
ভূমিকম্প; প্রকৃতির এক আকস্মিক দুর্যোগ। প্রতি ঘন্টায় পৃথিবীতে বিভিন্ন মাত্রার গড়ে দশটি ভূমিকম্প হয়। টেক জায়ান্ট গুগল এবার কাজ করছে এই ভূমিকম্প নিয়েই। গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই জানিয়েছেন, গুগল তাদের পরবর্তী বড় প্রকল্প হিসেবে ভূমিকম্প পূর্বাভাস-ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা করছে।
কী বলছে গুগল?
গুগল সম্প্রতি ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করে পরীক্ষা করে দেখেছে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে ভূমিকম্প এবং সুনামির সতর্কতা পাওয়া সম্ভব। সতর্কতা, পূর্বাভাস বা সেন্সিং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে এই কৌশলগুলোর বেশিরভাগই সক্ষমতাভেদে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে কার্যকর। গুগল বলছে, তারা এমন একটি প্রযুক্তি তৈরির পথে এগিয়েছে যা কয়েক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে কাজ করে এবং এই কাজে বিশেষ সংবেদনশীল ফাইবার ও সরঞ্জামের পরিবর্তে সমুদ্রের নিচে থাকা সাধারণ ফাইবার ব্যবহার করা সম্ভব। আশার কথা হচ্ছে, গুগলের এই প্রযুক্তিতে সাধারণ সরঞ্জামই ব্যবহার করা যাবে যা বিশ্বে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার অপটিক সিস্টেমগুলোতেই আছে।

কেন ফাইবার অপটিক ক্যাবল?
ফাইবার অপটিক ক্যাবলগুলো সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে দূর-দূরান্তের মহাদেশগুলোকে সংযুক্ত করেছে এবং ইন্টারনেটের আন্তর্জাতিক ট্র্যাফিকের বেশিরভাগই এই ক্যাবলগুলো দিয়েই কাজ সম্পন্ন করে। গুগলেরও নিজস্ব এমন সাবমেরিন ক্যাবল রয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের ১৫টি ফাইবার সিস্টেম সর্বমোট ১ লাখ ১২ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ক্যাবলগুলো গ্লোবাল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয়ে আলোর গতিতে বিশ্বজুড়ে তথ্য আদান-প্রদান, অনুসন্ধান, প্রেরণ এবং গ্রহণ করার মতো কাজগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ক্যাবলগুলো অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, যা প্রতি সেকেন্ডে ২ লাখ ৪ হাজার ১০৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তথ্য পরিবহন করে।
এত বিশাল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায়ই তথ্যের বিকৃতি ঘটে। এজন্য রিসিভিং প্রান্তে ডিজিটাল সিগন্যাল প্রসেসিং সিস্টেম থাকে যার দ্বারা তথ্যের বিকৃতিগুলো সংশোধন করা হয়। অপটিক্যাল ট্রান্সমিশনের অংশ হিসেবে আলোর যে বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করা হয় তার মধ্যে একটি হলো স্টেট অভ পোলারাইজেশন (State of Polarisation – SOP)। এই অবস্থাটিই মূলত আশা দেখাচ্ছে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়ার পরিকল্পনায়। ক্যাবলসহ যান্ত্রিক ব্যাঘাতের প্রতিক্রিয়ায় এই অবস্থাটি পরিবর্তন এবং এই ব্যাঘাতগুলো শনাক্ত করে আমাদের ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপ শনাক্ত করতে সক্ষম করে তুলতে পারে।
সাত বছর আগে প্রথম চেষ্টা
২০১৩ সালে গুগল প্রথমবারের মতো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস ব্যবস্থাটি নিয়ে কাজ শুরু করে। সেসময় সমুদ্রের নিচে থাকা অপটিক্যাল ফাইবারের পরিবর্তে তারা স্থলভিত্তিক ক্যাবলগুলোতে এই পরীক্ষা চালায়। কীভাবে স্থলভিত্তিক তারে শনাক্ত করা বিচ্যুতিগুলো আরও ভালভাবে বুঝতে SOP ডেটা ব্যবহার করতে পারা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখে তারা, তবে আশেপাশের পরিবেশগত নানা বিষয় ভূমিকম্পের সংকেত শনাক্ত করতে খুব বেশি বিঘ্ন ঘটানোয় সেসময় গুগল এই কাজে আর এগোয়নি।
বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে আশার আলো
