দু’বছর আগের কথা, ২০১৬ সালে বিজয়ের মাস, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। চোখ আটকে গেলো ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ অনুষ্ঠানের একটি ফেসবুক পোস্টে। যারা এ অনুষ্ঠানের কথা জানেন না তাদের আগেই বলে রাখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কেন্দ্রিক সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিজয় দিবস উপলক্ষে একত্রে প্রতিবছর ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আয়োজন করে এ অনুষ্ঠানের। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে, সংগঠনগুলো পর্যায়ক্রমে তাদের পরিবেশনা নিয়ে আসে মঞ্চে। পোস্টে উল্লেখ ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ব্যান্ড সোসাইটি’র (ডিইউবিএস) আয়োজনে বিজয় কনসার্টে ব্যান্ড পরিবেশনার কথা।
টিএসসির সামনে, পায়রা চত্বরে ‘ওপেন এয়ার ‘কনসার্টে বিজয় দিবস উপলক্ষে একাধিক ব্যান্ড একই মঞ্চে বাজাবে- এ ব্যাপারটাই অন্য রকম। তবে আসল চমক তখনও বাকি ছিল। স্ক্রল ডাউন করতেই দেখি ৪৪ বছর পর টিএসসিতে আসছেন বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার। তাকে দেখার সুযোগ কী কেউ হাত ছাড়া করতে চাইবে? তাই ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গিয়ে উপস্থিত হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে।
বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার ও টিএসসি
জর্জিনা হক, বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার। ভেবেছিলাম ৪৪ বছর পর যিনি আসছেন, হয়তো বয়সের ভারে তার আর ড্রাম স্টিক্স ধরা সম্ভব হবে না। কিন্তু তাকে দেখে তো হতবাক, এ যে বয়স্ক এক তরুণী! গিটার বাজিয়ে, গান গেয়ে আর ড্রামস বাজিয়ে দর্শকদের পুরো মাতিয়ে রাখলেন তিনি। বার্ধক্য যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে এটি যে অনেক বেশি মানসিক তা তিনি সেদিন বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ করে দিলেন। ব্যান্ড ল্যাম্পোস্ট-এর সাথে এসেছিলেন তিনি, ঠিক ৪৪ বছর পর।
মঞ্চে উঠে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ৪৪ বছর আগে টিএসসি-তে বাজানোর সে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা আবেগভরা কন্ঠে সকলকে শোনান তিনি। সেদিন জর্জিনা হকের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এরপর তার পরিবেশনা চলাকালেই শুরু হয়ে যায় ১৬ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর এবং এর সাথে চলতে থাকে বিজয় দিবসের আতোশবাজী।
স্বাধীনতার পরবর্তী বছর ১৯৭২ সালে প্রথম বিজয় জয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে শেখ কামাল (বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে) এর পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত ব্যান্ড ‘স্পন্দন’ এর সাথে ড্রামস বাজিয়েছিলেন জর্জিনা হক। তখন তিনি ছিলেন ১৬ বছরের এক তরুণী।
১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ টিএসসি-তে আসার আগেই ঢাকা টাইম্স-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“৪৪ বছর পর আবার সেই টিএসসিতে বাজাবো। মনে হচ্ছে একটা টাইম মেশিনে করে সেই ১৯৭২ এ ফেরত যাচ্ছি। তখন আর এখনকার মধ্যে তো অনেক পার্থক্য। জানি না লোকজন কেমন হবে, কেমন ভাবে নেবে আমাকে, এতোদিন পর বাজাবো। আমার এখনো মনে আছে সেদিন স্পন্দনের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, আর আমি বোকা মেয়ের মতন মাথা নিচু করে ড্রাম টিউন করছিলাম। কামাল ভাই বললেন জর্জিনা মাথা উঁচু করে দাড়াও। কামাল ভাই যে আজ নেই, সাহস দেয়ারও কেউ নেই, টিএসসিতে খুব ফিল করবো এটা।” তিনি আরো বলেন, “আশা করি ভেঙে পড়বো না, অবশ্য বয়সও তো হয়েছে। জানি না কি হবে। কেঁদে না ফেলি আবার। কাঁদলে তো গানের বারোটা বেজে যাবে।”
জর্জিনা হক এবং ড্রামস
‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ (সাবেক আয়োলেটস) ব্যান্ডের ড্রামার সাব্বির কাদেরের বাজানো দেখে ড্রামস বাজাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জর্জিনা হক। এটি তাকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে, ১২ বছর বয়সেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, তাকে ড্রামসই বাজাতে হবে। তিনি বলেন,“বার বছর বয়সে আমি রান্না ঘরের বাসনপত্রে ড্রামস অনুশীলন করতাম।”
