কাঠগোলাপের সাথে ছোট্ট একটুখানি মাফিন। সাথে প্লেটের কোণা বরাবর লাল ক্রীমের দাগ দেওয়া। উপরে দু’খানা পুদিনা পাতা। সবমিলিয়ে দারুণ পরিবেশনা। মূল্য নেহাত কম হলেও ২০০ কিংবা ২৫০ টাকা। সাথে ভ্যাট আলাদা। কাঠগোলাপটা কেউ খাবে না। পুদিনা পাতাও হয়তো খাবে না। কিন্তু পরিবেশনায় ‘ট্রেন্ডি’ হতে এসব উপাদানের জুড়ি নেই। শুধু তা-ই নয়, রেস্টুরেন্টের খাবারের পাশাপাশি, ‘ফুড ফটোগ্রাফি’ নামের নতুন ঘরানার আলোকচিত্র শুরু হয়েছে। তাতে আবার নানা গল্পের জোড়। ছবি তুলতেও লাগে হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা। কর্পোরেট সংস্কৃতি কিংবা ‘হ্যাংআউট’ করতে গেলে এসব খাবারের বিশেষ কদর রয়েছে। খাবার খাওয়ার পাশাপাশি অপচয় তো রয়েছেই। কিন্তু ক্রমশ খাদ্যের সঙ্কট বাড়ছে, জন্ম নিচ্ছে নতুন বিভীষিকার। ভেজাল খাদ্য থেক থেকে বাঁচতে এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে নতুন নতুন অভিযান হচ্ছে। কিন্তু খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নেই কোনো প্রকার উদ্যোগ। আর ক্রমশ বিশ্বব্যাপী এই ব্যাপারটিই কাল হতে যাচ্ছে।
গেল বছরের মে মাসে পুরো বাংলাদেশব্যাপী আলোচনায় ছিল প্রান্তিক কৃষকের ধানের সঠিক মূল্য না পাওয়া। ১ কেজি চালের দাম যেখানে গড়ে ৪০-৭০ টাকা, সেখানে, প্রতি মণ ধানের মূল্য ৪০০ টাকাও পাওয়া যায়নি। কৃষকের ফলন ভালো হলেও, মূল্যের কারণে অনেকেই নিজের ক্ষেত জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন আক্ষেপে। কারণ একটাই, ধানের দামের চেয়ে ধান কাটার মজুরির খরচ বেশি। বছরের এই ঘটনাটিই বুঝিয়ে দেয় দেশের খাদ্য নিরাপত্তার অবস্থা। অথচ খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এখানেই এমন অনিয়ম কৃষকের জন্য প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে করে প্রতি বছর বহু কৃষক তার পেশা পরিবর্তন করে চলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের আইনে নিরাপদ খাদ্যের আইন থাকলেও, নেই খাদ্য নিরাপত্তায় কোনো বিশেষ আইন। সর্বশেষ খাদ্য নিরাপত্তা সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনা হয়। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজন উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা এরই মধ্যে এ নিয়ে আইন প্রবর্তনের আশ্বাস দিয়েছেন। আশার কথা, প্রথমবার যখন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; তাতে ভালো কিছু হওয়ারই কথা।
বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক
বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত হয় বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট সূচকটি প্রকাশ করে। যেখানে মোট ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৩তম। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি, প্রান্তিক কৃষকের অবস্থা, দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যের সঙ্কটের চিত্রও প্রকাশ করে দিচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তা সূচক নির্ধারণ করা হয় চারটি বিষয়ের উপর। পুষ্টিকর খাদ্যের ক্রয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা এবং গুণমানের উপর। চারটি বিষয়ের ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় বাংলাদেশ সবমিলিয়ে পেয়েছে ৫৩.২। সমষ্টিগতভাবে তা মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও খাদ্যের নিরাপত্তা ও মানে পিছিয়ে আছে অনেকখানি (নম্বর- ৩০.৬)। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ যেখানে ৮৩ নম্বরে, সেখানে পর পর দ্বিতীয়বার সিঙ্গাপুর এই সূচকে সবার উপরে অবস্থান করছে। এশিয়ার মধ্যে এই দেশটিই একমাত্র, যেটি কি না প্রথম ১০ এর তালিকায় রয়েছে।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ, পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব একপর্যায়ে খাদ্যের উৎপাদন এবং মানের উপর প্রভাব ফেলছে, যা খাদ্যের নিরাপত্তায় উপর হুমকি এনে দিচ্ছে।
কৃষিতে অবকাঠামোগতভাবেও অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে এই কৃষিপ্রধান দেশটি। দেশের প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে কৃষির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও অনুন্নত সড়কব্যবস্থা, আকাশপথে দুর্বলতা এবং অন্যান্য কৃষি বিষয়ক কারণে খাদ্য নিরাপত্তায় অবকাঠামোগত সূচকেও পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জ
