বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মাঝে অবস্থিত একটি দেশ। দেশটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ব-দ্বীপ। ভূমির গঠন থেকে আমরা জানতে পারি- এই ভূখন্ডের শতকরা ৮০ ভাগই প্লাবন সমভূমি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত অঞ্চলে এই বিশাল সমভূমি গড়ে উঠেছে। অপরদিকে, দেশটিতে মাত্র ১২ শতাংশ পাহাড়ি উঁচু ভূমি রয়েছে।
ব-দ্বীপটি গঠনশৈলিতে অনন্য হলেও মহাদেশীয় টেকটোনিক প্লেটের অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদগণ বাংলাদেশকে তার ভূমির তলদেশে এই গঠনের কারণে বার বার সতর্ক করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ কেন বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে? আসলেই কি তা সত্যি? আমরা এখানে সেসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবো। তবে এর পূর্বে চলুন বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জেনে আসা যাক।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ইতিহাস
বিগত ২৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে ভূমিকম্পের ইতিহাস পাওয়া যায়, যেখানে মাঝারি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে। মূলত পশ্চিমারা এ দেশে আসার পর থেকেই ভূমিকম্পের তালিকা লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়।
১৫৪৮: এই ভূখণ্ডে প্রথম ভূমিকম্পের হদিস পাওয়া যায় ১৫৪৮ সালে। এতে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চল ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক স্থানে মাটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
১৭৬২: প্রলয়ংকরী এই ভূমিকম্পের ফলে চট্টগ্রামের উপকূলের দিকে বেশ প্রভাব পড়ে। কয়েকটি দ্বীপ স্থায়ীভাবে ডুবে যায়। আবার কিছু অংশ উপরেও উঠে আসে। ঢাকায় প্রায় ৫০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। নদীনালা ও খাল-বিলের পানি উপরে উঠে আসে, এবং পরবর্তীতে পানি নেমে গেলে নদীর তীরে মরা মাছের স্তর পড়ে থাকে। বলা হয়, একটি নদীর পানি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল। সীতাকুণ্ড পাহাড়ে আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়।
১৮৯৭: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৮৯৭ সালে ভারতের আসামে রিখটার স্কেলে আট মাত্রার বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যার কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। তবুও ঢাকার দশ ভাগ ভবন তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৫০: আসামের এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৪, কেন্দ্র অবস্থিত ছিল মিশমি পাহাড়ে। এই ভূমিকম্পটি বাংলাদেশেও অনুভূত হয়েছিল, তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি।
১৯৯৯: মহেশখালী দ্বীপের ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫.২। এর ফলে বাড়ি-ঘরে ফাটল দেখা গিয়েছিল।
২০০২: এক বছরে মোট ৪০ বারের মতো চট্টগ্রামের মাটিতে ভূকম্পন অনুভূত হয়। ওই বছরই ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামিতে ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী ১৪টি দেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলেও দু’জনের প্রাণহানি ঘটে।
২০০৯-১৯: ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করা ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, সর্বশেষ ১০ বছরে বাংলাদেশে মোট ৮৭ বার ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ ২৪ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়। ২০০৮-১১ সালের মধ্যে ভূকম্পনের সংখ্যা বেশি ছিল। তবে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে তা কমে আসলেও প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ছিল। এই দুই বছরে মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ কি বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে?
এককথায় উত্তর হলো, “হ্যাঁ”। বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতেই রয়েছে। এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ-অবজারভেটরি ও আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এক যৌথ গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে উঠে আসে যে- বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করছে। প্লেটগুলো হলো ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মা প্লেট। এই তিনটি টেকটোনিক প্লেটে ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি ক্রমান্বয়ে জমা হচ্ছে। তাছাড়া, বাংলাদেশের ভেতরে ও আশেপাশে ১৩টি ফল্ট লাইন রয়েছে। এক ডাউকি ফল্ট লাইন ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে এসেছে। আবার, ঢাকার কাছাকাছি সক্রিয় রয়েছে মধুপুর ফল্ট লাইন।
সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ও জাইকার যৌথ জরিপে বলা হয়, সাতের অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল ঢাকা শহরের ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বিল হাম এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, ইউরেশীয় প্লেটের নিচে ভারতের যে প্লেটটি রয়েছে, সেটি স্থির হয়ে আছে। হিমালয়ের পাদদেশের এই কেন্দ্রটি বাংলাদেশ থেকে চারশো কিলোমিটার উত্তরে। এই প্লেটের স্থবিরতা কেটে গেলে অর্থাৎ এটি খুলে গেলেই বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। সুতরাং, বাংলাদেশের জন্য যে বিপদ অপেক্ষা করছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনুযায়ী বাংলাদেশ
ভৌগোলিক অবস্থানগত ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশকে ৩টি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে।
১ নং জোন: একে রেডলাইন জোন বলা হয়। সিলেট বিভাগসহ নেত্রকোনা, শেরপুর, কুড়িগ্রাম জেলা এর অন্তর্গত। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অবস্থিত।
২ নং জোন: ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার নিয়ে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
৩ নং জোন: ভূমিকম্পের কম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের পুরো খুলনা ও বরিশাল বিভাগ।
১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বড় মাত্রার ভূকম্পনগুলোর প্রায় সব ক’টির উৎপত্তিস্থল সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায়। তাই এসব অঞ্চল অতি ঝুঁকিপূর্ণের কাতারেই রয়েছে।
ভবিষ্যতে করণীয়
ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিরোধ বা ঠেকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়, বরঞ্চ যা করা যেতে পারে তা হলো গবেষণার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল শনাক্ত করে ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প সহনীয় অবকাঠামো তৈরি করা। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে যদি ভূমিকম্প আঘাত হানে সে সময় যেন জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।
জাপান একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। সেখানে তারা রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্পেও ভবন ভেঙে না পড়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। অধিক ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বহুতল ইমারত তৈরি হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। ভূমিকম্প সংগঠিত হলে এর পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা দরকার।
২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেপে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেবার আতঙ্কেই মারা যান ৬ জন। সেক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী হবে ভেবেই দেখুন! মনে আছে রানা প্লাজার কথা? উদ্ধারকাজ চালাতেই আমাদের ১৫ দিন লেগে গিয়েছিল। আমাদের দেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে।
এছাড়া, ভূমিকম্পের পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও হাসপাতালগুলোকে আধুনিক করতে হবে। জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি ভূমিকম্প নিয়ন্ত্রণে সঠিক গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিকম্পের ওপর প্রতিনিয়ত গবেষণা করা উচিত। গবেষণালব্ধ ফলাফল বহুলভাবে প্রচার করতে হবে। ভূমিকম্পসহনশীল ভবন তৈরি, সঠিক পরিকল্পনা করা ও তার বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। অন্যথায় দুর্যোগ সংগঠিত হয়ে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে।