কর্মজীবী মানুষকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণিতে রয়েছে সেসব মানুষ যারা কর্মজীবনে স্থিতি খোঁজে, একটি ভালো চাকরির প্রত্যাশায় থাকে এবং সেটি পেয়ে গেলে সেখানেই স্থির হতে চায়। অধিকাংশ মানুষই এই শ্রেণির অন্তর্গত। বিপরীত দিকে অল্প সংখ্যক মানুষই দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হন, যারা নতুন চ্যালেঞ্জের নেশায় বুদ হয়ে থাকেন, যারা বড় চাকরি আর সুযোগ-সুবিধা দ্বিতীয়বার না ভেবেই ছেড়ে দিতে পারেন, আরও বড় কিছু করার উদ্দেশ্যে। ঠিক যেমনি জেফ বেজোস ‘ডিই শ’ এর উচ্চপদস্থ পরিচালকের চাকরি নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করতে। ল্যারি অ্যালিস যেভাবে ‘আমপেক্স কর্প’ এর বড় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওরাকলকে সাথে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের চাকরি আর প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে আসার ঝুঁকি বৃথা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে বড় কিছু করার নেশায়, সৃজনশীল কিছু করার নেশায় যারা ঝুঁকি নেন, তাদের চেষ্টা কখনোই বৃথা যায় না।
নতুনত্বের খোঁজে সব ছেড়েছুড়ে আসা আমাদের দেশেরই এমন একজন মানুষ রাশেদ মুজিব নোমান। আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে দেশে এসে যুক্ত হয়েছেন একটি অপেক্ষাকৃত নতুন স্টার্টআপের সাথে। তার এই পদক্ষেপ কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত সাফল্যের দিকেই তিনি ছুটছেন নিরন্তর গতিতে, কী ছেড়ে এসেছেন তা নিয়ে ভাববার সময় কই?
রাশেদ মুজিব নোমানের জন্ম বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায়। নানান সীমাবদ্ধতা আর সমস্যা জর্জরিত একটি অনুন্নত দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশটিতে গিয়ে নিজের নাম ও খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যতটুকু মেধার প্রয়োজন, ততটুকুই ছিল তার। দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে সুযোগ পান যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখার এবং সেখানেই চলে যান স্থায়ীভাবে। সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং নিউ ইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন তিনি। অবশ্য এমবিএ শেষ হবার আগেই প্রবেশ করেন কর্মজীবনে।
বৈশ্বিক অটোমোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘জেনারেল মোটরস’-এর প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবন শুরু তার। এখানে ৭ বছর সাফল্যের সাথে কাজ করেন তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতাদের একটিতে কাজ করার পর রাশেদ নোমান সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে যুক্ত হন বোয়িংয়ের সাথে, যেটি কিনা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এয়ারক্রাফট নির্মাতা কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সাথে টানা ১১ বছর কাজ করেন তিনি। কাস্টমার সাপোর্ট, ফ্লিট মনিটরিং, ডাটা অ্যানালাইসিস, বিজনেস ডেভলপমেন্ট, টেকনিক্যাল সাপোর্ট, টুলস অ্যান্ড প্রসেস ডেভলপমেন্ট সহ একাধিক দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘স্পৃহা ফাউন্ডেশন’, ‘আরএমএন টেক’, ‘বিহঙ্গ’ সহ একাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কাজ করেছেন। আমেরিকায় প্রায় ২০ বছরের কর্মজীবনে সাফল্য, অর্থ, খ্যাতি- সবকিছু পেয়েছেন, বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পর্যায়ে কাজ করেছেন, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে আরও অনেক ওপরে যেতেন তাতে সন্দেহ নেই, তবু কেন সব ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এলেন অপেক্ষাকৃত নতুন এক প্রতিষ্ঠান অগমেডিক্সের কান্ট্রি ডিরেক্টর হবার জন্য?
অগমেডিক্স হলো আমেরিকার হেলথকেয়ার ব্যবস্থায় সর্বাধুনিক ও সৃজনশীল এক উদ্যোগ। মার্কিন ডাক্তারদের প্রতিদিন রোগীর মেডিক্যাল রিপোর্ট লিখতে যে সময় নষ্ট হয়, সেটি লাঘব করতেই অগমেডিক্সের উদ্ভব। ডাক্তাররা গুগল গ্লাস চোখে দিয়ে রোগী দেখেন এবং একই সময়ে সরাসরি ডাক্তারের সেই গ্লাসে রোগীকে দেখতে পান সুদূর বাংলাদেশ বা ভারতে বসে থাকা অগমেডিক্সের স্ক্রাইবরা, যারা ডাক্তারের সহকারি হয়ে রোগীর যাবতীয় তথ্য লিখে দেন। এতে ডাক্তারদের মূল্যবান সময় বেঁচে যায়, তারা রোগী দেখায়ও মনোযোগ দিতে পারেন নির্বিঘ্নে। এরকম একটি উদ্যোগের সাথে কেন যুক্ত হলেন রাশেদ নোমান? এ প্রশ্নের একাধিক উত্তর রয়েছে।
শৈশবে ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন রাশেদ নোমান। কিন্তু ঘটনাক্রমে হয়ে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার। এরপর কর্মজীবনে গিয়ে চলে গেলেন প্রশাসনিক পদে। দীর্ঘদিন কাজ করার পর অবশেষে শৈশবের ইচ্ছা আংশিক পূরণ হলো তার, তিনি এখন ডাক্তারদের সাথেই কাজ করছেন অগমেডিক্সে! না, তার অগমেডিক্সে আসার কারণ শৈশবের ইচ্ছা নয়। বোয়িংয়ে থাকাকালীন তিনি ভাবতেন একসময় নাসায় কাজ করবেন। কিন্তু সিয়াটলে বসবাসকালে সে শহরে অবস্থিত দুই টেক জায়ান্ট অ্যামাজন আর মাইক্রোসফটের হেডকোয়ার্টার দেখে টেক ফার্মে কাজ করার প্রতিও আগ্রহ সৃষ্টি হয় তার। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায় যখন অগমেডিক্সে কাজ করবার সুযোগ আসে। কিন্তু অগমেডিক্স তো মাইক্রোসফট বা অ্যামাজনের মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেনি এখনো। তাহলে কেন এখানে আসা?
