বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হলো ভিডিও গেমস। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে গেমের বাজারেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, এদেশে ভিডিও গেম জনপ্রিয় হয় নব্বইয়ের দশকের দিকে। সেসময় খুব কম পরিবারের বাসায় ব্যক্তিগত কম্পিউটারের বন্দোবস্ত ছিল। শহরের “গেম খেলার দোকান” হিসেবে পরিচিত জায়গায় পকেট ভর্তি কয়েন নিয়ে নব্বই দশকের ছেলেরা ভিড় করতো নানা আর্কেড গেম খেলার জন্য। প্যাকম্যান, স্পেস ইনভেডার, স্ট্রিট ফাইটারের মতো টু ডাইমেনশনাল (2D) গ্রাফিক্সের গেম তখন অনেক জনপ্রিয় ছিল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে এসব গেম খেলাই ছিল তখনকার বাচ্চাদের বিনোদনের অন্যতম উৎস।
ভিডিও গেম শিল্প পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পগুলোর মাঝে একটি। স্বল্প সময়ের মাঝেই এই শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে গেমের গ্রাফিক্স হয়েছে আরো উন্নত। কেবল কম্পিউটার ছাড়াও এখন মোবাইল ফোনে উন্নত মানের গেম খেলা যায়। তাছাড়া আরো নতুন নতুন গেম খেলার ডিভাইস প্রতিনিয়ত বাজারজাত করা হচ্ছে। এভাবে ভিডিও গেমের ব্যবসা এখন বেশ জমজমাট। বিভিন্ন গেম তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান একটি গেম দিয়েই কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলতে পারে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর আগমন ঘটেছে অনলাইন গেমের। এটি যেন এই ব্যবসায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যে ভিডিও গেম তরুণ প্রজন্মের জন্য কেবল অবসর কাটানোর একটা অনুষঙ্গ ছিল, তা এখন পরিণত হয়েছে আসক্তিতে।
ভিডিও গেম ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড
ভিডিও গেম খেলা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কীভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়? এমন প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। তবে বিভিন্ন দেশের সরকারি ব্যক্তিত্ব নানা সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ভিডিও গেমকে সরাসরি দায়ী করেছেন। ক’দিন আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাই স্কুলে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গণহত্যার কারণ হিসেবে ভিডিও গেমস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ছাড়াও অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। তাদের মতে, একজন বিপথগামী তরুণকে উস্কে দেওয়ার পেছনে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে মহিমান্বিত করে এমন ভিডিও গেমগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
গণহত্যার সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তি নিজেরাও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে ভিডিও গেমের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছেন। ২০১১ সালে আন্দ্রেস ব্রিভিক নামের এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি নিজ দেশ নরওয়েতে একাই একটি বিরাট গণহত্যা পরিচালনা করেন। বোমা বিস্ফোরণ ও বন্দুক ব্যবহার করে তিনি মোট ৭৭ জন মানুষ হত্যা করেন। এই ব্যক্তি নিজের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ‘কল অফ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার ২’ নামক একটি ফার্স্ট পার্সন শুটিং গেমের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিছুদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এল পাসো শহরে একটি গণহত্যার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। এক বন্দুকধারীর হাতে একটি ওয়ালমার্ট স্টোরে মোট ২২ জন নিহত হন এবং আহত হন আরো ২৪ জন। ২১ বছর বয়সী সেই বন্দুকধারীর নাম প্যাট্রিক উড ক্রুসিয়াস। এফবিআইকে দেওয়া জবানবন্দীতে তিনিও কল অফ ডিউটি গেমটির কথা উল্লেখ করেন। মূলত টেক্সাসের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বক্তব্যটি রাখেন।
