গত বছরের ঘটনা, দিনটি ছিল ২১শে মে, ২০১৬। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মো: কামরুজ্জামানকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর স্বনামধন্য হাসপাতাল অ্যাপোলোতে। কোমড় আর হাত-পায়ের হাড়ের বেশ কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে, অতিসত্ত্বর অপারেশন করা প্রয়োজন। তাছাড়া রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর, কয়েক ব্যাগ রক্ত দেওয়া প্রয়োজন, নতুবা রক্তের অভাবে কামরুজ্জামানকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। তার রক্তের নমুনা নিয়ে পাঠানো হলো ল্যাবে, রক্তের গ্রুপ বের করে তৎক্ষণাৎ রক্ত দিতে হবে তাকে। ল্যাব থেকে জানানো হলো, O গ্রুপের রক্ত। এবার শুরু হয়ে গেলো দৌঁড়ঝাপ, এই গ্রুপের রক্ত খুঁজে পেতে হবে যে।
কামরুজ্জামান যেখানে চাকরি করতেন, অরিনোবা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি, সেখান থেকে তার কলিগেরা চলে এলেন সাহায্য করতে। O গ্রুপধারী রক্তদাতার পাশাপাশি খোঁজা হতে লাগলো ব্লাড ব্যাংকেও। তার কলিগদের মাঝেই বেশ কয়জনের পাওয়া গেলো O গ্রুপের রক্ত। তারা সকলেই রক্তদানের জন্য প্রস্তুত, চার-পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগবে। ডাক্তার সাহেব তাদের মধ্য থেকে সুস্থ-সামর্থ্য কয়েজনকে পাঠালেন ল্যাবে, ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্যে।
ক্রস ম্যাচিং বিষয়টি কী সেটি আগে জানা যাক। ধরা যাক, একজন রোগীর দেহে রক্ত প্রয়োজন, সে জানে তার রক্তের গ্রুপ A+, আরেকজন A+ ধারী রক্তদাতা আসলেন রোগীকে রক্ত দিতে। দুজনের রক্তের গ্রুপ একই, তাই আর কোনোকিছু না ভেবে রক্ত রোগীর দেহে সঞ্চালন করা যেতে পারে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাধারণ নির্দেশনা এভাবে সরাসরি রক্ত সঞ্চালনের কথা বলে না, প্রথমে রক্তের ক্রস ম্যাচিং করা জরুরি। রক্তের গ্রুপিং আবিষ্কার করা হয়েছে মূলত রক্ত সঞ্চালনকে বিবেচনা করে। এখন রক্ত যদি সঠিকভাবে সঞ্চালন সম্ভবই না হয়, তবে গ্রুপিং করে কী লাভ! ক্রস ম্যাচিং জটিল কিছু না, এতে দেখা হয় দুই পক্ষের রক্ত একে অপরকে গ্রহণ করছে কিনা। এটি পরীক্ষার জন্য দুই পক্ষের কয়েক ফোঁটা করে রক্ত একসাথে মিশিয়ে দেখা হবে জমাট বাঁধে কিনা, যদি জমাট বেঁধে যায়, তবে এ রক্ত সঞ্চালন করা যাবে না। জমাট না বাঁধলে নিঃসন্দেহে এ রক্ত সঞ্চালন করা যায়, এর অর্থ ক্রস ম্যাচিংয়ে দু’পক্ষের রক্ত মিলেছে।
কামরুজ্জামানের ঘটনায় ফিরে আসা যাক। কয়েকজন O গ্রুপের রক্তদাতাকে ল্যাবে পাঠানো হলো ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্যে। ল্যাবে গিয়ে দেখা গেলো, তাদের প্রত্যেকের রক্তই কামরুজ্জামানের রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে ফেলছে। আরে কী আশ্চর্য! প্রত্যেকেই নিজেদের রক্ত O গ্রুপের বলেই তো জানতেন। ল্যাবে এবার একে একে সবার রক্ত পরীক্ষা করা হলো। পরীক্ষায় জানা গেলো, তারা ঠিকই O গ্রুপের রক্তবাহী, কিন্তু তবুও কামরুজ্জামানের রক্ত কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। এবার উপায় খুঁজতে বসলেন ডাক্তাররা, কামরুজ্জামানের