ডুয়েল বা মাল্টিপল রিয়েলিটি, প্যারালাল ইউনিভার্স কিংবা মাল্টিভার্সের মতো চমৎকার সব বিপরীত অবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মাধ্যমে। এ কারণে কোয়ান্টাম ফিজিক্সকেই সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ ক্ষেত্র হিসেবে ভাবা হয়। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বমতে, আমাদের এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই সমান্তরাল কিছু মহাবিশ্ব রয়েছে, যেখানে সময় আমাদের উল্টোদিকে প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ, বিশ্বজগতের কোথাও হয়তো বা এমন একটি মহাবিশ্ব আছে, যেখানে হয়তো আমাদের মতোই ছায়াপথ আছে, আছে নানা নীহারিকা। সেখানেও হয়তো সৌরজগতের মাঝে পৃথিবী নামে নীলাভ একটি গ্রহ আছে, যে গ্রহে হয়তো এই মুহূর্তে আপনার মতো দেখতে কেউ একজন অসীম আগ্রহ নিয়ে প্যারালাল ইউনিভার্সের তত্ত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে!
অর্থাৎ, তত্ত্বমতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও একই রকমের কিছু সমান্তরাল মহাবিশ্ব থাকতে পারে, যারা একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না। একইভাবে, মহাবিশ্বের ঘটমান সকল ঘটনারই এক বা একাধিক বিপরীত স্টেট বিদ্যমান। তবে এ রকম প্রতিটি ঘটনার বিপরীত বা একাধিক সম্ভাবনা একই সময়ে কীভাবে থাকতে পারে, বা তাদের পরস্পর মুখোমুখি হওয়া সাপেক্ষে কী হতে পারে, এ সকল প্যারাডক্স নিয়ে বিতর্ক রয়েই গিয়েছে। এ সকল বিতর্ককে সহজে ব্যাখ্যা করা যায় সম্ভবত কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অন্যতম বিখ্যাত পরীক্ষণের মাধ্যমে, যা ‘স্রোডিঞ্জার’স ক্যাট এক্সপেরিমেন্ট’ নামে সর্বাধিক পরিচিত।
চলুন, সহজ ভাষায় বোঝার চেষ্টা করা যাক, কীভাবে স্রোডিঞ্জার তার থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই প্যারাডক্সের তাত্ত্বিক সমাধান প্রদান করেছেন।
পরীক্ষণ সম্পর্কে জানার পূর্বে চলুন জেনে নেয়া যাক বিজ্ঞানী স্রোডিঞ্জার সম্পর্কে। আরউইন স্রোডিঞ্জার (১৮৮৭-১৯৬১) ছিলেন অস্ট্রিয়ার খ্যাতনামা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এই বিজ্ঞানীর কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মৌলিক গবেষণা রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানে অবদান ও ‘স্রোডিঞ্জার সমীকরণ’ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ১৯৩৩ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
তার করা এই তাত্ত্বিক পরীক্ষণটি মূলত কোয়ান্টাম সুপারপজিশন সম্পর্কিত একটি প্যারাডক্সের কিছু গাণিতিক ও তাত্ত্বিক সম্ভাবনা নির্ভর একটি গবেষণা। স্রোডিঞ্জার এই গবেষণাটি করেন মূলত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ্য বৈশিষ্ট্যটির উপর ভিত্তি করে। কী সেটা? এবার তবে নড়েচড়ে বসা যাক।
আমাদের চারপাশের পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে আমরা সকল পদার্থের শুধুমাত্র একটি অবস্থাই দেখতে পাই। যেমন, আমরা দেখতে পাই সূর্য নিজ অক্ষের উপর নির্দিষ্ট একটি দিকে আবর্তিত হয়, কিংবা একটি মার্বেলকে চাইলে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট দিকে (ক্লকওয়াইজ বা অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ) ঘোরানো যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণা কিছুটা আলাদা। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের মতে, পদার্থের মূল গাঠনিক এককগুলো একই সময় একাধিক ধরনের অবস্থানে থাকতে পারে। একটি কোয়ান্টাম কণা বা পারমাণবিক মাত্রার একটি কণার একইসাথে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারার এই বিশেষ ক্ষমতাকে বলা হয় ‘সুপারপজিশন’।
অন্যভাবে বললে, প্রতিটি কোয়ান্টাম কণাই একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু এই একাধিক অবস্থাকে আমরা কখনো একই সাথে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। যেমন, একটি কোয়ান্টাম কণা একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে কণা হিসেবে থাকতে পারে, আবার তরঙ্গ হিসেবেও থাকতে পারে। আমরা যারা পদার্থবিজ্ঞানের স্বাভাবিক কিছু নিয়ম জানি, তারা হয়তো সকলেই জানি যে, আলো একইসাথে কণা ও তরঙ্গের মতো আচরণ প্রকাশ করে। অর্থাৎ, আলো দুটি ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। একইভাবে, এই কোয়ান্টাম কণিকাগুলোকে পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে এরা ভিন্ন ভিন্ন আচরণ বা অবস্থা প্রদর্শন করে। একজন পর্যবেক্ষক এই কণাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করার আগপর্যন্ত তারা একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ, উভয় অবস্থাতেই থাকার সম্ভাবনা বিদ্যমান। এই একইসাথে ‘উভয় অবস্থাতে থাকার সম্ভাব্যতা’কেই বলা হয় কোয়ান্টাম সুপারপজিশন। একই সময়ে পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার ভিত্তি করেই স্রোডিঞ্জার তার বিখ্যাত থিওরিটি প্রদান করেন।
