ঊনবিংশ শতাব্দীর পর বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। যা আরও বেগ পায় বিংশ শতাব্দীতে এসে। কারণ এ সময় গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ও সরঞ্জামাদির যোগান তুলনামূলক সহজলভ্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি বিজ্ঞানচর্চায় বাড়ে আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতা। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে সময়কার সংবাদ মাধ্যমগুলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সায়েন্স নিউজ’ এর নাম।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ‘সায়েন্স নিউজ অর্গানাইজেশন’ বিজ্ঞান পাড়ার নানান খবরা-খবর নিয়ে কাজ করছে। শুরুর দিকে চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও সময়ের সাথে বেড়েছে পরিধি। ১৯৪৫ সালের পর পারমাণবিক যুগের শুরু থেকে আজকের আধুনিক পৃথিবীর প্রায় সকল ধরনের উদ্ভাবনী চিন্তা ও কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই সংস্থাটি।
২০১৪ সাল থেকে সায়েন্স নিউজ বিশ্বের সেরা ১০ জন তরুণ বিজ্ঞানীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে আসছে, যা SN-10 নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে ৪০ বছরের কম বয়সী বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন উদ্ভাবনী কাজ তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে ২০২০ সালের তালিকা। যে তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের ২৯ বছর বয়সী তরুণ বিজ্ঞানী অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট তনিমা তাসনিম অনন্যা।
স্বপ্নের শুরু
১৯৯৭ সাল, বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এতটাও পরিচিত হয়ে উঠেনি। বিনোদন কিংবা সংবাদ; সাদাকালো পিকচার টিউবে BTV-ই প্রধান ভরসা। সচেতনরা অবশ্য পত্রিকাতেও চোখ রাখেন, রেডিওর ব্যবহার খুব একটা নেই।
কাজ সেরে একটু টিভির সামনে বসেছেন শামিমা আরা বেগম। টিভি খুলতেই দেখলেন এক বিষ্ময়কর খবর। আমেরিকা নাকি প্যাথফাইন্ডার নামের এক রোবটিক মহাকাশযান পাটিয়েছে মঙ্গল গ্রহে। বিজ্ঞান পাড়ায় এ খবর হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া, কিন্তু সাধারণ এক গৃহিনীর কাছে এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
কৌতূহলী শামিমা-আরা বেগম তার মেয়েকে শোনালেন প্যাথফাইন্ডারের গল্প। অবশ্য মেয়ে তনিমার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। মায়ের উচ্ছ্বাসিত চোখ-মুখ দেখে তনিমা সেদিন এতটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে পৃথিবীর বাইরে আরো একটি জগৎ রয়েছে, আর সেখানে আছে পৃথিবীর মতোই আরও অনেক গ্রহ। তনিমার মনে শুরু হয় নানান জল্পনা-কল্পনা, সেই থেকেই ঠিক করেন বড় হয়ে পড়াশুনা করবেন জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে।
২০০৮ সাল, তনিমা তখন কলেজ পড়ুয়া। শিশুকালের স্বপ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে মহাকাশ নিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। এ সময় তার পরিবারকে তিনি পাশে পান। বাবা-মা তাকে আমেরিকার ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তনিমা ছোটকাল থেকেই ছিলেন ভীষণ মেধাবী ফলে আমেরিকার উন্নত কলেজগুলোতে সহজেই আবেদন করতে পারেন। সুযোগ হয় পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের ব্রায়ান মাওর কলেজে।
সফলতা
২০১৩ সালে ব্রায়ান মাওর কলেজ থেকে বৃত্তিসহ পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেন। এরপর ভর্তি হন আমেরিকার নামকরা ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে। এখান থেকেই মাস্টার্স ও পরবর্তীতে প্রেফেসর ম্যাগ ইউরির তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও ব্রায়ান মাওর কলেজে থাকাকালীন তনিমার সৌভাগ্য হয় নাসা (NASA)-র সাথে কাজ করার।
নাসার স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউটে ইন্টার্ন করার সময় সময় হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে ওরিয়ন নেবুলার চিত্রায়ণ করে সেসময় বিজ্ঞান সমাজের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাকে বিভিন্ন নতুন বিষয়ের সাথে শিখতে হয়েছে। এমনকি কম্পিউটার কোডিংও। এ সময় তিনি পাইথন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত সংকেতগুলোকে নিজের বোধগম্য করে তুলতেন।