২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য, ইতালি ও মাল্টার ১২ জন বিজ্ঞানীর একটি দল একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একটি সংক্ষিপ্ত ব্যান্ডের আল্ট্রাস্টেবল লেজার ব্যবহার করে স্থলভাগ এবং সমুদ্র উভয় মাধ্যমেই অগ্রগতিমূলক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্প শনাক্ত করার প্রাথমিক সাফল্যের কথা উল্লেখ করা হয় প্রবন্ধটিতে।
স্থলভাগে ৫৩৫ কিলোমিটার, সমুদ্রতলে ৯৬ কিলোমিটার এবং অগভীর জলভাগে ২০০ মিটারের কম গভীরতার মধ্যেই দলটি তাদের পরীক্ষা সীমাবদ্ধ রাখে। সম্প্রতি গুগল ক্লাউডে প্রকাশিত এক ব্লগ পোস্টে গুগল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিজ্ঞানীদের এই প্রবন্ধটিই তাদের নতুন করে এই বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী করে তোলে। এর প্রেক্ষিতে কীভাবে সমুদ্রতলের ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করে ভূমিকম্পের তথ্য শনাক্ত করা যায় তারা সেই সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। গত বছরের (২০১৯) অক্টোবরে তাদের কাছে একটি আইডিয়া আসে, যেখানে বর্ণালী প্রতিচ্ছবির ভিত্তিতে ভূমিকম্প শনাক্ত করতে পারার সম্ভাবনার কথা বলা হয়। এতে ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফ্রিকোয়েন্সিগুলো দেখার জন্য স্টোকসের প্যারামিটারের বর্ণালি বিশ্লেষণে আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব।

সাফল্যের দেখা
২০১৯ এর শেষের দিকে গুগল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাদের বেশ কয়েকটি সাবমেরিন ক্যাবলের এসওপি (SOP) ডেটা পর্যবেক্ষণ শুরু করে। এই পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক ধাপে এসওপি লক্ষণীয়ভাবে স্থিতিশীল ছিল, এমনকি সিগন্যালটি প্রায় সাড়ে দশ হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে যাওয়ার পরেও স্থিরাবস্থায় পাওয়া যায়। এরপরের কয়েক সপ্তাহ ধরে, সমুদ্রের তল সম্ভবত খুব শান্ত ছিল, এই সময়ে কোনো এসওপি পরিবর্তন দেখায়নি যা ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়।
২২ জানুয়ারি, ২০২০; গুগল দাবি করেছে, জ্যামাইকায় সেদিন ৭.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থল থেকে ১,৫০০ কিলোমিটার দূরে থাকা তাদের একটি সাবমেরিন ক্যাবল শনাক্ত করতে পেরেছে। এসওপি-র একটি প্লট ভূমিকম্পের প্রায় পাঁচ মিনিটের পরে একটি স্পষ্ট স্পাইক দেখায়, যা জ্যামাইকা থেকে ক্যাবল পর্যন্ত ভূমিকম্পের তরঙ্গ ভ্রমণের সময়টির সাথে সম্পর্কিত এবং স্পাইকটি প্রায় ১০ মিনিট স্থায়ী ছিল।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
গুগল টিম তাদের এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি সিসমোলজিক্যাল ল্যাবরেটরির ড. ঝংওয়েন ঝানের সাথে। তিনি পর্যবেক্ষণগুলো নিশ্চিত করেছেন এবং বিভিন্ন ধরনের ভূমিকম্পের তরঙ্গের ভ্রমণ সময় এবং এসওপি ভ্রমণের প্রত্যাশিত তরঙ্গদৈর্ঘ্য সীমার জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ।
ফের পরীক্ষা
জামাইকার ভূমিকম্পের পরের মাসগুলোতে একই পদ্ধতিতে গুগল টিম সংক্ষিপ্ত এবং দীর্ঘ দূরত্ব উভয় সময়ে একাধিক মাঝারি আকারের ভূমিকম্প শনাক্ত করেছে। ২২ মার্চ পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। গুগলের একটি সাবমেরিন ক্যাবল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের ২,০০০ কিলোমিটার দূরে থেকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এর দিন ছয়েক পর ২৮ মার্চ চিলির ভালপ্যারিসোর কাছের উপকূলে ৪.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। উৎপত্তিস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যেই গুগলের একটি সাবমেরিন ক্যাবল ছিল। ক্যাবলটি এসওপি ক্রিয়াকলাপের একটি স্পষ্ট তবে সংক্ষিপ্ত স্পাইক তৈরি করায় ফের সাফল্যের দেখা পায় গুগল।