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফরমাজুল হকের কন্যা জর্জিনা হকের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। ফরমাজুল হক ছিলেন সে সময়ের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ একজন। জর্জিনা হকের দশ ভাই বোনের সকলেরই ছিল গান-বাজনার প্রতি কমবেশি আগ্রহ। নগরীর শান্তিনগর এলাকায় থাকতেন তারা। নয়ন মুন্সীর মত বিখ্যাত গিটারিস্ট ছিলেন এ বাড়ির একজন। নয়ন মুন্সী গিটার বাজাতেন পপ-সম্রাট আজম খানের সাথে। ঐ সময়ের চারটি ব্যান্ড তৈরি হয়েছিল এ বাড়ি থেকেই।
বড় ভাই আলমগীরের ব্যান্ড ছিলো উইন্ডি সাইড অব কেয়ার। তারা যখন অনুশীলনের মাঝে বিশ্রাম নিতেন তখন জর্জিনা লুকিয়ে ড্রামস সেটে বসে অনুশীলন করতেন। তার শেখার আগ্রহ এতই প্রবল ছিল যে, তিনি ইটভাঙ্গা নারী শ্রমিকদের সাথে বসে ইট ভাঙ্গার তালের সাথে বাজানোর অনুশীলন করতেন। একদিন শেখ কামাল তাকে এমনভাবে অনুশীলন করতে দেখে ফেলেন।
বিএএফ শাহীন স্কুলে পড়ত জর্জিনা হক ও তার ভাই-বোনেরা। একই স্কুলে পড়তেন শেখ পরিবারের সন্তানেরাও। সেই সুবাদে পূর্ব পরিচিত ছিলেন তারা। যেহেতু জর্জিনা হকের কোনো ড্রামস ছিল না, শেখ কামাল তাকেস্পন্দন ব্যান্ডের সাথে অনুশীলন করতে বলেন। এভাবেই স্পন্দনের সাথে যুক্ত হন তিনি এবং শেখ কামালেরই উৎসাহে ’৭২ সালে টিএসসিতে ড্রামস বাজিয়ে ছিলেন তিনি। সেটিই ছিল তার প্রথম নারী ড্রামার হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এরপর আর সেভাবে জনসম্মুখে বাজানো না হলেও তিন বোন মিলে গঠন করা ব্যান্ড ‘থ্রি হাগস সিস্টারস’। সে সময়ে বেশ কিছু ছোটখাটো অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন। এর মধ্যে বেইলি রোডের মহিলা একাডেমি, হলি ক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রেসকোর্স ময়দানে ছিল কয়েকটি অনুষ্ঠান। বিয়ের পর স্বামী-সন্তানসহ বহু বছর ছিলেন বিদেশে।
বিয়ের পর কি তাহলে বাজানো ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি? না, তিনি বাজানো ছাড়েননি। সেভাবে কোনো ব্যান্ডের সাথে না বাজালেও চর্চা চালিয়ে গেছেন বরাবরই। প্রবাসে থাকাকালে বিশেষ অনুরোধে দু-একটা অনুষ্ঠানে বাজিয়েছেন তিনি। বিয়ের পরের গল্প মনে করে মজার এক স্মৃতির কথা শোনান তিনি। বিয়ের পর দিন শ্বাশুড়ী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কী পারো?” তিনি বুঝতে পারেননি শ্বাশুড়ী কী জানতে চাইছেন এবং তিনি সরল ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি ড্রামস বাজাতে পারি।”
নারী, ড্রামস ও বাংলাদেশ
ষাট-সত্তরের দশকে বাদ্যযন্ত্র বিশেষ করে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র বাজানো ছেলেদের কাজ- এমন একটা ধারণা মানুষের মাঝে কাজ করতো। তাই নারীদের পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র বাজানো খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। জর্জিনা হকের আগ্রহ ও মনোবলের জোরেই এমন বৈরি পরিবেশেও তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিলেন।
আমাদের দেশের নারীদের আগের তুলনায় এখন পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র বেশি বাজাতে দেখা গেলেও ড্রামস বাজাতে দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকজন নারীকে। মেয়েদের জন্য ড্রামস বাজানো কষ্টের বা ড্রামস মেয়েদের জন্য উপযুক্ত বাদ্যযন্ত্র নয় এমন মানসিক প্রতিবন্ধকতা হয়তো অনেক নারীই অতিক্রম করতে পারেননি। এছাড়া সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মত বড় বাধা তো আছেই। এ প্রসঙ্গে জর্জিনা হক সত্তরের দশকে তার অভিজ্ঞতার কথা জানান।
অনেকেই নানা ধরনের কথা শোনাতেন তার ড্রামস বাজানোকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে যে শুধু পুরুষরা ছিল তা নয়, ছিল অনেক নারীও। তাদের কোনো কথায় কান না দিয়ে তিনি চর্চা করে গেছেন নিজের মত। পরবর্তীতে তিনি যখন ব্যান্ডের সাথে বাজানো শুরু করলেন তখন অনেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে শুরু করল এবং কেউ কেউ নিজের সন্তানদের পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতে শুরু করলেন। সাধনা ও শিক্ষার জোরে মেয়েরা সকল বাধা অতিক্রম করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন,
“মেয়েদের তাকে দেখতে কেমন লাগছে, তার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বরং গুরুত্ব দেয়া উচিৎ গানের চর্চার প্রতি।”
ষাটোর্ধ্ব জর্জিনা হকের মাঝে যে তারুণ্য ও সংগীতের প্রতি ভালবাসা রয়েছে তা সত্যিই প্রেরণা সঞ্চার করার মতো। শেষ করবো কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের গান-এর অংশ বিশেষ দিয়ে-
“বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে…”
ফিচার ইমেজ- রাফিজ ইমতিয়াজ