২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ফ্রান্স আর ইতালির মধ্যকার ফাইনাল ম্যাচের কথা মনে আছে? সেদিন রেগে গিয়ে জিনেদিন জিদান মাথা দিয়ে গুঁতো দিয়েছিলেন মার্কো মাতারাজ্জির বুকে। সেই খেলা আর তার ফলাফল নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি, কমেনি আলোচনা-সমালোচনা। তবে খেলার পরে একটা সময় মাতারাজ্জি স্বীকার করে নেন যে, তিনি খেলার মাঝখানে জিদানের বোনকে খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছিলেন। আর তাই জিদান রেগে গিয়ে মাতারাজ্জির বুকে আঘাত করেন।
ঠিক এমন ঘটনা যে এই প্রথম ঘটছে, তা তো নয়। রোজই কি এমন সব ঘটনার মুখোমুখি আমরা হই না, যাতে আমাদের মেজাজ ঠিক থাকে না? জন্মানোর পর থেকে যখন আমরা বুঝতে শিখি, তখন থেকেই আমাদের রাগের প্রকাশ শুরু হয়। যে শিশুটি এখনো ঠিকমতো কথা বলে উঠতে শেখেনি, সে-ও কিন্তু হাসি, কান্নার পাশাপাশি রাগটাকে ঠিক ঠিক প্রকাশ করে ফেলে। হয়তো সে বসে থাকতে চাইছে না, কোলে উঠতে চাইছে, অথচ যার কোলে উঠতে চাইছে সে বুঝতে পারছে না। এই শিশুটি একসময় চোখ-মুখ কুঁচকে কান্না শুরু করে, তার রাগের বহিঃপ্রকাশ এভাবেই ঘটায় সে।
রাগ কেন হয়?
মা যখন তার সন্তানের উদ্দেশ্যে অভিযোগ করেন, “তুমি এটা কেন করেছো?”, বেশিরভাগ সময়ই তার উত্তর হয় এমন, “আমি করি নি, ও করেছে!” অন্যের ওপর দোষ চাপানোর কিংবা দোষ স্বীকার না করে এড়িয়ে যাওয়ার এই মনোভাব থেকে রাগের শুরু হয়। ইগো বাঁচানোর লড়াই রাগ দিয়ে প্রকাশিত হয়। ছেঁড়া ছেঁড়া হতাশা আর ভয়ের পরিপূরক হিসেবেও প্রকাশিত হয় রাগ।
Treating Attachment Abuse: A Compassionate Approach নামের বইতে লেখক স্টিভেনের কলমে উঠে এসেছে মানুষের কিছু মূল আবেগের কথা, যেমন- অস্বীকৃতি, হতাশা, ভয়, অবিশ্বাস, সন্দেহ, অগ্রহণযোগ্যতা, ক্ষমতাহীনতা, অক্ষমতা, দোষী সাব্যস্ত হওয়া ইত্যাদি, যেগুলো মানসিকভাবে একজন মানুষকে আঘাত করতে পারে। আর এই আঘাতের প্রকাশভঙ্গী উঠে আসে রাগের মাধ্যমে। জিদানের সেই ঘটনার কথাই ধরা যাক। মাতারাজ্জির যে কথায় তিনি অপমানিত হয়েছিলেন, সেই অপমানটিকে তিনি কেবল ‘অপমান’ বলে স্বীকার করে নেননি। বরং তার এই আঘাতের বিপরীতে তিনি মাতারাজ্জিকে আঘাত করেন। অর্থাৎ কোনো মানুষ, হতে পারে সেটি কোনো যুগল অথবা বন্ধু, একজনের কথায় অন্যজন আঘাত পেলে সাধারণত সে কষ্ট পাওয়ার কথা সঙ্গীর কাছে স্বীকার করে না। হতে পারে, সঙ্গী যাতে তাকে দুর্বল না ভাবে এটা বোঝানোর জন্যই সে কষ্ট পাওয়ার কথা এড়িয়ে যায় এবং নিজেকে আঘাত নিতে সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য উল্টো আঘাত করে।
রাগের জন্মস্থান কোথায়?
মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্স এমন একটি জায়গা, যেখানে চিন্তা-ভাবনা আর বিচার-বিবেচনার কাজগুলো তৈরি হয়। এই কর্টেক্স আবার দুটো আলাদা আলাদা লোবে বিভক্ত থাকে। কর্টেক্সের পাশাপাশি মস্তিষ্কের নিচের অংশে আরো একটি মজার অংশ থাকে, যার কাজ কর্টেক্সের ঠিক উল্টো না হলেও সাংঘর্ষিক। এই অংশের নাম লিম্বিক লোব, যাকে মানুষের আবেগের বাস্তুভিটা ধরা হয়। যখন কোনো মানুষ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, তখন তার মস্তিষ্কের কর্টেক্স অংশের চেয়ে লিম্বিক অংশ বেশি কাজ করে বা বলা যায়, কর্টেক্সের কাজকে প্রশমিত করে ফেলে।
আজকে তোমার আমিগডালা কেমন ছিলো?
প্রতিটি বাস্তুভিটাতে তো একটা স্টোর রুম থাকে, তাই না? লিম্বিক সিস্টেমের এই স্টোর রুমের নাম হলো আমিগডালা– সিস্টেমের ভেতরের ছোট্ট একটি অংশ। এই আমিগডালা হলো অভিজ্ঞতার স্মৃতির খনি বা স্টোর রুম। কোনো একটি ঘটনা ঘটার পর এই রুমে থাকা স্মৃতিগুলো হাতড়ে হয় লিম্বিক সিস্টেমে সিগনাল পাঠানো হয়, নতুবা পাঠানো হয় কর্টেক্সে। লিম্বিক সিস্টেমে সিগনাল গেলে, মানুষ উপস্থিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবেগী সিদ্ধান্ত নেয়। আর কর্টেক্সে পাঠানো হলে, সে বর্তমান ঘটনার বিচার ব্যবচ্ছেদ করতে বসে।
ধরা যাক, চার-পাঁচজন ছিনতাইকারী এসে একজন মানুষকে ঘিরে ধরে তার কাছ থেকে সব কেড়ে নিতে চাইলো, নইলে তাকে মেরে ফেলা হবে বলে ভয় দেখালো। এই আমিগডালা তখন ছিনতাই সম্পর্কিত ব্যক্তিগত কিংবা অন্যের সাথে হওয়া জানা ঘটনার স্মৃতি ঘেঁটে কর্টেক্সের মাধ্যমে তাকে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত পাঠাতে থাকবে। কারণ একটি ঘটনা বিচার ব্যবচ্ছেদ করে সিদ্ধান্ত নেয়া কর্টেক্সের কাজ। ফলে মানুষটি তার কাছে থাকা সব মূল্যবান কিছু ছিনতাইকারীদের দিয়ে দেবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যাবার সুযোগ পাবে। কিন্তু যদি কখনো লিম্বিককে সিগনাল পাঠিয়ে ফেলে, তবে মানুষটি বিচার-বিবেচনা হারিয়ে যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। আবেগের বশে হয়তো সে তার কাছে থাকা মূল্যবান জিনিসগুলো ছিনতাইকারীদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, কিংবা গায়ের জোরে প্রতিবাদ ও নিরস্ত্র অবস্থায় উল্টো আঘাত করে বসতে পারে। আর দুটো ক্ষেত্রেই তার জীবনের ওপর হুমকি চলে আসার আশঙ্কা থেকে যায়।
আমিগডালা থেকে কর্টেক্সকে সিগনাল না পাঠিয়ে এই যে লিম্বিককে সিগনাল পাঠানোর ঘটনা ঘটে, এ ঘটনাও কিন্তু এক ধরনের ছিনতাই! একে বলে আমিগডালা হাইজ্যাকিং। আর এই হাইজ্যাকিংয়ের কারণে দু’ধরনের হরমোনের বন্যা বয়ে যায় শরীরে; যার কারণে কোনো একটি ঘটনায় মানুষ পুরোপুরি জ্ঞানশূন্য আচরণ করে। এক ধরনের হরমোন কয়েক মিনিটের মতো শরীরে থেকে অল্প সময়ের জন্য কাজ করে, আর অন্যগুলো কাজ করে অনেক সময় ধরে, কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্তও।
