বেশ কয়েক বছর আগেও সকলের ধারণা ছিল, প্রাণ ধারণের উপযোগী গ্রহ শুধু এই সূর্যের পরিবারেই আছে। অন্য কোথাও এত উপযুক্ত গ্রহের অস্তিত্ব নেই। আসলে তাদেরকে দোষ দেয়া যায় না, কারণ তখনো জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তেমন উন্নত হয়নি। এমনকি ভালো মানের টেলিস্কোপ দিয়েও দূরবর্তী গ্রহ দেখা যেত না। আর এ ধরনের টেলিস্কোপ দিয়ে তো দূরের গ্রহ দেখাই যেত না। না। দূরের গ্রহ যেহেতু খালি চোখে দেখা যায় না, তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না উপযুক্ত যন্ত্র তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের এ বিষয়ক জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তারপরেও ভালো, তারা মিথ্যা বা অতি-কল্পনার আশ্রয় নিয়ে বাহ্যগ্রহ সম্পর্কে বানোয়াট গল্প তৈরি করে বসেননি।
আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের কাছে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী যন্ত্রপাতি আছে এবং এগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা জানতে পারি, পৃথিবী ছাড়াও আরো অনেক গ্রহ আছে যেখানে প্রাণের বসবাস থাকা সম্ভব। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিক গ্রহ আবিষ্কার করে চলছেন।
বিজ্ঞানীরা প্রতিদিন গ্রহ আবিষ্কার করে চলছেন- এরকম কথা শুনলে সম্ভবত কারো কারো মনে মনে ধারণা হতে পারে, বিজ্ঞানীরা খুব বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ তাক করে এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকেন এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গ্রহ শনাক্ত করেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আসলে এভাবে গ্রহ আবিষ্কার করেন না। এভাবে নতুন গ্রহ আবিষ্কার করা যায় না। এটা এক প্রকার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। এত দূর থেকে গ্রহগুলোকে দেখতে হলে, গ্রহদের যে পরিমাণ উজ্জ্বল হওয়া প্রয়োজন, সেগুলো সে পরিমাণ উজ্জ্বল নয়। গ্রহের নিজস্ব কোনো আলো নেই। গ্রহ যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে, সেই নক্ষত্রের আলো গ্রহে এসে প্রতিফলিত হয়। আর এই আলো এতটাই স্বল্প যে, এত দূর থেকে শনাক্ত করার জন্য তা একদমই অপ্রতুল।
মোদ্দা কথা আমরা এদেরকে ‘সরাসরি’ শনাক্ত করতে পারবো না। এদেরকে শনাক্ত করতে হলে ভিন্ন রাস্তায় পরোক্ষ উপায়ে চেষ্টা করতে হবে। পরোক্ষ উপায়ে গেলে আমাদেরকে দ্বারস্থ হতে হবে বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র বা স্পেকট্রোস্কোপের কাছে। এই যন্ত্রের কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্বে Roar বাংলায় ‘বর্ণালীবীক্ষণ যেভাবে দূরের গ্রহ নক্ষত্রের তথ্য জানায়‘ শিরোনামে আলোচনা হয়েছিল।
আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে যখন প্রায় সমান পরিমাণ ভারী দুটি বস্তু পরস্পর কাছাকাছি অবস্থান করে, তখন তারা উভয়েই উভয়কে আবর্তন করতে থাকে। যেমন- প্রায় সমান ভরের দুটি নক্ষত্র যদি কাছাকাছি অবস্থান করে, তাহলে তারা একে অপরকে আবর্তন করবে। এরকম পরস্পর আবর্তনকারী নক্ষত্রও আছে অনেক। আকাশে যে সকল নক্ষত্রকে খুব বেশি উজ্জ্বল হিসেবে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অনেকগুলোই এরকম পরস্পর আবর্তনকারী নক্ষত্র।
এ ধরনের নক্ষত্র ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘যুগল নক্ষত্র’ বা ‘বাইনারি স্টার’। তাদের আবর্তনের পথ কিছুটা অদ্ভুত রকমের হয়। একবার সামনে, একবার পেছনে- এরকম করে তাদের আবর্তনের যে পথ রচিত হয়, তা আকারের দিক থেকে অনেকটা মুগুরের মতো। মনে হবে যেন একটা অদৃশ্য রশি দিয়ে তারা পরস্পর বাঁধা।
