিব্যি ভুলে বসে আছে! নিশ্চয়ই লাইব্রেরিতে বসে কোনো বই ঘাঁটছে, নয়তো ল্যাবরেটরিতে কোনো গবেষণা নিয়ে পড়ে আছে।

বন্ধুর অনুমানই সত্যি হলো। পাত্রকে পাওয়া গেলো ল্যাবরেটরিতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই রাগ হলো বন্ধুর। তিরস্কার করে বললেন, “আজ যে তোর বিয়ে সেটাও কি ভুলে বসে আছিস?” খুব শান্তস্বরে পাত্র বললেন, “বিয়ের কথা আমি ভুলিনি। কিন্তু হাতের কাজটুকু শেষ না করে কীভাবে বিয়ের আসরে যাই!”

গবেষণার মাধ্যমে পাস্তুর খুঁজতেন মানবকল্যাণের পথ; Source: theobjectivestandard.com

কাজপাগল এই পাত্রটিই হলেন মানবকল্যাণের অন্যতম পথিকৃত লুই পাস্তুর। লুই পাস্তুরের জন্ম ফ্রান্সের এক ছোট্ট গ্রাম ডোলেতে। ছোটবেলা থেকেই পাস্তুর পড়াশোনায় ছিলেন দারুণ মনোযোগী। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। পাস্তুর তার সমস্ত জীবন গবেষণায় নিয়োজিত থেকেছেন। তার গবেষণা আজও মানবকল্যাণের কাজে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে, বিশেষ করে জীবাণুর সাথে রোগের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাগুলো। আজ আমরা তার তেমনই কিছু গবেষণার কথা জানবো।

পাস্তুরাইজেশন

১৮৫৪ সালে পাস্তুর ফ্রান্সের লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। সে সময় ফ্রান্সের বিশাল একটা অংশ জুড়ে মদ তৈরির কারখানা ছিলো। তৎকালীন সরকারের রাজস্ব খাতের একটা বড় অংশ আসতো এই মদ থেকে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা সমস্যা দেখা দিলো। কারখানায় তৈরি মদের কিছু অংশে পচন দেখা দিলো। কেউ বুঝতে পারছিল না কেন এমনটা হচ্ছে। এই সমস্যা উদঘাটনের ভার পড়লো পাস্তুরের উপর। পাস্তুর ভালো মদ আর নষ্ট হয়ে যাওয়া মদের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। পরীক্ষায় দেখা গেলো, ভালো মদে একধরনের গোলাকার পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে আর খারাপ মদে রয়েছে লম্বাটে এক ধরনের ক্ষুদ্র পদার্থ। পাস্তুর ধারণা করলেন, পারিপার্শ্বিক কোনো প্রভাবেই গোলাকার পদার্থটি লম্বাটে হয়ে মদে পচন ধরাচ্ছে।

পাস্তুরাইজেশনের মাধ্যমে তরল খাদ্যবস্তু সংরক্ষণে এসেছিল দারুণ বিপ্লব; Source: tasnimnews.com

দীর্ঘ সাধনার পর ১৮৬২ সালে তিনি বের করলেন বাতাসের মধ্যকার জীবাণু ভালো মদের সংস্পর্শে আসলে এতে পচন ধরাতে সাহায্য করে। এই জীবাণু হলো ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব। তারপর তিনি মদকে ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় গরম করে আবার ঠাণ্ডা করে দেখলেন, এতে মদের স্বাদ বা মানের কোনো পরিবর্তন হয় না, অথচ জীবাণুও ধ্বংস হয়। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলো দুধ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করণের কাজেও। পাস্তুরের নামানুসারে এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় পাস্তুরাইজেশন বা পাস্তুরায়ন। এই প্রক্রিয়াতে কোনো তরলকে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় গরম করে পুনরায় ঠাণ্ডা করা হয়। এতে খাদ্যবস্তুর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়, আর খাদ্যের মানও একই থাকে। পাস্তুরাইজেশন খাদ্য সংরক্ষণ ও খাদ্যনিরাপত্তায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলো।

সিল্ক শিল্প

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রান্সে সিল্কের ব্যবসা চলছিলো খুব জমজমাটভাবে। হঠাৎ করেই কোনো এক অজানা সংক্রামক রোগে গুটিপোকাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। ১৮৬৫ সালে পাস্তুরকে দায়িত্ব দেওয়া হলো এই সমস্যার সুরাহা করার জন্য। দীর্ঘ তিন বছরের গবেষণায় পাস্তুর আবিস্কার করলেন, দু’টি প্রধান অসুখের ফলেই গুটিপোকাগুলো মারা পড়ছে। সেই রোগ নির্মূলের উপায়ও খুঁজে বের করলেন তিনি। এই গবেষণায় তাকে দৈনিক আঠারো ঘন্টা করে পরিশ্রম করতে হচ্ছিলো। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। পরামর্শ দিলেন অসুস্থ গুটিপোকাকে বাদ দিতে। কারণ অসুস্থ গুটিপোকার ডিম থেকে জন্ম নেওয়া গুটিপোকাও অসুস্থই হবে। তার এই গবেষণা শুধু যে ফ্রান্সের রেশম শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলেছিলো, তা নয়। বরং সমগ্র বিশ্বে রেশম উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও তার গবেষণার সুফল ভোগ করেছিলো। দেশের দুর্দিনে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়লেও পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন খুবই সামান্য। দেশের জন্য কিছু করতে পারার মাঝেই আনন্দ খুঁজে পেতেন।

