আগ্রহ ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনো কর্মক্ষম ব্যক্তির কাজ খুঁজে না পাওয়ার পরিস্থিতিকে বলা হয় বেকারত্ব। ধরন অনুসারে বেকারত্বকে বেশ কয়েকটি শ্রেণীবিভাগ করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে স্থায়ী বেকারত্ব, অস্থায়ী বেকারত্ব, সাময়িক বেকারত্ব, মৌসুমি বেকারত্ব ইত্যাদির কথা বলা যায়। যে ধরনের বেকারত্বই হোক, এই পরিস্থিতি ব্যক্তি তো বটেই, পরিবার, দেশ, জাতির জন্য একটি ভয়াবহ সমস্যা। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশেও এই সমস্যা প্রকটভাবেই বিদ্যমান।
বাংলাদেশে বেকারত্বের অবস্থা
বাংলাদেশে বেকারদের সংখ্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া কষ্টকর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল ২৬ লাখ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে ৮০ হাজার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে আরেকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোন মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ। আরো আছে প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ দিনমজুর, যাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার গত জানুয়ারীতে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সাথে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার ছিল ২০১০ সালে, যার সংখ্যা ছিল ২০ লাখ। ২০১২ সালে যা দাঁড়ায় ২৪ লাখে। ২০১৬ সালে তা ২৮ লাখে উঠেছে। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, সহসাই এটি কমার সম্ভাবনা নেই বরং ২০১৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩০ লাখে ওঠার আশঙ্কা করছে তারা।
তবে এই সংখ্যাগুলোকে দেশের বেকারত্বের বাস্তব চিত্র ভাবলে ভুল হবে। এই জরিপে শুধু তাদেরকে বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ পাননি। বেকারদের চিহ্নিত করতে এই মানটি আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দেওয়া। সেই সাথে আইএলও’র আরেকটি মানদণ্ড হচ্ছে, “কাজের বাইরে আছেন চার সপ্তাহ ধরে, কাজ খুঁজছেন অথচ পাননি, আগামী পনের দিনের মধ্যে কাজ পেতে পারেন কিংবা আগামী পনের দিনের মধ্যে কাজ শুরু করবেন” এমন কর্মক্ষমদের বেকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
অতএব, স্পষ্টতই এই মানদণ্ড অনুযায়ী করা জরিপে দেশে বেকারদের প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়। তাছাড়া, আরেকটি বিষয় হচ্ছে কর্মক্ষম জনশক্তি ও শ্রমশক্তি দুটোকে দেখা হয় আলাদা করে। যেমন ২০১৬-১৭ অর্থবছরে, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৯১ লাখ। অপরদিকে সর্বমোট শ্রমশক্তির সংখ্যা ধরা হয়েছে, ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। অতএব, কর্মক্ষম কিন্তু শ্রমশক্তিতে যোগই হয়নি ৪ কোটি ৮২ লাখ মানুষ! এর মধ্যে নারীর সংখ্যা তিন কোটি ৬৩ লাখ ৩৩ হাজার এবং পুরুষ এক কোটি ১৯ লাখ ৪৭ হাজার। শ্রমশক্তির বাইরে এই লোকজনও কিন্তু বেকার! তারমানে সবমিলিয়ে সরকারি হিসেবেই বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি!
বেকারদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না, বিষয়টি তা নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জনশক্তি জরিপে দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরেই নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩ লাখ মানুষের। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেড়ে গেছে বেকারের সংখ্যা। যার অর্থ দাঁড়ায়, নতুন যুক্ত হওয়া জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য যে ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়।
সম্প্রসারিত হচ্ছে না বৈদেশিক কর্মসংস্থান
বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণে অন্যতম একটি খাত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জনবল রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬.৮৫ লাখ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যা ছিল ৫.৫৬ লাখ। সেই সাথে বেড়েছে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির হার। তবে দশ বছর আগে ২০০৮ সালে জনবল রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮.৭৬ লাখ। সেই হিসাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংখ্যাটি মোটামুটি স্থিতিশীল হলেও জনবল রপ্তানির জন্য বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হয়নি।
শিক্ষিতরাই বেশী বেকার, নারীরাও পিছিয়ে
বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেকারদের সংখ্যা বেশি। যারা লেখাপড়া করেননি বা অল্প লেখাপড়া করেছেন সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার তাদের মধ্যেই। এবং এটি ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাবে তরুণ বেকারদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের হার ছিল ১২ দশমিক ১১ ভাগ। এক বছরের ব্যবধানে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৪ ভাগে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। কিন্তু এর অর্ধেকই বেকার হয়ে পড়ে কিংবা চাহিদামত কাজ পায় না।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির মধ্যে পুরষ ৪.১২ কোটি ও নারীর সংখ্যা মাত্র ১.৬৮ কোটি। নারীদের মধ্যে অধিকাংশই কাজ করেন পরিবারের মধ্যে। এবং পরিবারের মধ্যে কাজ করা নারীরা স্বভাবতই কোনো পারিশ্রমিক পান না। তবে আশার বিষয় যে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও দিনমজুর ও কৃষিখাতে কাজ করা অধিকাংশ মানুষই মৌসুমি বেকারত্বের শিকার হন। বছরের একটি উল্লেখযোগ্য সময় তাদের হাতে কাজ থাকে না।