জীবন যায় যায় অবস্থা। বেশ কিছু ব্লাড ব্যাংক ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে রক্তের স্যাম্পল পাঠানো হলো, সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) রক্তের স্যাম্পল গেলো। কেউ কোনো সমাধান দিতে পারলো না, তবে পিজি থেকে জবাব এলো। তারা জানিয়েছে, এই কামরুজ্জামানের রক্ত আর দশজন সাধারণ মানুষের রক্তের মতো নয়, খুবই দুর্লভ এক রক্ত এটি। আমাদের দেশে নেই বললেই চলে এ রক্তের বাহক। এই রক্তের গ্রুপ হলো ‘বোম্বে গ্রুপ’। ভারতে প্রতি দশ হাজারে একজনের মাঝে পাওয়া যায় এ রক্ত। বাংলাদেশ কিংবা ইউরোপ-আমেরিকাতেও ভারতের মতো সুলভ নয় বোম্বে গ্রুপের রক্ত।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবার নজর দিলেন কামরুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের দিকে। কামরুজ্জামানের যেহেতু বোম্বে রক্ত, পরিবারে অন্য কারো থাকাটাও অসম্ভব নয়। রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেলো, কামরুজ্জামানের বোনের দেহে রয়েছে এই রক্ত। কিন্তু মেয়েটি রক্তদানের জন্য তখনো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেনি। এবার শুরু হলো খোঁজ, দিকে দিকে কামরুজ্জামানের কলিগেরা ছুটে গেলো, ফোনে যোগাযোগ শুরু করলো দেশের প্রায় সকল ব্লাড ব্যাংক আর হাসপাতালে। কিন্তু কিছুতেই কিছু মিলছিলো না। ভারতে যেহেতু এই রক্ত আপেক্ষিকভাবে সুলভ, সেহেতু ভাবা হলো ভারত থেকে রক্ত আনার কথা, কিন্তু এও তো অনেক খরচান্তের ব্যাপার, কামরুজ্জামান একজন চাকরিজীবী মাত্র। অরিনোবা ইন্ডাস্ট্রির মালিক তখন জানালেন যে, তিনি ভারত থেকে কামরুজ্জামানের রক্ত আনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করতে রাজি আছেন।
এই দুর্লভ রক্ত নিয়ে প্রচারণা আর রক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু সংস্থা গড়ে উঠেছে ভারতে। নিয়মিত মানুষের রক্ত বোম্বে গ্রুপে কিনা, তা পরীক্ষা করা হয় ভারতে। যাদের রক্ত বোম্বে গ্রুপের বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাদের পরিচয় নথিভুক্ত করে রাখা হয়, নিয়মিত তাদের সকলের খোঁজ রাখা হয়। এমনই কাজ করা এক বেসরকারি সংস্থা হলো ‘থিংক ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা বিনয় শেঠিই খোঁজ পেয়ে রক্ত খুঁজে দেন কামরুজ্জামানের জন্য। মুম্বাইয়ের চার তরুণ; স্বপ্না সাওয়ান্ত, কৃষ্ণানন্দ কোরি, মেহুল ভেলিকার ও প্রভীন সিন্ধে রক্তদান করে কামরুজ্জামানের জন্য। ভারতের আইন অনুযায়ী, সেখানকার কোনো নাগরিকের দেহাংশ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিনয় শেঠির পৃষ্ঠপোষকতা ও দুই দেশের সরকারের বিশেষ বিবেচনায়, পরবর্তীতে আইনী জটিলতা এড়িয়ে কামরুজ্জামানের জন্য রক্ত আনার অনুমোদন দেয় ভারত সরকার। আন্তঃরাষ্ট্র সমঝোতায় রক্ত পেয়ে আবারো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে কামরুজ্জামান, আর ইতিহাসে আবারো স্থাপিত হয় মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
