বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবের নাম বাংলা নববর্ষ। সমাজের সব স্তরের মানুষের আনন্দে মেতে ওঠার এই দিনটি বাংলা বছরের প্রথম দিন। এটুকু আমরা সবাই জানি। কিন্তু বাংলা বছর কী? কীভাবেই বা এলো? আনুষ্ঠানিকভাবে এর ব্যবহার না থাকলেও কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলায় বাংলা মাস এখনও গুরুত্ববহ। এর কারণ ঋতুর আবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষকদের সুবিধার কথা ভেবেই বঙ্গাব্দের প্রচলন। নিজস্ব একটি ক্যালেন্ডার থাকাটা বাঙালির গৌরবের ব্যাপার। কিন্তু তারপরও বাংলা দিনপঞ্জির খবর রাখে এরকম মানুষের সংখ্যা দিনদিন কমেই চলেছে। বাংলা ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান অঙ্গ এই বাংলা ক্যালেন্ডারের সারমর্ম এবং ষড় ঋতুর নামকরণের নানা কারণ নিয়েই আজকের আয়োজন।
বাংলা মাস বারোটি। দুটি করে মাস নিয়ে একটি ঋতু। অল্প ব্যবধানেই বাংলাদেশে ঋতুর পরিবর্তন আসে।
গ্রীষ্ম
বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য এই দুই মাস নিয়ে গ্রীষ্মকাল। বিশাখা ও জ্যেষ্ঠা নামক নক্ষত্র থেকে যথাক্রমে মাস দুটির নাম রাখা হয়েছে। অন্যান্য সময় গরম থাকলেও বাংলায় এই দুই মাস আনুষ্ঠানিক গরমের সময় এবং প্রলয়ঙ্করী কালবৈশাখী ঝড়ের মৌসুম। বৈশাখের এক তারিখ বাংলা বছরের প্রথম দিন। গ্রীষ্মকালীন ফল যেমন আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদির প্রাচুর্যের ঋতু গ্রীষ্ম।
বর্ষা
আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস নিয়ে বর্ষাকাল। বর্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য বৃষ্টিপাত। নদীমাতৃক দেশে বর্ষা যেমন বন্যার মতো দুর্যোগের কারণ, তেমনি ভালো ফসল ফলনের জন্যও বর্ষণ জরুরী। মাস দুটির নাম এসেছে যথাক্রমে উত্তরাষাঢ়া এবং শ্রবণা নামের দুই নক্ষত্র থেকে।
শরৎ
বৃষ্টি কমে গিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘ ও কাশফুলের ঋতু শরৎ। পূর্বভাদ্রপদ নামের নক্ষত্র থেকে নাম রাখা ভাদ্র এবং অশ্বিনী নামের নক্ষত্র থেকে নাম রাখা আশ্বিন মাস- এই দুইয়ে মিলে শরৎকাল। ভাদ্র মাসে সচরাচর তীব্র গরম থাকে, এই সময়েই তাল ফল পাকে বলে একে ‘তাল পাকা গরম’ বলা হয়। আশ্বিন মাসে মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টি হয়ে থাকে।
হেমন্ত
রোদের তেজ কমে গরমের তীব্রতা কমতে শুরু করে হেমন্ত ঋতুতে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাসে হেমন্তকাল, যাদের নাম যথাক্রমে কৃত্তিকা এবং মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম থেকে এসেছে। হেমন্ত বাংলার বিখ্যাত নবান্ন উৎসবের সময়। সুখ্যাত আমন ও আউশসহ নানা নতুন ধান কেটে এই সময়ে ঘরে তোলা হয়। বিভিন্ন দেশী খাবারের উৎসব চলে হেমন্তে।
শীত
বাংলার শীত ক্ষণস্থায়ী। হেমন্তে যে হিম হাওয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায় তা শীতে প্রবল আকার ধারণ করে। শীতের সন্ধ্যা থেকে সকাল কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে। শীত বাংলার পিঠা-পুলির সময়। পুষ্যা নামের নক্ষত্র থেকে পৌষ এবং মঘা নামের নক্ষত্র থেকে মাঘ- এই দুই মাসে শীতকাল।
বসন্ত
শীত চলে গিয়ে গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, আমের মুকুল সহ বিভিন্ন ফুল ফোটে, কোকিল পাখি ডাকে বসন্তে। রঙিন এই ঋতুতে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাসে বাংলার বসন্তকাল। উত্তরফাল্গুনী ও চিত্রা এই দুই নক্ষত্রের নাম থেকে যথাক্রমে এই দুই মাসের নামকরণ হয়েছে।
শুরুর কথা
আধুনিক বাংলা দিনপঞ্জির প্রারম্ভিক ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্কের সময়ে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ বরাহমিহির ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পাঁচ খণ্ডের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রথম খণ্ড, ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’-এর উপর ভিত্তি করে যে পঞ্জিকা তৈরি হয়েছে তা বাংলাদেশের বঙ্গাব্দ আংশিকভাবে (সংস্কারকৃত) এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং ঝাড়খণ্ডের (সনাতন) পঞ্জিকা সরাসরি অনুসরণ করে।
খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবরের সময় হিজরি সালের সাথে ভারতীয় পঞ্জির সামঞ্জস্য আনতে যে ক্যালেন্ডার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয় তাকে তখন বলা হতো ‘তারিখ-এ-ইলাহি’। যেহেতু কৃষিব্যবস্থা গভীরভাবে ঋতুনির্ভর, কাজেই বাংলা মাসে এর ছাপ পড়ে। আকবরের নির্দেশে ফতুল্লাহ শিরাজি ‘কৃষি বর্ষপঞ্জি’ নামের একটি ক্যালেন্ডারারের উদ্ভাবন করেন। কিন্তু আকবরের তারিখ-এ-ইলাহি ক্যালেন্ডারে মাসের নামগুলো বর্তমান রূপে ছিল না। পরবর্তী কোনো এক সময়ে এই মাসগুলোকে ভারতবর্ষে প্রচলিত তারিখ ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে ডাকা হতে থাকে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো বাংলা বছরও সাধারণত ৩৬৫ দিনে হয়ে থাকে, আর অধিবর্ষ হয় ৩৬৬ দিনে। সনাতন পদ্ধতিতে বাংলা মাসের দিন সংখ্যা বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিনের হতে পারে। ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমী বঙ্গাব্দের একটি নতুন সংস্করণ আনে। এই সংস্করণ অনুসারে বৈশাখ থেকে ভাদ্র, এই পাঁচ মাস হবে ৩১ দিনের। বাকি সাত মাস অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র হবে ৩০ দিনে। কিন্তু প্রতি চার বছরে ফাল্গুন মাসে একটি দিন বেশী হয়ে হবে ৩১ দিনে। এতে বাংলায় অধিবর্ষের হিসাবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো হয়ে যায়।
সনাতন বাংলা ক্যালেন্ডারের অধিবর্ষ হিসাবটা সরাসরি প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা মেনে চলে এবং সেটা কিছুটা জটিল। একটি বছরের সংখ্যা থেকে সাত বিয়োগ করে সেটাকে ৩৯ দিয়ে ভাগ করতে হয়। যদি কোনো ভাগশেষ না থাকে বা থাকলেও সেটি যদি ৪ দিয়ে ভাগ করা যায়, তাহলে সেই বছরটিকে অধিবর্ষ হিসেবে ধরা হয় এবং চৈত্র মাস হয় ৩১ দিনে। বাংলা মাস কঠোরভাবে জ্যোতির্বিদ্যা মেনে হিসাব করা হয়। বেশিরভাগ ক্যালেন্ডারের মতো বাংলা বারের নামও সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র আর উপগ্রহের নামে রাখা। শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি এবং শুক্রবারের নাম যথাক্রমে শনি গ্রহ, সূর্য, চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ, বুধ গ্রহ, বৃহস্পতি গ্রহ এবং শুক্র গ্রহের নামে রাখা। সনাতন নিয়মে বাংলা দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়মের সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য বাংলা একাডেমি ১৪০২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ থেকে রাত বারোটায় দিন শুরু হওয়ার নিয়ম চালু করে।
প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যবহারিক কাজে আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকি। এতে বাইরের বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে সুবিধা হয়। কিন্তু ঋতু বৈচিত্র্যের এই দেশে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঠিকঠাক হিসাব রাখার জন্য বাংলা মাস এখনও বেশ কাজে দেয়। বাঙালির নানা উৎসব ও আমেজেও বাংলা দিনপঞ্জি ছাড়া চলে না। বঙ্গাব্দ মিশে আছে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক সত্তার গভীরে।
তথ্যসূত্র:
Guhathakurta, Meghna; Schendel, Willem van (2013). The Bangladesh Reader: History, Culture, Politics. Duke University Press. p. 17–18
Sengupta, Nitish K. (2011). Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib. Penguin Books India. p 96–98
ফিচার ইমেজ: The Daily Ittefaq