বেকারত্বের কারণ ও শিক্ষাব্যবস্থার দায়
বাংলাদেশে বেকারত্বের মুল কারণ জনসংখ্যা বাড়ার অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া। তবে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাড়ছে এই সংখ্যা। তবে বিনিয়োগের অভাব, আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়া, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি না ঘটা, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতির প্রয়োজনীয় বিকাশ না ঘটা, দক্ষ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অভাব, অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কায়িক শ্রমে অনীহা, সীমাহীন দুর্নীতিসহ সহ নানা কারণেই বাড়ছে বেকারত্বের হার।
একটি বিশাল জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত না করতে পারার দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এড়াতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষি নির্ভর। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, শিক্ষাব্যবস্থায় কৃষির অবস্থান এতটাই গৌণ যে, কোনোমতেই তা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কৃষিকে উন্নত ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো নয়। সেই সাথে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বড় খাতগুলো যেমন পোশাক, চামড়া, ওষুধশিল্প ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে শিক্ষা ব্যবস্থা ভয়াবহ রকম পিছিয়ে। অল্প কিছু কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা কতটা সমসাময়িক, সে প্রশ্ন তো আছেই!
অপরদিকে, একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেকারত্বের জন্য অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও মেধাহীনতা দায়ী। যার জন্য দায়ী করা যায় প্রথমত, প্রয়োজনীয় কাজের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার মিল না থাকা। দ্বিতীয়ত বলা যেতে পারে, জ্ঞানচর্চার আগ্রহ না থাকা, শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতিসহ নানা বিষয়কে। কারণ, প্রতিবছরই উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করা অর্ধেক শিক্ষিত কর্মক্ষম মানুষ বেকার থেকে যাচ্ছেন অথবা যোগ্যতা অনুসারে প্রয়োজনীয় কাজ পাচ্ছেন না। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের কর্মক্ষেত্রে বাড়ছে বিদেশি কর্মকর্তার সংখ্যা। কারণ একটাই, নিয়োগকারীরা দক্ষ জনশক্তি দেশে পাচ্ছেন না।
এবং সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, যাদের কিছু কর্মদক্ষতা রয়েছে, যারা চাইলে নিজেদের কাজের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে নিতে পারেন- তারা সবসময় কাজের উপযুক্ত ক্ষেত্র পাচ্ছেন না। যদিও দেশের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য কাজে অনেক ধরনের দক্ষ মানুষ দরকার, কিন্তু যাদের এই চাহিদা রয়েছে এবং যাদের কাজের চাহিদা রয়েছে তারা পরস্পরের সাথে একই বাজারে আসতে পারছেন না।
উত্তরণের উপায় কী?
বেকারত্ব সমস্যা সম্পূর্ণরুপে দূর করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সমস্যা শুধু বেকার জনগোষ্ঠীদের নিয়েই নয়, বরং কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একটি বিশাল অংশের আয় তাদের জীবনধারনের জন্য উপযুক্ত নয়। বেকার সমস্যা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সাথে নাগরিকের আয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় প্রকট হচ্ছে সামাজিক সংকট। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে বাড়ছে না কর্মসংস্থানের সুযোগ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পরিকল্পনা। পরিকল্পিত পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মের উপযুক্ত করে ঢেলে সাজানো, নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মুলধনের অভাব দূর করাসহ নিতে হবে নানাবিধ সমন্বিত উদ্যেগ।
একথা ঠিক যে সরকারিভাবে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুরোপুরি বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভব নয়। সেজন্য বেসরকারি পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির উপর জোর দিতে হবে।সেইসাথে এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, বাংলাদেশে বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে কায়িক শ্রমে অনীহা রয়েছে, রয়েছে নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের প্রধান দুটি খাত, কৃষি কিংবা তৈরি পোশাক খাতে কাজকে ভালো চোখে দেখা হয় না। পরিস্থিতির উন্নয়নে এটিও একটি বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা।
যা-ই হোক, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাতারাতি পরিবর্তন যে আসবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। আইএলও’র পূর্বাভাস মোতাবেক সম্ভবত আগামী বছরগুলোতে সেটি আরো বাড়তেও পারে। কাজেই বেকার সমস্যাকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এখন থেকেই। যেখানে বেকার জনগোষ্ঠীর সাথে কাজের সম্মিলন ঘটবে, এমন একটি বাজার তৈরি দিকে মনোযোগ দিতে হবে দেশের উদ্যোগী মানুষদেরই।