২০১২ সালে তার অর্জন তালিকায় যোগ হয় আরও একটি সাফল্য। ইউরোপিয়ান পারমাণবিক গবেষণা সংস্থা সার্ন (CERN)-এর সাথে প্রথম বাংলাদেশি হিসেব কাজ করার সুযোগ পান তিনি।
SN-10
SN-10 তালিকার মাধ্যমে সায়েন্স নিউজ চেষ্টা করে সেসব উদীয়মানদের তুলে আনতে যাদের কাজ বিজ্ঞানের পরিধিকে প্রসার করতে সহায়তা করে। এই তালিকায় তারাই প্রাধান্য পায় যারা বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনে অসাধারণ কিছু করে দেখান। এই তালিকা প্রনয়ণে সহায়তা করেন খ্যাতমান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, আমেরিকান ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য ও বিগত এসএন-টেন তালিকায় থাকা বিজ্ঞানীরা।
তনিমার গবেষণা
নক্ষত্রের জীবনচক্রের একটি ধাপ ব্ল্যাকহোল। বিজ্ঞানের জগতে অনন্য এক রহস্য। মহাবিশ্বের অনেক ঘটনার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এরা। তাই আমাদের গ্যালাক্সি কিংবা দূরবর্তী কোনো গ্যালাক্সি সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানতে হলে প্রয়োজন ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। কিন্তু ব্ল্যাকহোল এমনই এক রহস্যময় বস্তু যার ভেতর থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না। আলো না আসলে বলা যায় সরাসরি কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। তাই বিজ্ঞান এর ব্যাখ্যা দিয়েছে কেবল বিভিন্ন তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে।
সম্প্রতি তনিমা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে রহস্যময় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের অসাধারণ কিছু চিত্র তৈরি করেছেন। সেই সাথে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে এই ব্ল্যাকহোলগুলো সময়ের সাথে বেড়ে উঠে, কীভাবে শক্তি সঞ্চয় করে, কীভাবে বেঁচে থাকে, কীভাবে মহাকাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
তার তত্ত্বগুলো বিজ্ঞানের জগতে একেবারে নতুন ধারণার সংযোজন করেছে। কারণ তার গবেষণার আগে এই ব্ল্যাকহোলগুলো ছিল কেবলই অনুমেয় বস্তু। তানিমা সায়েন্স নিউজকে জনিয়েছেন, গবেষণার সময় বারবার থেমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল। কেননা মাঝে মাঝেই টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর মাঝে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্যার সমাধান করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অংশ হিসেবে নিজেই তৈরি করেন একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক। যার মাধ্যমে তথ্যের অসঙ্গতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
তার পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক প্রফেসর ম্যাগ ইউরি বলেন, “সে যতই সমস্যায় পড়ুক কখনোই তাকে হতাশ হতে দেখিনি। সে শুধু সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজে বের করতো আর তার কাজ করে যেত।”
তনিমা বর্তমানে ডার্থ মাওথ কলেজে প্রফেসর রায়ান হিকোক্স গ্রুপে পোস্ট ডক্টোরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে আছেন। কাজ করছেন এজিএন এক্সরে প্যারামিটার নিয়ে। ভবিষ্যতেও তিনি ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে চান। উন্মোচন করতে চান মহাবিশ্বের আরও অনেক অজানা রহস্য।
তনিমা বাল্যকালে মহাকাশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার এই স্বপ্নের সারথি হিসেবে পেয়েছিলেন বাবা-মাকে। পরিবারের একটু স্বদিচ্ছা আর নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে আজ তিন হাটছেন স্বপ্নের পথে।
বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ উর্বর আবহাওয়াতে এমন অনেক তনিমা জন্মায়, কিন্তু সঠিক পরিচর্যার অভাবে অনেকেই তনিমার মতো আলো ছড়াতে পারে না। দেশের পরিবার আর সাথে শিক্ষাব্যবস্থা যদি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বপ্নগুলোর দিকে আর একটু যত্নবান হয়, তবে নিশ্চয় তনিমাদের আর আমেরিকা যেতে হবে না। স্বদেশে থেকেই নিজেকে আর দেশকে আলোকিত করতে পারবে সগৌরবে।