জন্মের শুরু থেকেই আর দশটা বাচ্চার মতো সুস্থভাবে হেসে-খেলে বড় হতে পারেনি শিশু সারাহ। ওর খুব সুন্দর একটা ডাকনামও আছে- ঐশ্বর্য। সারাহর লড়াইয়ের শুরু মাত্র ১০ মাস বয়স থেকে, যখন ওর ছোট্ট শরীরে ধরা পড়লো টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামক দুরারোগ্য এক ব্যাধি।
সারাহর ভীষণ মাথব্যথা করত। তিনি জানতেন যে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। সেই অসহ্য ব্যথা নিয়েই তিনি স্কুলে যেতেন, ছবি আঁকতেন, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন, আনন্দে মেতে থাকতেন। এভাবেই স্কুল-কলেজ পার হয়ে তিনি ভর্তি হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউডার চারুকলা বিভাগে।
নর্থরোডের বাসায় সারাহর নিজের ঘরটি যেন ছিল তার জন্য পুরো এক পৃথিবী। দেয়ালে ঝোলানো ছবি, ছোট্ট অ্যাকুরিয়ামে রং-বেরঙের মাছের ছুটে চলা, নানা ধরনের গল্পের বই, ছবি আঁকার সরঞ্জাম, এবং সাথে নিজের মা, ভাই আদিত্যকে নিয়ে নিজস্ব এক জগৎ।
২০২২ এর মার্চ থেকেই সারাহর অসুখটা বেড়ে যেতে থাকে। ফলে শুরু হয় হাসপাতালে লাগাতার ছোটাছুটি। চিকিৎসকগণ তার মস্তিষ্কে সার্জারির সিদ্ধান্ত নিলেন। সার্জারিটা করা হলো রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু এর পর পরই সারাহর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকল। ফলে তাকে দ্রুত ভর্তি করা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আইসিইউ-তে। সম্পূর্ণ পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সারাহের ‘ব্রেন ডেথ’ হয়েছে।
আমাদের মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম ‘ব্রেন স্টেম’। এটি আমাদের মধ্য মস্তিষ্ক এবং পশ্চাৎ মস্তিষ্কের পনস ও মেডুলা নামক অংশ নিয়ে গঠিত, যা আমাদের হৃদপিণ্ড, ফুসফুসের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। কোনো কারণে ব্রেন স্টেম অকার্যকর হয়ে গেলেও হৃদপেশীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এবং আইসিইউ-এর বিশেষ যান্ত্রিক ব্যবস্থায় অঙ্গগুলোকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। তবে একবার ‘ব্রেন ডেথ’ হয়ে যাবার অর্থ হলো রোগী আজ হোক কিংবা কিছুদিন পর- মারা যাবেই।
সারাহর ব্রেন ডেথ নিশ্চিত হবার পর তার পরিবারকে কাউন্সেলিং করা হলো। সারাহ তার মৃত্যুর পূর্বেই পুরো দেহ দান করার কথা বলে রেখেছিলেন তার পরিবারকে। তিনি চাইতেন তার মস্তিষ্ক নিয়ে যেন গবেষণা করা হয়। তার মা স্বেচ্ছায় মেয়ের কিডনি ও চোখের কর্নিয়া প্রদানে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
একজন ‘ব্রেন ডেড’ মানুষের দেয়া অঙ্গগুলোর মাধ্যমে মোট ৮ জন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। দুটি কিডনি, দুটি ফুসফুস, একটি অগ্ন্যাশয়, একটি হৃদপিণ্ড, লিভার এবং অন্ত্রনালী প্রতিস্থাপনযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীতে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেগুলো দাতার দেহ থেকে অপসারণ করে গ্রহীতার দেহে প্রতিস্থাপন করে দেয়া হয়।
দীর্ঘ ১৯ বছর রোগভোগের পর ২০ বছর বয়সে এসে সারাহ ইসলাম মারা গেলেন। কিন্তু মারা গিয়ে চোখের আলোয় আলোকিত করে গেলেন দুজন মানুষকে, যারা তার দান করে যাওয়া কর্নিয়া দিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়াও সারাহর দান করে যাওয়া দুটি কিডনি দিয়ে দুজন মানুষ তাদের কিডনির রোগ থেকে সেরে উঠছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সারাহ ইসলামই প্রথম ব্যক্তি যিনি ব্রেন ডেড অবস্থায় নিজের অঙ্গ দান গেছেন, এবং সেই সাথে জাগিয়ে গেলেন চারজন মানুষের জীবনের আশা।
Featured Image © Arafat Karim