এরকম ক্ষেত্রে কোনো একটি বস্তু যদি অপরটি থেকে তুলনামূলকভাবে ছোট বা কম ভারী হয়, তাহলে ছোট বস্তুটি বেশি ঘুরবে আর বড় বস্তুটি কম ঘুরবে। এরকম একটি উদাহরণ হচ্ছে স্বয়ং আমাদের পৃথিবী ও সূর্য। আমরা সকলেই হয়তো জানি, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, পৃথিবীর ভরও অনেক বিশাল এবং এই পরিমাণ ভরের মহাকর্ষীয় শক্তিকে ব্যবহার করে সূর্যকে অল্প হলেও প্রভাবিত করা সম্ভব। সূর্যও আসলে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে, তবে তার পরিমাণ খুব সূক্ষ্ম বলে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।
গ্রহ যদি বৃহস্পতির মতো বিশাল ও ভারী হয়, তাহলে এরকম গ্রহ কর্তৃক আকর্ষণের টান সহজে দেখা যাবে। বৃহস্পতি গ্রহ সূর্যকে বেশ শক্তিশালী বলে আকর্ষণ করছে এবং সূর্য তাতে সাড়া দিয়ে আবর্তনও করছে। এই আবর্তনের পরিমাণ মোটামুটি বেশি, যার কারণে সূর্য ও বৃহস্পতির পারস্পরিক আবর্তন সহজে ধরা পড়ে। সূর্য ও বৃহস্পতির মতো এরকম অনেক নক্ষত্র ও গ্রহ আছে, যারা একে অপরকে আবর্তন করে। গ্রহ-নক্ষত্রের পারস্পরিক আবর্তনের এই বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। কীভাবে? প্রক্রিয়াটা বেশ মজার।
বিজ্ঞানীরা আসলে দূরবর্তী গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তন বা চলাকে ‘দেখেন না’ বা দেখতে পারেন না। কারণ তাদের দূরত্ব এতই বেশি যে, অনেক বেগে চললেও তা নজরে আসে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, খুব গতিশীল কোনো বস্তু অনেক দূরে অবস্থান করলে তাকে ধীরগতির মনে হয়। নক্ষত্রগুলো এতই দূরে অবস্থান করে যে, তাদের গতি ধীর হতে হতে একদম শূন্য বলে মনে হয়। তবে বিজ্ঞানীরা আবর্তন দেখতে না পারলেও তাদের বেগ পরিমাপ করতে পারেন। কোনো কিছু দেখেন না কিন্তু এর গতি পরিমাপ করতে পারেন, এরকম কিছু শুনলে ব্যাপারটাকে বেশ অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। মূলত বিজ্ঞানীরা এখানে বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে অদ্ভুত ব্যাপারটাকেই স্বাভাবিকতায় নিয়ে এসেছেন।
আলোক রশ্মির ডপলার প্রভাবের কথা মনে আছে? বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের ভেতর দিয়ে কোনো আলোক রশ্মি প্রেরণ করলে সেটি বিভিন্ন বর্ণে বিশ্লিষ্ট হয়ে একটি সজ্জা তৈরি করে। উৎস যদি যন্ত্র থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যায়, তাহলে সজ্জাটি একদিকে সরে যাবে (ঐদিকে বর্ণালীর লাল অংশ থাকে)। আর উৎস যদি যন্ত্রের কাছে আসতে থাকে, তাহলে আলোর সজ্জা উল্টোদিকে সরে যাবে (ঐদিকে নীল অবস্থান করে)।
যদি কোনো নক্ষত্রকে আবর্তনকারী ভারী গ্রহ থাকে এবং নক্ষত্র সেই গ্রহের আকর্ষণে প্রভাবিত হয়, তাহলে ঐ নক্ষত্রের চলাচল এলোমেলো হবে। একবার সামনে যাবে, আবার পেছনে আসবে। আবার সামনে যাবে, আবার পেছনে সরে আসবে।
ফলে বিলিয়ন বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে এই পৃথিবীতে স্থাপিত বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রে নক্ষত্রের বর্ণালীরেখা একবার লালের দিকে যাবে আরেকবার নীলের দিকে আসবে। এভাবে চক্রাকারে লাল-নীল-লাল-নীল-লাল-নীল চলতেই থাকবে। যদি কোনো নক্ষত্র এরকম চক্রাকার বর্ণালী প্রদান করে, তাহলে বিজ্ঞানীরা ধরে নেন এই নক্ষত্রের মাঝে ভারী কোনো গ্রহ আছে। অথচ বিজ্ঞানীরা এই গ্রহটিকে দেখতে পাননি, কারণ গ্রহটির কোনো আলো নেই। পরোক্ষভাবে বর্ণালীকে ব্যবহার করে তারা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যান। এজন্যই বলতে হয়, পদার্থবিজ্ঞান আসলেই জাদুর খেলা!