স্রোডিঞ্জার তার থিওরিতে একটি বায়ুনিরোধী বাক্সের কথা কল্পনা করেন, যার ভেতরে একটি বিড়াল, কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ, একটি তেজস্ক্রিয়তা ডিটেক্টর যন্ত্র, একটি হাতুড়ি, এবং একটি কাচের টেস্টটিউবে বিষাক্ত গ্যাস ভর্তি করা আছে। বাক্সের ভেতরের তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো থেকে যখন তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হবে, তখন তেজস্ক্রিয়তা ডিটেক্টর যন্ত্রে সেই বিকিরণ শনাক্ত হবে। ফলে এর সাথে সংযুক্ত হাতুড়িটি সরাসরি বিষাক্ত গ্যাসপূর্ণ কাচের টেস্টটিউবটিকে আঘাত করবে। এতে টেস্টটিউবটি ভেঙে গিয়ে এর ভেতরে থাকা বিষাক্ত গ্যাস পুরো বক্সের ভেতর ছড়িয়ে পড়বে। বাক্সটি বিষাক্ত গ্যাসে ভর্তি হয়ে যাওয়ার কারণে এর ভেতরে থাকা বিড়ালটি অল্প কিছু সময়ের মাঝেই মারা যাবে!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাক্সের ভেতরে আসলে ঠিক কোন ঘটনাটি ঘটেছে? উত্তরটি একইসাথে খুবই সহজ এবং গোলমেলে। বাক্সের ভেতরে যদি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়ে থাকে, তার মানে তেজস্ক্রিয়তা ডিক্টেটর যন্ত্রটি সচল হয়েছিল, হাতুড়িটি বিষাক্ত গ্যাসভর্তি টেস্টটিউবটিকে আঘাত করেছে, বাক্সে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং যার ফলে বাক্সটিতে একটি মৃত বিড়াল পড়ে আছে।
যদি এর উল্টোটা হয়, অর্থাৎ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ না হয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা ডিক্টেটরটি সচল হয়নি, গ্যাসভর্তি টেস্টটিউবটি অক্ষত আছে এবং বাক্সের ভেতর একটি জীবিত বিড়াল আছে। কিন্তু আমরা যেহেতু বলেছি সুপার পজিশনিংয়ের ক্ষেত্রে একইসাথে একই সময়ে দুটি ভিন্ন অবস্থানে থাকা সম্ভব, সুতরাং তত্ত্বমতে ঐ বাক্সে দুটি ঘটনা ঘটারই সম্ভাবনা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে বাক্সের ভেতর এখন এমন একটি বিড়াল রয়েছে যা একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত! অর্থাৎ, পরীক্ষণের ফলাফল অনুসারে ঐ বাক্সে এমন একটি বিড়াল রয়েছে, যা জীবিত না আবার মৃতও না। এমন জীবন্মৃত সম্ভাবনার কারণে অনেকে একে জম্বি-ক্যাট থিওরি নামেও অভিহিত করে থাকেন।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের এই অদ্ভুত নিয়মের কারণে গাণিতিকভাবে একই স্থানে ভিন্ন ভিন্ন একাধিক কিন্তু বিপরীত ঘটনা ঘটমান থাকার সমান সম্ভাবনা থেকে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যদি বাক্সটির ভেতর লক্ষ্য করেন, তাহলে কি তিনি একইসাথে জীবিত ও মৃত বিড়াল দেখতে পাবেন? উত্তর হচ্ছে, না! অর্থাৎ একই পরীক্ষণের জন্য আমরা ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক রাখলে প্রত্যেকে শুধুমাত্র একটি ফলাফলই দেখতে পাবেন। একজন পরীক্ষক মৃত বিড়াল এবং একই সময়ে অন্য একজন পরীক্ষক ওই বাক্সটিতে জীবিত বিড়াল দেখতে পাবেন। এর মানে হচ্ছে, একই ঘটনা দুজন পর্যবেক্ষক দুভাবে দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু একে অন্যেরটা দেখতে পাচ্ছেন না। অর্থাৎ ঐ নির্দিষ্ট ঘটনার সাপেক্ষে তারা ভিন্ন দুটি সময় প্রত্যক্ষ করছেন, তাদের পর্যবেক্ষণ দুটি ভিন্ন সময়রেখায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। ঠিক যেভাবে সমান্তরাল দুটি রেখা পাশাপাশি অবস্থানে চলতে শুরু করলেও অসীম দূরত্বেও তাদের কখনও দেখা হবে না।
এখান থেকেই মূলত প্যারালাল ইউনিভার্সের মূল ধারণাটি এসেছে! কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই সুপার পজিশিনিং দিয়ে সহজের প্যারালাল ইউনিভার্সের গ্রহনযোগ্যতা প্রমাণ করা যায়। যেহেতু স্রোডিঞ্জারের থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে আমরা মোটামুটিভবে এটি বলতে পারি যে, প্রত্যেকটি ঘটনার বিপরীত বা একাধিক সম্ভাবনা থাকতে পারে, সুতরাং আমরা এটাও ধরে নিতে পারি যে, একটি ঘটনা যতভাবে ঘটা সম্ভব, তার প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো ইউনিভার্সে ঘটছে। কিন্তু আমরা এক সময়রেখায় শুধুমাত্র একটি ঘটনার বেশি প্রত্যক্ষণ করতে পারি না বিধায় অন্য সম্ভাবনাগুলোকে আমরা কখনো দেখতে পাই না। ঠিক যেভাবে দুটি সমান্তরাল রেখা কখনও একে অপরের দেখা পায় না। এ কারণে মহাবিশ্বে প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব থাকা তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও আমরা এই সুপার পজিশনকে কখনও প্রত্যক্ষ করতে পারি না। একইসাথে দুই অবস্থানে পরিভ্রমণের সুযোগ যেদিন হবে, সেদিন হয়তো আমরাও প্যারালাল ইউনিভার্সের দেখা পাবো!