আমাদের দেশে বোম্বে রক্ত দুর্লভ হলেও, পুরোপুরি যে নেই তা নয়। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো নারায়ণগঞ্জে এই রক্তের এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছিলেন ডা. মজিবুর রহমান। ২০১০ সালে স্কয়ার হাসপাতালে এক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর দেহেও পাওয়া যায় এই বোম্বে রক্ত।
বারবার এই দুর্লভ রক্তটিকে বোম্বে গ্রুপের রক্ত বলে উল্লেখ করছি। এর পেছনের গল্পটিও জানা যাক তবে।
১৯৫২ সালে ‘The Lancet’ নামক চিকিংসাবিজ্ঞানের এক গবেষণাপত্রে সর্বপ্রথম এই বোম্বে রক্তের সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় (পৃষ্ঠা: ৯০৩-৯০৪, ৩রা মে, ১৯৫২)। গবেষণাপত্রে বোম্বে রক্তের উপর ক্ষুদ্র এই আর্টিক্যালটি লিখেছিলেন ডা. উয়াই. এম. ভেন্ডে, ডা. সি. কে. দেশপান্ডে ও ডা. এইচ. এম. ভাটিয়া। গবেষণাপত্রে বলা হয়, কোনো একদিন এক রেলওয়ে কর্মকর্তা ও এক ছুরিকাহত ব্যক্তিদ্বয়ের জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে, রক্তদাতাদের সাথে ক্রস ম্যাচিং করে দেখা যায় যে, কারো রক্তের সাথেই মিলছে না তাদের রক্ত। গবেষণাপত্রের তিন লেখক মিলে ১৬০ জনের মতো মানুষের রক্ত পরীক্ষা করেন, অবশেষে বোম্বের একজন স্থানীয় ব্যক্তির সাথে ক্রস ম্যাচ হয় সেই রক্তের। এই রক্তকে প্রথম বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) শনাক্ত করায় ডা. ভেন্ডে এর নাম দেন বোম্বে রক্ত। বিজ্ঞানের ভাষায় অবশ্য একে ডাকা হয় hh অথবা Oh গ্রুপের রক্ত, সেই ব্যাপারে পরে বলছি। গবেষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, এই hh গ্রুপের রক্ত কেবলমাত্র অপর hh গ্রুপের রক্তকেই গ্রহণ করে। ১৯৫২ সালের পর বহু গবেষণার মাধ্যমে এই বোম্বে রক্তের সত্যিকারের ব্যাখ্যা উঠে এসেছে। hh গ্রুপের রক্ত অন্য কোনো রক্ত গ্রহণ না করায় ও এই রক্তের বাহক খুবই সীমিত হওয়ায়, একে পৃথিবীর সবথেকে দুর্লভ রক্ত বলে আখ্যা দেয়া হয়।
এবার এই রক্ত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় জানা যাক এই রক্তের দুর্লভতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এই লেখার কিছু বৈজ্ঞানিক টার্মের বিষয় বোঝার জন্য পাঠকবৃন্দ রক্তের গ্রুপিং ও রক্ত সঞ্চালন এবং মেন্ডেলবাদ; এই দুটো লেখা পড়তে পারেন। প্রথম লেখায় আপনি রক্তের গ্রুপিং কীভাবে করা হয়ে থাকে তা জানবেন, দ্বিতীয় লেখায় পিতা-মাতা থেকে সন্তানে কীভাবে একটি বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হয়ে থাকে তা জানবেন। এই দুটো বুঝতে পারলে বোম্বে রক্তের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটি খুব সহজেই বোঝা যাবে। বোম্বে রক্ত চিহ্নিত করার পদ্ধতি এবং বংশপরম্পরায় কীভাবে এই রক্ত একজন মানুষের মাঝে আসে, সেগুলো নিয়ে এখন বিস্তারিত জানা যাক।
আপাতদৃষ্টিতে O গ্রুপের রক্তকে ধারণা করা হয় সার্বজনীন দাতা রক্ত, এই রক্ত সকল রক্তবাহীকে প্রদান করা যায়, যেহেতু এতে অ্যাগ্লুটিনোজেন-A কিংবা B থাকে না। O গ্রুপের রক্তই প্রয়োজনের সময় সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু দুর্লভ রক্ত ‘বোম্বে’ খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন কাজ। O রক্তে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজন নেই, এমনটি আপেক্ষিকভাবে