শুধু তা-ই নয়, লাল অংশ থেকে নীল অংশে যেতে একটি নক্ষত্রের যে পরিমাণ সময় লাগে তা থেকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলে দিতে পারেন, ঐ গ্রহে কত দিনে এক বছর হয় তথা কত সময়ে গ্রহটি নিজের কক্ষপথকে আবর্তন করে। আমাদের পৃথিবী তার কক্ষপথকে প্রায় ৩৬৫ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে, তাই এখানে ৩৬৫ দিনে এক বছর। অন্যান্য গ্রহে এই সময়ের হেরফের হয়। কোনো কোনো গ্রহের বেলায় এর চেয়ে কম সময় লাগে, আবার কোনো কোনো গ্রহের বেলায় এর চেয়ে বেশি সময় লাগে।
নক্ষত্র ব্যবস্থায় যখন কয়েকটি গ্রহ থাকে এবং নক্ষত্রটি সকল গ্রহের আকর্ষণে কম-বেশি সাড়া দেয় তখন হিসাবের মধ্যে বেশ জটিলতার জন্ম হয়। এক গ্রহের আকর্ষণের সাথে আরেক গ্রহের আকর্ষণ মিলে একটা তালগোল পাকানো অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে একটি গ্রহের তথ্য উদ্ধার করে আনা অবশ্যই খুব কঠিন কাজ। কিন্তু আমাদের জ্যোতির্বিদরা খুব বুদ্ধিমান এবং গণিতে বেশ দক্ষ। তারা গাণিতিক কৌশলকে ব্যবহার করে এসব জটিলতাকে উৎরে গ্রহ সম্বন্ধে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই বর্ণালী পদ্ধতি ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত অনেক অনেক গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এর পরিমাণ বেড়েই চলছে।
গ্রহ শনাক্ত করার জন্য এটি ছাড়াও আরো কয়েকটি পদ্ধতি আছে। এদের মাঝে একটি হচ্ছে ছায়া বা গ্রহণ পদ্ধতি। যদি কোনো নক্ষত্রের দিকে আমরা টেলিস্কোপ তাক করি এবং ঐ সময়ে ঐ বরাবর কোনো গ্রহ তার কক্ষপথে আবর্তন করে, তাহলে গ্রহটির কারণে একটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। গ্রহের আড়ালের কারণে নক্ষত্রের একটি অংশ দেখা যাবে না। টেলিস্কোপে ঐ অংশটিকে কালো ফুটকি হিসেবে দেখা যাবে। কালো ছোট দাগটি যদি স্থির না থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে তাহলে ধরে নিতে হবে এটি ঐ নক্ষত্রের একটি গ্রহ, যা নক্ষত্রটিকে আবর্তন করছে। এই পদ্ধতিতেও অনেকগুলো গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই দুটি ছাড়াও গ্রহ শনাক্ত করার আরো কয়েকটি পদ্ধতি আছে। সেসব পদ্ধতিতেও অনেকগুলো গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে।
আর দূরবর্তী গ্রহ নক্ষত্র কত দূরে আছে, সেটা কীভাবে নির্ণয় করে? দূরত্ব নির্ণয় করার জন্য ‘প্যারালাক্স পদ্ধতি‘, ‘ভ্যারিয়েবল স্টার পদ্ধতি’ প্রভৃতি আছে। সেখানেও কাজ করছে পদার্থবিজ্ঞানের জাদুর খেলা। দূরবর্তী গ্রহ নক্ষত্রের ধারে কাছে না গিয়েই বিজ্ঞানের কিছু ট্রিক ও গণিতকে কাজে লাগিয়ে জেনে নেয়া যায় সেসব গ্রহ সম্পর্কে। গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্ব বের করার পদ্ধতি নিয়ে ‘বিজ্ঞানীরা দূরবর্তী গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয় করেন কীভাবে‘ শিরোনামে স্বতন্ত্র একটি লেখা আছে Roar বাংলায়। বিজ্ঞানের এমন চমকপ্রদ ব্যবহার দেখলে বিজ্ঞানকে আসলেই অনেক জাদুময় বলে মনে হয়।
ফিচার ছবি: বিজনেস ইনসাইডার/নাসা/JPL-Caltech