এর সর্বপ্রধান কারণ হলো, সৃজনশীল এই উদ্যোগের অপার সম্ভাবনা। প্রযুক্তির প্রাচুর্যের এ সময়ে সৃজনশীলতাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। যে উদ্যোগ যত সৃজনশীল, তার সাফল্য ও সম্ভাবনা তত বেশি। রাশেদ নোমান স্বাস্থ্য খাতে অগমেডিক্সের বিপ্লব ঘটাবার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। আর সৃজনশীল মানুষেরা নতুন সম্ভাবনার খোঁজ পেলে তার পেছনে ছুটবেনই। প্রযুক্তির অগ্রসরতার কারণে প্রতিটি সেক্টরই একসময় ডিজিটালাইজড হবে, প্রযুক্তি নির্ভর হবে- এ সত্য অনুধাবন করেই স্বাস্থ্যখাতে ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন তিনি। দীর্ঘ ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা আর দক্ষ নেতৃত্বে অগমেডিক্সকে একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে পরিণত করার লক্ষ্যে অগমেডিক্স বাংলাদেশের ‘কান্ট্রি ডিরেক্টর’ হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
অগমেডিক্স আমেরিকা ভিত্তিক স্টার্টআপ হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান শাকিল একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। তবে, রাশেদ মুজিব নোমান, যিনি একজন বাংলাদেশী, প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ডিরেক্টর হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য উপকার হয়েছে। রাশেদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অগমেডিক্স বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এর যাবতীয় প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, গবেষণা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সংগ্রহের কার্যক্রম ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ভিত্তিক করে ফেলার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সফটওয়্যার ডেভলপমেন্টের ৯০ শতাংশই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে। অগমেডিক্সের ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’- এর কাজেও বাংলাদেশীরাই এগিয়ে। তবে রাশেদের নজর বিপুল সম্ভাবনাময় ‘বিজনেস প্রসেসিং আউটসোর্সিং’ বা বিপিও খাতে। কেবল ২০২০ সালেই এ খাতে তৈরি হয়েছে ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বাজার। যদিও এ বাজারের ৫৬ ভাগই ভারতীয়দের দখলে, তবে বাংলাদেশিরাও এগিয়ে যাচ্ছে।
ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর ও ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশীয় বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করার যে স্বপ্ন রাশেদ নোমান দেখেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জেলায় জেলায় অগমেডিক্সের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। আইসিটি বিভাগের আওতায় নতুন গ্র্যাজুয়েটদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রথম ধাপে ৫ শতাধিক স্ক্রাইব প্রশিক্ষণ দিলেও ধীরে ধীরে ৭ হাজার কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে অগমেডিক্সের। আর এই পরিকল্পনা আগামী ৫ বছরের মধ্যেই সফল করতে চান রাশেদ নোমান। মাত্র ৩ বছরেই তার সুচিন্তিত দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশে অগমেডিক্স প্রসারিত হয়েছে ১০ গুণ এবং প্রতিবছরই জনবল ও কাজের পরিধিতে হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ।
রাশেদ মুজিব নোমান এখন পালন করছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার এন্ড আউটসোর্সিং-বাকো’র নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব। এই সংগঠনটি কাজ করে চলেছে দেশের বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং ও কল সেন্টার শিল্প নিয়ে। ২০২১ সালের মধ্যে এই খাতে ১ লক্ষেরও বেশি তরুণকে টেকসইভাবে উপার্জনক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে এর কাজ। সেইসাথে আরও নানা ধরনের সামাজিক উদ্যোগ ও সেবামূলক কাজের সাথে জড়িত আছেন রাশেদ নোমান। তিনি হাসিমুখ সমাজকল্যাণ সংস্থা, আমাল ফাউন্ডেশন, শিশুস্বর্গ ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কাজ করছেন। এই সংস্থাগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মধ্যমে ভাগ্যবঞ্চিত জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করছে। এর পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তারা যাতে তাদের স্টার্টআপ নিয়ে সফলভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য প্রতিনিয়ত তাদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
রাশেদ মুজিব নোমান একটি নীতিতে অটল থেকেছেন জীবনভর। সেটি হলো, যেখানেই তিনি কাজ করেছেন, সেখানেই এমন কর্মনিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন যেন তার পদচিহ্ন সেখানে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। জেনারেল মোটরস আর বোয়িংয়ের পর অগমেডিক্সেও যে তিনি তার অবদান স্থায়ী করতে চাইবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রিয় একটি বইয়ের নাম ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল’। এ বইটি তিনি ভীষণভাবে অনুসরণ করেন। যেখানেই তিনি গিয়েছেন, আন্তরিকতার মাধ্যমে অসংখ্য বন্ধু বানিয়েছেন, মেধা আর প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করেছেন। এই ধারাবাহিকতা তিনি অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছেন অগমেডিক্স বাংলাদেশেও।