কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ষোল শতকে মোগল শাসনামলে নির্মিত ঐতিহাসিক অনুপম স্থাপত্য নিদর্শন সাত গম্বুজ মসজিদ। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিংয়ের বাঁশবাড়ী সড়কে মসজিদটির অবস্থান। মূল নামাজকক্ষের উপর তিনটি বড় গম্বুজ এবং বাইরে চার কোণায় মিনার আকৃতির ছোট চারটি গম্বুজ থাকায় মসজিদটি সাত গম্বুজ নামেই বেশ পরিচিতি লাভ করে।
মসজিদটির নির্মাতা নিয়ে স্থানীয় প্রবীণদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, নবাব শায়েস্তা খাঁয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র বুজুর্গ উদ্দিন উমিদ খাঁ এটি নির্মাণ করেন। তবে নির্মাণশৈলী বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল শাসনামলে নবাব শায়েস্তা খাঁ এটি বিরচন করেছিলেন। সেসময় মসজিদটির তীর ঘেঁষে প্রবাহমান ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। তখনকার মানবরা বর্ষা মৌসুমে নদীপথে যাতায়াতের সময় মসজিদের ঘাটে তরী, লঞ্চ কিংবা বজরা ভেড়িয়ে সালাত আদায় করতেন। স্যার চার্লস ডি ওয়াইলি ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে সাত গম্বুজ মসজিদকে নিয়ে একটি চিত্রকর্ম এঁকেছেন। শিরোনামে লেখা ছিল ‘গঙ্গার শাখা নদী বুড়িগঙ্গার তীরে সাত মসজিদ’। চিত্রকর্মে শোভা পাচ্ছে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে, নদীর তীর ঘেঁষে প্রবাহমান জলে চলছে তরী।
তবে সেসময় আর এসময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। নদী ভরাট করে বর্তমানে শোভা পাচ্ছে সুউচ্চ অট্টালিকা। নির্মাণ করা হয়েছে ছোট-বড় দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। মসজিদের পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল এক মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (র.) ১৯৮৬ সালে নির্মাণ করেন।
পূর্ব পাশ অর্থাৎ মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো বৃহদায়তন একটি উদ্যান, যেখানে ফুলের গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় উদ্ভিদ রয়েছে। উদ্যানের অপরুপ সৌন্দর্য নামাজে আসা মুসল্লিদের মুগ্ধ করে। মুসলিমদের বাৎসরিক দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাসহ বিশেষ কিছু দিনে এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
ওজু করার জন্য মসজিদের পশ্চিমপাশে রয়েছে দুটি ওজুখানা। উত্তর-পশ্চিমকোণে সাধারণ অন্যান্য মসজিদের মতো ওজুখানা থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিমকোণে রয়েছে পৃথক একটি ওজুখানা। একটি চৌবাচ্চাকে ঘিরে রয়েছে সাতাশ আসন বিশিষ্ট চতুষ্কোনাকৃতির একটি ওজুখানা। ওজুর অব্যবহৃত পানি বের হওয়ার জন্য প্রতিটি আসনের অগ্রাভিমুখে রয়েছে খানিক শূন্যগর্ভ জায়গা।
আয়তাকার এই মসজিদের অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ১৪.৩৩ মিটার এবং প্রস্থ ৪.৮৮ মিটার। এছাড়া নামাজকক্ষের বাহ্যিক দৈর্ঘ্য ১৭.৬৮ মিটার এবং প্রস্থ ৮.২৩ মিটার। পশ্চিমপাশের দেয়ালজুড়ে রয়েছে তিনটি মিহরাব এবং কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশেই রয়েছে পোক্ত একটি মিম্বার। অগ্রভাগের দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট মিহরাব আকৃতির নকশাগুলো নজর কাড়ে যে কারো।
কেন্দ্রীয় নামাজকক্ষে প্রবেশের জন্য উত্তর-দক্ষিণ থেকে একটি করে এবং পূর্বপাশে তিনটি ভাঁজবিশিষ্ট তোরণ রয়েছে। পূর্বপাশের তিনটি তোরণের মাঝ বরাবর রয়েছে মসজিদের কেন্দ্রীয় দুয়ার।
উত্তর-পূর্বকোণে রয়েছে ছোট একটি কবরস্থান। মসজিদের উদ্যানের পাশের সড়ক ধরে একটু এগোলেই চোখে পড়বে এক অজানা সমাধি। সমাধিটি কার এই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রচলিত আছে, নবাব শায়েস্তা খাঁয়ের মেয়ের সমাধি এটি। সমাধির অভ্যন্তর অষ্টকোণাকৃতির হলেও বাইরে চতুষ্কোণাকৃতির। বিবির মাজার হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে।
বর্তমানে সাত গম্বুজ মসজিদ এবং অজানা সমাধিটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে। একসময় মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সমাধিটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়লে প্রত্নতত্ব বিভাগের দায়িত্বে এটি সংস্কার করা হয়।