কল অফ ডিউটি মূলত একটি ফার্স্ট পার্সন শুটিং গেম ফ্রাঞ্চাইজি। গেমারদের মাঝে জনপ্রিয় এই গেমটির প্রতি বছরই একটি করে নতুন কিস্তি বের হয়। সত্যিকার মিলিটারি প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ কৌশল ইত্যাদি এই গেমে অনেক নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সকল প্রকার বন্দুক সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য। কোনো প্রকার মিলিটারি প্রশিক্ষণ ছাড়াই একজন গেমার জানতে পারেন অ্যাসল্ট রাইফেল, সাবমেশিন গান, বিভিন্ন পিস্তলের ম্যাগাজিনে কত সংখ্যক গুলি থাকে। কোন বন্দুকের বিশেষত্ব কী, সে সম্পর্কেও এই ধরনের গেম থেকে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। উন্নত মানের গ্রাফিক্স আর বাস্তবসম্মত গেমপ্লের কারণে অনেক গণহত্যাকারী এ ধরনের শুটিং গেমের দ্বারস্থ হয়।
গবেষণা চলছে প্রায় দুই যুগ ধরে
যারা নিয়মিত ভিডিও গেম খেলেন, তাদের কাছে এমন অভিযোগ নিতান্ত হাস্যকর ও ভিত্তিহীন মনে হতে পারে। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ভিডিও গেমের সাথে আসলেই এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংযোগ আছে কি না তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ২০১৫ সালে ভিডিও গেমস ও সন্ত্রাসবাদের মাঝে কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না তা নিয়ে গবেষণা চালায়। তাদের গবেষণামূলক প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেন যে, গোলাগুলি ও বন্দুকযুদ্ধ আছে এমন ভিডিও গেমের পেছনে অনেক সময় দিলে তা একজন মানুষের স্বাভাবিক আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। আক্রমণাত্মক আচরণ, সহানুভূতি ও সহনশীলতার অভাব, অসামাজিকতা ইত্যাদি নেতিবাচক দিক অতিরিক্ত গেম খেলার ফসল হতে পারে। তবে বহু গবেষক আছেন যারা এই প্রতিবেদন নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে এই গবেষণায় প্রচুর ত্রুটিপূর্ণ তথ্য রয়েছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক এখানে সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করেই ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
২০১৮ সালে কয়েকজন জার্মান গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত একই ধরনের একটি গবেষণায় ৭৭ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেন। গবেষকগণ এই ৭৭ জনকে তিনটি দলে ভাগ করেন। প্রথম দলকে প্রতিদিন অন্তত দুই ঘণ্টা গ্র্যান্ড থেফট অটো ফাইভ গেমটি খেলতে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় একটি দলকে সিমস নামের একটি অতি সাধারণ ও কোনো গোলাগুলি নেই এমন গেম খেলতে দেওয়া হয়। আর তৃতীয় দলকে কোনো গেমই দেওয়া হয় না। গবেষকরা এই তিন দলের মধ্যে আচরণের বিভিন্ন দিক, যেমন- হিংস্রতার মাত্রা, উগ্র স্বভাব, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি পরিমাপ করেন। কিন্তু তিন দলের কারোর মাঝেই কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
আমেরিকার ডার্থমুথ কলেজ প্রায় ২৪টি গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে, যার সাথে প্রায় ১৭,০০০ কিশোর জড়িত ছিল। তারা তাদের অনুসন্ধান থেকে যে ফলাফল পান, তা হলো ভিডিও গেম কমবয়সী ছেলেদের মাঝে ঠিকই আক্রমণাত্মক আচরণের উদ্রেক করছে। বিশেষ করে জীবনযাপনের দিক থেকে যারা একটু অসামাজিক, কারো সাথে মিশতে চায় না, এমন ছেলেদের মাঝে এসব লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
অতিরিক্ত ভিডিও গেম খেলা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য একজন মানুষের মাঝে নেতিবাচক আচরণ দেখা দিতে পারে। তবে এর সাথে সরাসরি সন্ত্রাসবাদকে যুক্ত করা বেশ অতিরঞ্জিত হয়ে যায়। এমনটিই বলেছেন বেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী ও গবেষক। যুক্তরাজ্যের মিড্লসেক্স ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্ক কোলসন বলেন,