দৃষ্টি এবার উন্নতির দিকে
ভূমিকম্পের ঘটনা শনাক্তকরণের প্রাথমিক সাফল্যে উচ্ছ্বসিত গুগল গ্লোবাল নেটওয়ার্কিংয়ের ভ্যালি কামালোভ ও মাট্টিয়া ক্যানটোনো বলছেন, পৃথিবীর কাঠামো এবং ভূমিকম্পের গতিবেগ উভয়ই পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতাকে উন্নতির পথ পাড়ি দেয়ার পালা এবার। গুগল টিমের তথ্য বিশ্লেষণ করে ড. ঝান পরামর্শ দিয়েছেন টেকটোনিক প্লেট থেকে উদ্ভূত ভূমিকম্পগুলো শনাক্ত করাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে সুনামির পূর্বাভাসেও নজর দিতে। এক্ষেত্রে সাগরের মধ্যকার চাপের পরিবর্তন সহায়ক হতে পারে বলে তার অভিমত। এটাও যদি সাফল্যের মুখ দেখে তাহলে সেটি হবে আরেক দুর্দান্ত পদক্ষেপ। কারণ বর্তমানে সুনামি শনাক্তকরণের বেশিরভাগ সরঞ্জাম হয় সমুদ্র তীরে বা সমুদ্র জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেটি পূর্বাভাস জেনে উপকূলীয় মানুষদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয় না এবং এই পদ্ধতিতে সময়ের সাথে তরঙ্গের গতিও কমে যায়।
গভীর সমুদ্রের তরঙ্গের জন্য প্রতি ঘন্টায় এটি সর্বোচ্চ ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। অন্যদিকে, সুনামির সতর্কতা ব্যবস্থায় একটি সাবমেরিন ক্যাবল যখন ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছে চলে যায়, যা আলোর গতিতে ডেটা প্রেরণ করে মিলিসেকেন্ডে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিতে পারবে। গুগল টিমের এই পদ্ধতি এমন প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে তৈরি যা আজকের ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কগুলোতেই বিস্তৃত। সরকার, টেলিযোগাযোগ সরবরাহকারী সংস্থা এবং গুগলের মতো প্রযুক্তি সংস্থাগুলো দ্বারা পরিচালিত লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক ইতিমধ্যে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্পের ক্রিয়াকলাপ শনাক্ত এবং গবেষণার কাজে এই পদ্ধতির ব্যবহার বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আশা গুগলের।

এখনও অনেক পথ বাকি
ভ্যালি কামালোভ ও মাট্টিয়া ক্যানটোনো বলছেন, এটা মাত্র শুরু। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়া বাকি। প্রথমত, এসওপি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উৎপন্ন হওয়া জটিল তথ্যগুলোর প্রবাহকে আরও ভালভাবে বুঝতে হবে বিজ্ঞানীদের। ভূমিকম্পের তথ্য এমনিতেই জটিল- একেক ধরন বা মাত্রার ভূমিকম্প ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গরূপ সৃষ্টি করে যা একে অপরের থেকে একেবারে পৃথক দেখায় এবং প্রভাবিত করা বিভিন্ন অবস্থার কারণে তরঙ্গরুপেরও পরিবর্তন ঘটে নাটকীয়ভাবে।
একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প নিরীক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করতে গবেষকদের অ্যাডভান্সড ম্যাথমেটিক্স এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো বিষয়গুলোয় ভালো ধারণা থাকা প্রয়োজন, যেখানে গুগল ক্লাউডের মতো উন্নত কম্পিউটিং সিস্টেমগুলোও হতে পারে সহায়ক। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে এটি মেশিন লার্নিংয়ের একটি কাজ, যা মানুষের মস্তিষ্কের সক্ষমতা ছাড়িয়ে যায় এমন উপায়ে বৃহৎ ডেটা সেটগুলো বোঝার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ। গুগল দাবী করেছে, তারা এই পদ্ধতিকে বর্তমান সিসমিক সেন্সরগুলোর বিকল্প হিসেবে নয়, বরং ভূমিকম্প এবং সুনামির জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা প্রদানে সক্ষম করতে পরিপূরক তথ্যের উৎস হিসেবে পথ খুলে দিতে পারবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বার্থে গুগল তাদের সকল সাবমেরিন ক্যাবলকে এই কাজে সম্পৃক্ত করতে আগ্রহী বলে জানানো হয়েছে ব্লগ পোস্টটিতে।