সাড়ে তিনশ বছর পূর্বের এই মসজিদ বর্তমানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। প্রতি ওয়াক্তেই এখানে জামাতের সাথে সালাত আদায় করা হয়। কেন্দ্রীয় নামাজকক্ষে প্রায় শ’খানেক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। চার কোণায় চারটি মিনার আকৃতির গম্বুজের অভ্যন্তরে সালাত আদায়ের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা। তবে পশ্চিমের উত্তর-দক্ষিণ গম্বুজ দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পূর্বদিকের গম্বুজ দুটিতে মুসল্লিরা সালাত আদায় করতে পারেন।
মসজিদে পেশ ইমাম রয়েছেন দুজন, মুয়াজ্জিন একজন এবং খাদেম তিনজন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণে থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দারাই এর দেখাশোনা করেন। পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি পরিচালনা পর্ষদ।
সাত গম্বুজ মসজিদের সাথে লালবাগ দুর্গের তিন গম্বুজ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের মিল আছে বলে অনেকে মনে করেন।
কীভাবে যাবেন: ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকেই সড়কপথে মোহাম্মদপুর আসা খুব সহজ। রেল বা নদীপথে আসার কোনো পদ্ধতি নেই।
কুড়িল/বিশ্বরোড, নতুনবাজার, বারিধারা, বসুন্ধরা, বাড্ডা, ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন (বিআরটিসির) দ্বিতল বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২০-৪০ টাকা।
ঢাকার মতিঝিল, গুলিস্তান, শাহবাগ, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহন সার্ভিস চালু আছে। এছাড়াও সাভার আশুলিয়া বেড়িবাঁধের কামারপাড়া, স্লুইসগেট নামক জায়গা থেকে প্রজাপতি, পরিস্থান এই দুটি বাস মোহাম্মদপুর হয়ে বসিলা পর্যন্ত চলাচল করে। তবে গাজীপুর থেকে সরাসরি কোনো বাস সার্ভিস চালু নেই। এজন্য প্রথমে টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর আসতে হবে। সেখান থেকে মোহাম্মদপুরগামী বাস পেয়ে যাবেন।
যা-ই হোক, যেখান থেকেই আসেন না কেন, আপনাকে নামতে হবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে কাউকে বাঁশবাড়ী সড়কের কথা বললেই দেখিয়ে দিবে। সড়ক ধরে এক বা দেড় মিনিটের পথ হাঁটলেই হাতের বাঁ-পাশে দেখা মিলবে ঐতিহাসিক সাত গম্বুজ মসজিদের। অথবা বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশায় চড়েও আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে গুনতে হবে দশ টাকা।
নিকটস্থ জনপ্রিয় খাবার: পুরান ঢাকার পাশাপাশি মোহাম্মদপুরেও খাবারের বেশ জনপ্রিয়তা আছে। মোহাম্মদপুরে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী, স্বাস্থ্যকর, মজাদার বিভিন্ন পদের খাবারের আয়োজন। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে জেনেভা ক্যাম্পের পাশে বোবার বিরিয়ানী, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার বা টাউন হলের পাশেই শওকতের বিরিয়ানী, শিয়া মসজিদের বিপরীতে নবাবী ভোজ এবং বিহারী ক্যাম্পের পাশে কামাল বিরিয়ানী, গরু ও খাসির চাপ, মাঞ্জারের পুরি, মুস্তাকিমের চাপ ও গরুর মগজ ফ্রাই। এছাড়াও তাজমহল রোডে রয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ, কেক-পেস্ট্রির দোকান। সেখানে রয়েছে শর্মা, বার্গার, পিৎজা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসহ ফাস্টফুডের বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের আয়োজন। সলিমুল্লাহ রোডের সেলিম কাবাবের স্বাদ নিতেও ভুলবেন না। এর স্বাদ নিতে হলে বিকেলের আগেই আসতে হবে, নাহয় মর্মাহত হয়েই আপন গন্তব্যে ফিরে যেতে পারেন।
নিকটস্থ দর্শনীয় স্থান: মোহাম্মদপুরের আশেপাশেই আছে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজারে অবস্থিত দেশের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবী শহীদদের স্মরণে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ, শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যান এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজয় সরণিতে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর, শিশুদের জন্য শ্যামলীতে অবস্থিত শিশু মেলা। এছাড়াও হাতে সময় থাকলে ধানমন্ডি লেকেও ঢুঁ মারতে পারেন।