অ্যানথ্রাক্স

১৮৬৭ সালে পাস্তুর সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন রসায়নের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে, গবেষণা শুরু করলেন অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে। সে সময় পোলট্রি খাতে এক মহামারী সমস্যা দেখা দিলো। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ মুরগিই মারা যাচ্ছিলো। আর সংক্রামক হওয়ায় কোনো ফার্মে একটি মুরগি আক্রান্ত হলে বাকি মুরগিগুলোও আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ছিলো।

গবাদিপশুর অ্যানথ্রক্স নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছিলেন পাস্তুর; Source: UMTB-Health

এবারও গবেষণায় দায়িত্ব কাঁধে নিলেন পাস্তুর। বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আবিস্কার করলেন ভয়াবহ অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু। প্রমাণ করলেন, ব্যাসিলাস নামের বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া অ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য দায়ী। আর এই অ্যানথ্রাক্স শুধু মুরগি নয়, বরং গরু, ভেড়া সহ যেকোনো গবাদি পশুরই হতে পারে। আর এই রোগ সংক্রামক, তাই মারাত্মক আকার ধারণ করতেও সময় লাগে না খুব একটা। পাস্তুর এই রোগের প্রতিষেধকও আবিষ্কার করেন। প্রতিষেধক হিসেবে ব্যাসিলাস আগে থেকেই প্রবেশ করিয়ে দিলে শরীরে প্রতিরোধক তৈরি হয়। ফলে নতুন করে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু আর কাজ করতে পারে না। তবে বর্তমানে অনেকে মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে জ্যঁ জোসেফ হেনরী তুস্যিয়েন্ত নামের একজন ফরাসী পশুচিকিৎসক সর্বপ্রথম এই প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন। তবে যা-ই হোক না কেন, এক্ষেত্রে পাস্তুরের অবদানকে কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না।

জলাতঙ্ক

সে সময়ে হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক ছিলো এক ভয়াবহ ব্যাধি। জলাতঙ্কে রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়তো। প্রচুর পিপাসা পেলেও পানি পান করতে পারতো না। এমনকি অনেক রোগী পানি দেখলে বা পানির শব্দ শুনলে আতঙ্কিত হয়ে পড়তো। একটা সময় রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। এই রোগের ছিলো না কোনো চিকিৎসা। পাস্তুরের মন আহত হয়ে উঠলো রোগীদের করুণ মৃত্যু দেখে। কিছু একটা করতে চাইলেন তিনি।

শুরু করলেন গবেষণা। নিজেই এলাকার পাগলা কুকুর ধরে এনে পালতে শুরু করতেন। একদিন এক বিশাল বুলডগ উন্মাদ হয়ে চিৎকার করছিলো। বুলডগটির মুখ দিয়ে অবিরত ঝরছিলো লালা। বহু কষ্টে বন্দী করা হলো সেই বুলডগকে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই কুকুরের মুখের সামনে পাত্র ধরে সংগ্রহ করলেন লালা। এই লালা গবেষণার কাজে লাগবে! গবেষণার মাধ্যমে এই বিষাক্ত লালা থেকে প্রস্তুত করলেন জলাতঙ্কের সিরাম।

এবার পরীক্ষা করে দেখার পালা। আসলে কাজ কতটুকু হবে তার জন্য সেই সিরাম প্রয়োগ করতে শুরু করলেন বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহে। প্রথম পরীক্ষাটি চালালেন খরগোশের উপর। ফলও পেলেন আশানুরূপ। কিন্তু মানুষের দেহে কীভাবে এই সিরাম প্রয়োগ করবেন তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন। ঠিক কোন মাপে কতখানি সিরাম প্রয়োগে রোগী সুস্থ হবে, তা তো জানা নেই। একটুখানি ভুলের জন্য আসতে পারে বিশাল বিপদ। এই কঠিন সমস্যার সমাধান কীভাবে করবেন সেটা বুঝতে পারছিলেন না পাস্তুর।

সুযোগ এসে গেলো অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই। জোসেফ মেইস্টার নামের এক ছেলে আসলো পাস্তুরের কাছে। ছেলেটিকে পাগলা কুকুরে কামড়েছিলো। পাস্তুর ছেলেটিকে পরীক্ষা করে দেখলেন ছেলেটির জলাতঙ্ক হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু অবধারিত। নয়দিন ধরে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করার পর অবশেষে তিন সপ্তাহ পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো জোসেফ। বন্ধ হলো জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু।

জোসেফ মিস্টারের শরীরে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হচ্ছে; Source: Pinterest

লুই পাস্তুর একজন রসায়নের অধ্যাপক হলেও আমৃত্যু কাজ করেছেন অণুজীব নিয়ে। কেমন করে এর উৎপত্তি, কীভাবে এর দ্বারা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেসব নিয়ে। মানবদরদী মহান এই বিজ্ঞানীর কাজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

তথ্যসূত্র:

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনীশতক; প্রকাশক: কলকাতা দেবসাহিত্য কুটির, পৃষ্ঠা নং: ৪৫৮- ৪৬৩

ফিচার ইমেজ- Historical-Wallpaper

Related Articles