ধরা হয়; তবে O গ্রুপের রক্তেও এক বিশেষ ধরনের অ্যাগ্লুটিনোজেন রয়েছে। যেহেতু ABO সিস্টেমের আওতাভুক্ত সকল রক্তে এই অ্যাগ্লুটিনোজেনের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে, সেহেতু রক্তের গ্রুপিংয়ে এই অ্যাগ্লুটিনোজেনটি বিবেচনায় না আনলেও চলে। কিন্তু hh গ্রুপের রক্তে সেই সার্বজনীন অ্যাগ্লুটিনোজেনটি বিবেচনায় না এনে কোনো উপায় নেই, কেননা hh রক্তই একমাত্র রক্ত, যাতে এই অ্যাগ্লুটিনোজেনটি থাকে না।
এই অ্যান্টিজেনের নাম হলো অ্যাগ্লুটিনোজেন-H। এই H অ্যান্টিজেনটি রক্তের গ্রুপিংয়ের জন্য দায়ী বাকি সকল অ্যান্টিজেনের মতোই লোহিত রক্ত কণিকার পৃষ্ঠে অবস্থান করে। তবে এর বিশেষ একটি গুণ রয়েছে, এটি বাকি দুই অ্যান্টিজেন (অ্যাগ্লুটিনোজেন-A এবং B) এর প্রিকার্সর হিসেবে কাজ করে থাকে। ‘প্রিকার্সর’ মানে হলো, এটি উপযুক্ত উদ্দীপনা পেলে অন্য কোনো পদার্থে রূপান্তরিত হতে সক্ষম। যেমন- আমাদের ত্বকে রয়েছে 7-dehydrocholesterol। এটি যকৃতে তৈরি হয়ে আমাদের ত্বকে অবস্থান নেয়। আমরা যখনি সূর্যালোকে যাই, সূর্যালোকের উদ্দীপনার দরুন 7-dehydrocholesterol রূপান্তরিত হয়ে ভিটামিন-ডি তৈরি করে আমাদের দেহে। যেহেতু আমাদের দেশে বছরের প্রায় প্রতিদিনই সূর্য উঠে, রাস্তায় বের হলেও ভিটামিন-ডি তৈরি হয়, এর জন্য আমাদের আলাদাভাবে কোনো ভিটামিন-ডি যুক্ত খাবারের প্রয়োজন নেই। শীতপ্রধান দেশে এজন্য গ্রীষ্মকালে মানুষ সমুদ্রের তীরে সূর্যস্নান করে থাকে। সেসব দেশে মানুষের প্রায়ই ভিটামিন-ডি স্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে। যা বলছিলাম, অ্যাগ্লুটিনোজেন-H হলো বাকি দুই অ্যাগ্লুটিনোজেনের প্রিকার্সর, অর্থাৎ H থেকেই উৎপন্ন হয় অ্যাগ্লুটিনোজেন-A আর অ্যাগ্লুটিনোজেন-B এর।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, H থেকে A ও B উৎপন্ন হতে H কে উদ্দীপনা কে জোগায়? H কে উদ্দীপনা দেয় আমাদের জিনোটাইপ, ক্রোমোসোমের জিনে যে নীলনকশাটি রয়েছে, তাতে উল্লেখ থাকে এই উদ্দীপনার কথা। কীভাবে উল্লেখ থাকে সেটি এর আগের দুটো লেখায় বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। জিনোটাইপে যদি লেখা থাকে A কিংবা B অ্যাগ্লুটিনোজেন উপস্থিত থাকবে রক্তে, তবেই কেবলমাত্র অ্যাগ্লুটিনোজেন-H, অ্যাগ্লুটিনোজেন-A কিংবা B উৎপন্ন করে।
আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে, রক্তে যদি অ্যাগ্লুটিনোজেন-H-ই না থাকে, তবে? এমনটি হতে পারে, সেটিও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেকেই ভাবেন, A ও B গ্রুপের বাবা-মায়ের সন্তান O গ্রুপের হতে পারে কিনা। হতে পারে, এমনকি এই সন্তানটির রক্ত চারটি প্রধান রক্তের মাঝে যেকোনোটি হওয়া সম্ভব, বোম্বে রক্তও হতে পারে যদি H অনুপস্থিত থাকে। তবে বাবা-মা দুজনেই যদি AB গ্রুপের হন, আর সন্তানের দেহে O গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায়, তাহলে এই সন্তানের রক্ত অবশ্যই বোম্বে গ্রুপের হবে। কেননা বাবা-মায়ের দেহ থেকে সন্তান তার জিনোটাইপে A অথবা B অথবা AB রক্তের যে উদ্দীপনা পেয়েছে, তা থেকে উক্ত অ্যাগ্লুটিনোজেন তৈরি করতে পারছে না বলেই সন্তানের রক্ত হয়েছে O গ্রুপভুক্ত, আর এটি কেবলই সম্ভব হবে যদি রক্তে প্রিকার্সর H অনুপস্থিত থাকে।
