গ্রীষ্মকালীন দেশে ঘূর্ণিঝড় অহরহ আঘাত হেনে থাকে এবং ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলবর্তী এলাকা ও এলাকাবাসী। বাংলাদেশের উপকূলে আজ আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ এবং ভোর ছয়টার দিক থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করেছে। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ এই ঘূর্ণিঝড় কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র নামকরণ
এই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছে থাইল্যান্ড থেকে প্রস্তাবনার ভিত্তিতে, এমনটাই তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর। দৈনিক প্রথম আলোর তথ্যসূত্রানুযায়ী আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামছুদ্দীন আহমেদের মতে, ‘মোরা ’ একটি থাই শব্দ। শব্দটির ইংরেজি অর্থ ‘স্টার অব দ্য সি ’। বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ হয় ‘সাগরের তারা ’ ।
আমরা হয়ত প্রায়ই চিন্তা করে থাকি ঝড়ের নামকরণ কেন করা হয় বা এর পেছনে উদ্দেশ্য কী?
আসলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলোতে ঘূর্ণিঝড় খুব বেশী আঘাত হানে। তাই যেন বিভ্রান্তি তৈরী না হয় এজন্য ১৯৪৫ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। নামকরণের সময় আঞ্চলিক পর্যায়ের নিয়ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে। একটি পূর্ব নির্ধারিত নামের তালিকা থাকে এবং ঝড়ের নাম সেই পর্যায়ক্রম অনুযায়ী দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে ওডিশায় ঘূর্ণিঝড়ের পর ২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড মেটিওরলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) ও এসকাপ তাদের বৈঠকে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরুর বিষয়ে একমত পোষণ করে। ২০০৪ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রথম ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় ‘অনিল ‘। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে থাইল্যান্ডে এসকাপ ও ডব্লিউএমওর ঘূর্ণিঝড় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের বৈঠকে ছয়টি ঘূর্ণিঝড়ের নাম আগাম ঠিক করে রাখা হয়েছে। প্রথম ঘূর্ণিঝড়টি গত ১৭ এপ্রিলে ভারত উপকূলে দুর্বল অবস্থায় আঘাত হানে। এরপরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম রাখা হয়েছিল ‘মোরা’। পর্যায়ক্রমে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো আসবে সেগুলোর নাম রাখা হবে যথাক্রমে- ওচি, সাগর, ম্যাকুনু ও ডায়ে।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’
ঘূর্ণিঝড় মোরা বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলে অতিক্রম করে উত্তরে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। সেন্টমার্টিন্সে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১৪ কিলোমিটার এবং টেকনাফে ঘন্টায় ১১৫ কিলোমিটার রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। আবহাওয়াবিদদের মতে বাতাসের গতিবেগ এর চেয়ে বাড়বে না বলে আশা করা যায় এবং উপকূলের দিকে এগোনোর সাথে সাথে বাতাসের গতিবেগ কমে যাওয়ার সম্ভবনা আছে।
ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক কাঁচা বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে এবং অনেক গাছ উপড়ে পড়েছে।বেড়িবাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করে শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালী এবং কক্সবাজারের কিছু নিম্নাঞ্চল এরই মধ্যে প্লাবিত হয়ে গেছে। এসব বেড়িবাঁধের অনেকগুলোই গত বছর ঘূর্ণিঝড়ের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড় মোরার তীব্রতা
ঘূর্ণিঝড় মোরা সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কক্সবাজারে বিভিন্ন স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন উপকূলবর্তী মানুষ। অনেক শিশু-কিশোরদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের বারান্দায় থাকতে দেখা গেছে। কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড়ে মোরায় তিনজন মারা গেছেন। এর মধ্যে দুজন গাছ চাপায় এবং একজন আতঙ্কে মারা যায়। বেলা ১২টার দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, মোরা বৃষ্টি ঝরিয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হবে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, সীতাকুণ্ডসহ বড় এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল এই ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে এসব এলাকায় দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি হচ্ছে। ধীরে ধীরে এটি দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হবে বলে আবহাওয়াবিদরা আশা করছেন। শেষ তথ্যানুসারে ঘূর্ণিঝড় মোরা এখন স্থল গভীর নিম্নচাপ আকারে রাঙামাটি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। এটি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, তাই আরও বৃষ্টি ঝরিয়ে হয়ত দুর্বল হবে। ঘূর্ণিঝড়-পূর্ববর্তী আবহাওয়ায় ফিরে যেতে আরও ১০-১২ ঘণ্টা লাগতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন।
সেন্টমার্টিন্সে খাদ্য ও পানির তীব্র সঙ্কট
এখন পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা ‘ এর আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সেন্টমার্টিন। দ্বীপের ১০ শয্যার একটি হাসপাতালে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই, যার ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন আশ্রয় নেওয়া এসব মানুষ। ছোট শিশু-কিশোরেরা এখনও বেশ আতঙ্কে আছে।
শুধু তাই নয়, দ্বীপের একমাত্র সাইক্লোন সেন্টারটি জরাজীর্ণ। এ ছাড়া দ্বীপের বিভিন্ন হোটেল সেনচুর, অবকাশ, ব্লু মেরিন হোটেল, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ও আবহাওয়া অফিসে ৪-৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
সরকারী হাসপাতালটিতে যদি খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে হয়ত আশ্রয় নেওয়া এসব মানুষকে এতটা দুর্ভোগ পোহাতে হত না।
হঠাৎ করে ৭ নম্বর থেকে ১০ নম্বর মহা বিপদ সংকেত দেখা দেওয়ায় এবং সোমবার সকাল থেকেই টেকনাফের সঙ্গে সেন্টমার্টিন্সের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় দ্বীপে বসবাসরত লোকজনের জন্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানি টেকনাফ থেকে আনা সম্ভব হয়নি। হঠাৎ করে বিপদ সংকেত হওয়ায় তা অনেকে মজুত করতে পারেননি। তাই সেখানে এখন খাদ্যের চরম সংকট যাচ্ছে।
দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা
দুর্যোগ প্রতিকারের কোনো পন্থা হয়ত নেই, কিন্তু পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারি।
যেহেতু হঠাৎ করে বিপদ সংকেত হওয়ায় খাদ্য মজুত করা সম্ভব হয়নি, সুতরাং এখন দুর্যোগ পরবর্তী পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয় বা পানিবাহিত রোগগুলো মহামারি আকার ধারণ না করে। সাথে সাথে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো অবশ্যই পরিকল্পনার সময় মাথায় রাখতে হবে ।
প্রথমত, আমাদের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে হাসপাতালে পর্যাপ্ত লোক ধারণ করতে পারবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ,খাবার স্যালাইন পৌছানোর ব্যাবস্থা করতে হবে যেন অসুস্থতার পরিমাণ কম থাকে। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রের মেরামত এবং বর্ধিতকরণ করতে হবে যেন বিপদগ্রস্ত মানুষ অন্তত দুর্যোগ মূহুর্তে আশ্রয়ের ঠাই পায় পরবর্তীতে।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেকের বাসস্থানের ক্ষতি হয়েছে, কিছু আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে সেগুলো মেরামত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, অবশ্যই পরবর্তী দুর্যোগের ধরন অনুমানের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা করতে হবে এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষের ভেতর সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো প্রকৃতি কর্তৃক মানুষের কাছে আবেদন, যেন আমরা প্রকৃতির প্রতি সহানূভুতিশীল হই এবং চরমভাবাপন্ন মনোভাব দূর করি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর মানবসমাজের প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব বা হাত নেই। কিন্তু আমাদের এই অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই প্রকৃতি প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে। দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা যদি আরও দৃঢ় না হয় এবং আমরা যদি প্রকৃতি সহায়ক নগরায়ণের চিন্তা না করি, তবে ভবিষ্যতে হয়ত বাংলাদেশ ভয়ঙ্কর দুর্যোগের সম্মুখীন হতে পারে।