আমি এটি পুরোপুরি স্বীকার করবো যে, ভিডিও গেমে থাকা ভায়োলেন্সের কিছু স্বল্পমেয়াদী প্রভাব রয়েছে এবং তা অস্বীকার করা বোকামি। তবে এর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল যে সত্যিকার খুনখারাবি হবে তা মেনে নেওয়া যায় না। এর পেছনে তেমন কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই।
একজন অপরাধীর সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার জন্য কেবল ভিডিও গেম খেলাকে দোষারোপ করা নিতান্ত হাস্যকর ব্যাপার। প্রায় দুই যুগ ধরে এই দুটি জিনিসের মাঝে যোগসূত্র রয়েছে কি না তা নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো অকাট্য প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায়নি। আসলে গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে এমন অপরাধীরা কীরকম পারিবারিক পরিবেশে ও সমাজে বেড়ে উঠেছে সেটি নিয়ে পর্যালোচনা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভিডিও গেম এখানে গৌণ বিষয়। টানা অনেকক্ষণ ধরে গেম খেললে হয়তো একজনের মাঝে একটু উগ্র আচরণ লক্ষ্য করা যায় ঠিকই। তার মানে এই না যে সে বাইরে গিয়ে কোনো অপরাধ করে বসবে। মোটামুটি সব বয়সের মানুষই গেম খেলে। আর এর সাথে সন্ত্রাসবাদের যে সম্পর্ক ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে, বাস্তবে তার পরিসংখ্যান অত্যন্ত নগণ্য।
যে বিষয়টি এড়ানো উচিত নয়
ভিডিও গেমসের যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই তা কিন্তু নয়। মোবাইল ফোনে এখন ভালো মানের গেম খেলা যায়। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে বিভিন্ন ধরণের অনলাইন গেম তো আছেই। মূলত এ ধরনের গেমগুলোর কোনো শেষ নেই। প্রচুর আকর্ষণীয় এই গেমগুলোতে সহজেই আমরা আসক্ত হয়ে যেতে পারি। বিশেষ করে ছেলেরা এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অপচয় করে এসব গেমের পেছনে। একসাথে অনেকে মিলে এসব গেমে অংশগ্রহণ করা যায় বলে এর এক আলাদা আনন্দ রয়েছে। সম্প্রতি কিছু ব্যাটেল রয়াল গেম, যেমন- পাবজি, ফোর্টনাইট ইত্যাদি নিয়ে এতটাই মাতামাতি শুরু হয়েছে যে বিভিন্ন দেশের সরকার এই গেমগুলো তাদের দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। ছাত্রদের মূল্যবান সময়ের অপচয়ের পেছনে অন্যতম কারণ এই গেমগুলো।
বর্তমান ভিডিও গেমের বাজার অনেক বড়। কোম্পানিগুলো প্রতি বছর নানা আকর্ষণীয় গেম বাজারজাত করছে। একটি বিষয়ে অভিভাবকদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। আর তা হলো বাজারের সকল গেম তার সন্তানের খেলার জন্য উপযুক্ত কি না। ভিডিও গেম খেলে ভুল ধারণা নিয়ে যাতে অল্প বয়সী বাচ্চারা উগ্রপন্থী না হয়ে যায়, তার জন্য বয়স ভিত্তিক রেটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। Pan European Gaming Information (PEGI) হলো এমন একটি ব্যবস্থা যেটি ইউরোপের গ্রাহকদের জন্য গেমের বয়স অনুযায়ী রেটিং করে থাকে। এই যেমন তুমুল জনপ্রিয় গেম গ্র্যান্ড থেফট অটো ফাইভের রেটিং হলো পেগি ১৮+। অর্থাৎ এই গেমের বিষয়বস্তু ১৮ বছরের কম বয়সী গেমারদের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই আমরা স্কুল পড়ুয়া ছাত্রদের এই ধরনের গেম খেলতে দেখি। যেসব গেম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, যেসব গেমে যৌনতা, নানারকম বিকৃত ও দৃষ্টিকটু বিষয় থাকে তা ছোটদের হাতে গেলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।
অন্যান্য যেকোনো বিনোদনের মতো ভিডিও গেমও একটি বিনোদনের মাধ্যম। স্কুল-কলেজগামী ছাত্ররা ছাড়া প্রাপ্তবয়স্করাও অবসরে গেম খেলা উপভোগ করে। তবে এই গেম খেলার সাথে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে জুড়ে দেওয়া নিছক বোকামি। মূল সমস্যা হলো, বিনোদন যেকোনো সময়ে আসক্তিতে পরিণত হতে পারে। অতিমাত্রায় গেম নিয়ে পড়ে থাকা যেমন আমাদের আচরণের উপর প্রভাব ফেলে, তেমনি আমাদের দৈনন্দিন জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। এই বিষয়টির দিকেই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিজ্ঞান’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/