বাহ্যিক সকল বৈশিষ্ট্যের পেছনে আমাদের জিন ও ডিএনএ দায়ী। H অ্যান্টিজেন উপস্থিত থাকবে কি থাকবে না, তা-ও নিশ্চয়ই আমাদের জিনে লেখা রয়েছে। এখানেই আমাদের প্রয়োজন মেন্ডেলবাদের। মেন্ডেলবাদের সাহায্যে খুব সহজেই এই ব্যাপারটি উল্লেখ করা সম্ভব।
অ্যাগ্লুটিনোজেন-H এর জন্য দায়ী জিনোটাইপ হলো HH। H হলো মেন্ডেলীয় প্রকট এবং h হলো মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন্ন। ধরা যাক, পিতার জিনোটাইপে উল্লেখ রয়েছে Hh। মেন্ডেলীয় প্রকটের নিয়মানুসারে পিতার রক্তে প্রকট বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশিত হবে, অর্থাৎ অ্যাগ্লুটিনোজেন-H উপস্থিত থাকবে রক্তে। এখন দেখা গেলো, মায়ের জিনোটাইপও Hh। বাবা আর মায়ের জিনোম যদি একই ধরনের হয়ে থাকে, অর্থাৎ জিনোটাইপের পেছনে যে প্রোটিনগুলো কাজ করছে, তা যদি একই ধরনের হয় (কাছাকাছি কোনো গোত্র কিংবা আত্মীয়স্বজনের মাঝেই কেবল এমনটি পাওয়া সম্ভব), তবে তাদের কোনো এক সন্তানের দেহে জিনোটাইপ hh হওয়া সম্ভব।
মেন্ডেলীয় সূত্রাবলী অনুযায়ী, উপরোল্লিখিত বাবা-মায়ের দেহে তিন ধরনের জিনোটাইপ সম্বলিত সন্তান জন্ম নিতে পারবে- HH, Hh, hh। HH কিংবা Hh নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই, প্রকট বৈশিষ্ট্যের জিন একটি উপস্থিত থাকলেই যথেষ্ট, রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-H উপস্থিত থাকবে।
বিপত্তি দেখা দেয় তখনই, যখন জিনোটাইপে প্রকট জিন থাকে না। hh জিনোটাইপে প্রকট জিনের অভাবে রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-H তৈরি হয় না। এখন ডিএনএতে যতই লেখা থাকুক অ্যাগ্লুটিনোজেন-A আর অ্যাগ্লুটিনোজেন-B তৈরির কথা, তৈরি হবে কোথা থেকে! রক্তে যে প্রিকার্সরটিই নেই।
বোম্বে রক্তকে এজন্যই বৈজ্ঞানিকভাবে hh গ্রুপের রক্ত বলে অভিহিত করা হয়। উদ্দীপনা কীভাবে যোগায় জিনগুলো সে ব্যাপারে সংক্ষেপে বলা যায়, জিনগুলো কাঙ্ক্ষিত ট্রান্সফারেজ এনজাইম তৈরির মাধ্যমে প্রিকার্সরটিকে বাধ্য করে রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-A আর B তৈরি করতে। যদি A ও B জিন অনুপস্থিত থাকে, তবে H অ্যান্টিজেন অপরিবর্তিত অবস্থায় রক্তে অবস্থান করে। আমরা একে O গ্রুপের রক্ত বলে শনাক্ত করি।
hh গ্রুপের রক্ত একদম খাঁটি (!), এতে কোনো ভেজাল নেই। অর্থাৎ এই রক্তে কোনো ধরনের অ্যাগ্লুটিনোজেন থাকে না। আর এ কারণেই এই গ্রুপের রক্তবাহী ব্যক্তির শরীরে অন্য কোনো গ্রুপের রক্ত দেয়া যায় না। রক্তে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজেন উপস্থিত না থাকার দরুন, রক্তে সকল অ্যাগ্লুটিনোজেনের বিরুদ্ধে অ্যাগ্লুটিনিন তৈরি হবে, অ্যাগ্লুটিনোজেনের উপস্থিতি টের পেলেই পুরো রক্ততে জমাট বাঁধিয়ে ফেলবে এই অ্যাগ্লুটিনিনগুলো।
এই বোম্বে রক্তকে সবসময় O গ্রুপের রক্ত হিসেবে ভুল নির্ণয় করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে কখনোই H অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয় না কোনো ল্যাবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়তো করিয়ে নেওয়া যেতে পারে। O গ্রুপের রক্ত নির্ণয়ে আলাদা কোনো পরীক্ষা করা হয় না, যদি রক্তটি A অথবা B না হয়, তবে ধরে নেয়া হয় যে, অবশ্যই O গ্রুপের রক্ত হবে। রক্ত যদি O এর হয়, কেবলমাত্র তখনই বোম্বে রক্ত কিনা, সেটি পরীক্ষা করে নেয়া উচিৎ।
O ব্যতীত আপনি যদি অন্য কোনো গ্রুপের রক্তবাহী হন, তাহলে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, এই রক্ত বোম্বে গ্রুপের নয়। অবশ্য এই ব্যাপারে সরকারিভাবেও উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। এই দুর্লভ রক্তবাহী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা উচিত। আমাদের প্রতিবেশী দেশের মতো করেই, যাদের দেহে এই রক্ত পাওয়া যাবে, তাদেরকে প্রয়োজনের সময় রক্তদানে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। এই রক্ত কোনো ব্লাড ব্যাংকেই রাখা হয় না, অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ রক্ত এই বোম্বে রক্ত। যেকোনো রক্তবাহীর প্রয়োজনের সময়ও ব্যবহার করা যাবে এই বোম্বে রক্ত।
আপনারা যারা O গ্রুপের রক্তবাহী, তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আপনাদের রক্ত বোম্বে রক্ত কিনা তা নিশ্চিত করে পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন। সৃষ্টিকর্তা না করুন, এমনটি হলে এবং আপনার কখনো রক্তের প্রয়োজন দেখা গেলে, তখন কিন্তু রক্ত খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টের কাজ হবে। পাওয়া গেলেও তার জন্যও প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হবে। যদি তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন হয়, তখন কিন্তু আপনার জীবন শঙ্কিত হতেও পারে। তাই পরীক্ষা করিয়ে রাখুন, বোম্বে রক্ত যদি নিশ্চিত হয়, তবে এখন থেকেই খোঁজ শুরু করুন এই গ্রুপের রক্তবাহীদের, প্রয়োজনের সময় তাদেরকে দ্রুত সাহায্যের জন্য ডাকা যাবে।
আপনার বোম্বে রক্ত নিশ্চিত করে এখানে রেজিস্ট্রেশন করে রাখতে পারেন। প্রয়োজনের সময় উপকৃত হবেন কিংবা অন্য কারো প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারবেন।
মানুষ যদি একে অপরকে রক্ত না দিতো, তাহলে দৈনিক হাজারো মানুষের মৃত্যু হতো কেবলমাত্র রক্তের অভাবেই। এর জন্য প্রচুর জনমত গড়ে তোলা হয়েছে আমাদের দেশে, অনেকেই আছেন যারা স্বেচ্ছায় নিয়মিত রক্তদান করেন। রক্তদান একটি মহৎ উদ্যোগ, আপনার রক্তদানে একজন মানুষের জীবন বেঁচে উঠে। প্রতি চারমাস পর পর চাক্রিকভাবে দানকৃত রক্ত পুনরায় উৎপন্ন হয়ে থাকে। তাছাড়া রক্ত দান করার অনেকগুলো উপকারও রয়েছে। রক্তের বর্জ্য পদার্থ প্রতিনিয়ত পরিশোধন করে থাকে আমাদের একজোড়া বৃক্ক, প্রতিবার ৪৫০মিলিলিটার রক্ত নেওয়া হয় একজন রক্তদাতার শরীর থেকে। ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত কম থাকায়, বৃক্কের কাজে চাপ কম পড়ে, শরীরে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণও কমে আসে।
তাই আসুন, আমরা সকলে নিজ থেকে রক্তদানে উদ্যোগ গ্রহণ করি, অপরজনকে রক্তদানে উদ্যোগী করে তুলি।
তথ্যসূত্র: Prof. MD. Mozammel Haque(2015). ABC of Medical Biochemistry. Issure 3. p. 504