আক্রমণাত্মক মনোভাব বনাম খাবার ও সেক্স
মানুষের সাধারণ জেনেটিক মেক-আপেই পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার সূত্র দিয়ে দেয়া আছে। সেই সূত্র অনুযায়ী খাবার, পানি, ওষুধ যেমন প্রয়োজন; তেমনি পৃথিবীতে তার প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেক্সের প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে মানুষের আক্রমণাত্মক মনোভাব বা রাগের প্রকাশ ঘটে থাকে তার এই সমস্ত জৈবিক প্রয়োজনের ওপর আশঙ্কাজনক আঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। সৃষ্টির শুরুতে আরো মেরুদণ্ডী প্রাণিদের মতো কেবল অন্য জীবকে মেরে নিজের খাবারের ব্যবস্থা করার, অন্য গোত্রের সাথে যুদ্ধ করে বাসস্থানের জায়গা নির্ধারণের আর সঙ্গীকে নিজের সন্তান জন্মদানে অনুমিত বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য মানুষের মাঝে এই আক্রমণাত্মক মানসিকতা তথা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক অন্য প্রাণিদের মতো গঠনগত দিক থেকে সাধারণ নয়। সত্যি বলতে, এই অসম্ভব জটিল বিন্যাসের কারণে আমিগডালা থেকে সিগনাল কর্টেক্সে কিংবা লিম্বিক লোবে যাওয়ার পথগুলো খুব সরল নয়।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট সাপোস্কির গবেষণায় উঠে আসে মানুষের এই জটিল মস্তিষ্কের উৎপত্তি, বিবর্তনগত গঠন, জিনগত বৈশিষ্ট্য, অভিজ্ঞতার স্মৃতি, মস্তিষ্কের সিগনালিংয়ের প্রেক্ষিতে হরমোনের ক্ষরণ এবং একেকটি ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের আচরণগত প্রতিক্রিয়ার কথা। তিনি দেখান, আমিগডালায় সংরক্ষিত থাকা মানুষের স্মৃতিশক্তি কীভাবে মাথার কোষগুলোর ভেতরের যোগাযোগকে আরো দৃঢ় করে। যার কারণে একই রকম একটি বর্তমান ঘটনার প্রতিউত্তরে মস্তিষ্ক থেকে এই সিগনাল পাঠানোর প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত এবং সূক্ষ্ম হয়। অন্যভাবে এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতিটি নতুন ঘটনার সময় মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক বেশি দ্বিধায় ভোগে এবং আমিগডালা তখন লিম্বিক লোবের মাধ্যমে একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়। শিশুদের ক্ষেত্রে যেটা নিজের দোষ এড়িয়ে গিয়ে ঘটনার প্রেক্ষিতে অন্য কাউকে আঘাত করে, দোষী করে কথা বলার মাধ্যমে শুরু হয় আর জিদানের মতো পূর্ণবয়স্ক মানুষের কাছে গিয়ে আগের স্মৃতি ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক অন্যকে আঘাত করার মাধ্যমে গিয়ে শেষ হয়।
আমিগডালার সিগনাল পাঠানোর এই জটিল পথটা কি হাইজ্যাকিং এর হাত থেকে বাগিয়ে নিয়ে আমরা অন্য কোনোভাবে ঠিক কাজে লাগাতে পারি? এর ব্যাখ্যা থাকছে আগামীতে কোনো এক লেখায়।