খাদ্য নিরাপত্তা একটি জটিল বিষয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ নিশ্চিত করতে খাদ্যে ক্রয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা এবং সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সঠিক উদ্যোগ, কৃষিজমির হ্রাস, এবং কৃষকের সুযোগ-সুবিধার অভাব, পর্যাপ্ত ভর্তুকির অভাব ইত্যাদির কারণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে ক্রমশ বাংলাদেশকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিশাল একটি অংশ ভুগছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। কিংবা সেই পথে রয়েছে। সূচক বলছে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ মানুষ বৈশ্বিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এদের প্রায় সবাই নিম্ন আয়ের বা মধ্য আয়ের দেশ। সেই ধারাবাহিকতায়, ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, দ্রুত নগরায়নের কারণে বাংলাদেশেও খাদ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশের করণীয়
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দ্বিতীয়টিই হলো Zero Hunger বা ক্ষুধামুক্ততা। প্রথমটি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। এই লক্ষ্যের তালিকায় আরও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া, মাটির উপরের জীবন ও পানিতে থাকা জীবনকে গুরুত্ব দেওয়া।
সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য আইন থাকলেও, এখন পর্যন্ত খাদ্যের নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হয়নি। সরকারিভাবে তা আশ্বাস দিলেও, দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই পথে অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারে উর্বর মাটির এই দেশ। তবে অবশ্যই তা হতে হবে কৃষকের পক্ষে। সবার জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের অধিকার (RTFN) নিশ্চিত করতে তৃণমূল পর্যায় থেকেই কাজ করা প্রয়োজন।
কৃষকের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, নারী কৃষককে ‘কৃষক’ হিসেবে মূল্যায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রযুক্তির সাথে কীভাবে প্রান্তিক কৃষকদের খাপ খাওয়ানো যায়, কীভাবে ফলন বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের পরিশ্রমের সঠিক মূল্য।
এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে সবকিছু একা সম্ভব নয়। তবে, প্রধান কাজটি করতে হবে সরকারকেই। পাশাপাশি কৃষকের সংগঠন, কৃষক, ভোক্তা, কমিউনিটি প্রতিনিধি, ক্ষেত থেকে কৃষিপণ্য তুলে আনা থেকে শুরু করে বাজারে বিপণনকারী (Input processing-Output marketing), উন্নয়ন সংস্থা, পুষ্টিবিদদের করার অনেক কিছু রয়েছে। জনমত তৈরি, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক সহজেই ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
মোদ্দা কথা, রেস্টুরেন্টের আকাশছোঁয়া দামের এক টুকরো কেকের দামের পেছনে কত গল্প জড়িয়ে আছে, কিংবা কৃষকের শ্রমের মূল্য সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে কি না; তা নির্ধারণ করতে পারলেই বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা থেকে ক্রমশ মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজে পাবে। নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তায়, নারী ও শিশুর পুষ্টিকর খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় মজুদ থেকে প্রাপ্যতার দিকে লক্ষ্য করাও জরুরি।
আইন প্রয়ণয়ন ছাড়াও খাদ্য কমিশন গঠনের প্রস্তাবিত খসড়া, যেম-ন সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য ক্রয়, ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়, খাদ্য রপ্তানি-আমদানির রূপরেখা তৈরি, খাদ্য বিষয়ক গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন, পুষ্টি সম্পর্কিত প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের পৃথক পৃথক পুষ্টি পরিকল্পনা গ্রহণ, খাদ্য তথ্য ভান্ডার স্থাপনের মতো বিষয়গুলোর পক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
কিছু কথা…
বাংলাদেশে কখনোই খাদ্য নিরাপত্তার টানা উন্নতি হয়নি। কখনও ভালো, তো কখনও খারাপ। তাছাড়া খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি তো রয়েছেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পেঁয়াজের মূল্য ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙেছে। দেশীয় পেঁয়াজের ব্যাপারে তেমন কোনো প্রস্তুতি না থাকার কারণে প্রতিক্রিয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। আর এই খাদ্য পরিস্থিতির অবনমনের ওপর নির্ভর করে আর অনেক কিছু। এর মধ্যে শিশুর কম ওজন, খর্বাকৃতির হওয়া অন্যতম। এগুলোর পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক অবস্থান, দূষণ, ভূ-গর্ভস্থ পানি ইত্যাদি বিষয়গুলোও খাদ্য নিরাপত্তার সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত। যে কারণে খাদ্যের মজুদ থাকার পরও পুষ্টি বিষয়ে দেশে উদ্বেগ বাড়ছে।