রাজশাহীতে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ির গোড়াপত্তন হয় মোঘল আমলে। পুঠিয়া রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন মহারাণী হেমন্তকুমারী দেবী। ১৮৯৫ সালে বর্তমানে যে মূল রাজবাড়িটি আছে তা তিনি নির্মাণ করেন। নির্মাণের পর তিনি রাজপ্রাসাদটি শাশুড়ি মহারাণী শরতসুন্দরী দেবীর স্মরণে উৎসর্গ করেন। উল্লেখ্য, রাজা যোগেন্দ্র নারায়নের সাথে শরতসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এবং তিনি বিধবা হয়েছিলেন তার সাত বছর পরেই। তার কোনো সন্তানসন্ততি না থাকায় রজনীকান্ত নামে এক ছেলেকে দত্তক নেন। পরবর্তীতে রজনীকান্ত ‘রাজা যতীন্দ্রনারায়ন’ নামে পরিচিত হয়ে হেমন্তকুমারী দেবীকে বিয়ে করেন। বিদুষী শরতসুন্দরী দেবী, যাকে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন, মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই মারা যান।
হেমন্তকুমারীর মৃত্যুর পর রাজবংশ এবং জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির ফলে পুঠিয়া রাজবাড়ি তার জৌলুশ হারাতে থাকে। তবে এখনো এর কিছু নিদর্শন রয়েছে, যেগুলার বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে।
শিব মন্দির
পুঠিয়া রাজবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই শিব মন্দির। রাজবাড়ির দিকে ভ্যান বা অটোতে করে এগোতে থাকলে হাতের বাম পাশে এই মন্দিরটিই আগে চোখে পড়বে। রাণী ভুবনময়ী দেবী এটি নির্মাণ করেন তৎকালীন তিন লক্ষ টাকা খরচ করে। এটি নির্মাণে প্রায় সাত বছর লেগে যায়। এই উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম বড় শিব মন্দির এটি।
মন্দিরটির সামনে রয়েছে বিশাল দিঘী। পুরো পুঠিয়া রাজবাড়ি জুড়েই এমন ছোট বড় আরো ৫টি দিঘী দেখতে পাবেন। মন্দিরটিতে প্রবেশের জন্য এবং পেছনের দিঘীতে নামার জন্য দুটি মূল সিঁড়ি রয়েছে। ১৪.৩০ মিটার পরিমাপের মন্দিরটি ৪ মিটার উচু মঞ্চের উপর নির্মিত। মন্দিরটিতে একটি মূল চূড়া এবং তার চারদিকে ৪টি করে ছোট ছোট চূড়া রয়েছে। মূল চূড়াটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ মিটার। শিব মন্দিরটিতে এখনো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন পূজা অর্চনা করে থাকেন।
জগন্নাথ মন্দির
শিব মন্দিরে ঢুকলেই হাতের ডান দিকে আরেকটি ছোট মন্দির দেখতে পাবেন, যা রথ বা জগন্নাথ মন্দির নামে পরিচিত। প্রবেশপথে রয়েছে বেলে পাথরে তৈরি চৌকাঠ। ভেতরে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার চারপাশে আটটি পিলার রয়েছে। এটি একটি দোতলা কাঠামো, মূল কাঠামোর উপরের কক্ষটি আকারে ছোট। ধরা হয়ে থাকে মূল শিব মন্দির নির্মাণের সাথে সাথে এই মন্দিরটিও রাণী ভুবনময়ী দেবী নির্মাণ করেন। তবে মন্দিরটি বর্তমানে অনেকটাই পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
দোল মন্দির
শিব মন্দির ছেড়ে আরো সামনে আসলে সাদা রঙের আরেকটি বড় মন্দির দেখতে পাবেন। দেখে মনে হয় সাদা চুনকাম করা। শিব মন্দিরের মতো দোল মন্দির কোনো উঁচু মঞ্চের উপর নির্মিত নয়। তবে সমতল ভূমি থেকে এর উচ্চতা ২০ মিটারের মতোই। মন্দিরটির স্থাপনা খুবই চমৎকার এবং মন্দিরটি উপরের দিকে ক্রমশ সরু। অর্থাৎ নিচতলা থেকে দোতলা আকারে ছোট, দোতলা থেকে তৃতীয় তলা আরো ছোট। এভাবে স্থাপনার কাজ উপরে উঠে গেছে।
মন্দিরটির নির্মাণশৈলীতে একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এতে প্রচুর প্রবেশপথ রয়েছে। নিচতলার চারদিকে সাতটি করে মোট ২৮টি প্রবেশপথ রয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলায় যথাক্রমে ২০টি, ১২টি এবং ৪টি করে সর্বমোট ৬৪টি প্রবেশপথ রয়েছে। এতগুলো প্রবেশপথের জন্য পুঠিয়াবাসী এই মন্দিরকে ‘হাজারদুয়ারি’ নামে ডাকে।
তবে অবাক করা বিষয় হলো, এই মন্দিরে কোনো পূজা অর্চনা হয় না। এমনকি লোকসমাগমও নেই। গেটগুলোও বন্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়। স্থানীয় লোকদের মুখে জানা যায়, রাজা ভূবেন্দ্র নারায়ণ তার নাবালিকা স্ত্রীর সাথে লুকোচুরি খেলার জন্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটির কাঠামো আর এতগুলো প্রবেশপথ দেখে কথাগুলো অবিশ্বাস করা যায় না আসলেই।
পুঠিয়া রাজবাড়ি
দোল মন্দির ছেড়ে একটু সামনে এগোলে বিশাল মাঠের পরেই পুঠিয়া পাঁচআনি রাজবাড়ি চোখে পড়বে। মূলত শিব মন্দিরের পর এটাও আরেকটি মূল আকর্ষণ। দোতলা বিশিষ্ট এই রাজবাড়িটি প্রায় ৪.৩০ একর জমির উপর নির্মিত। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে এটি আয়তাকার। ইট, সুরকি, লোহা, চুন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে প্রাসাদটি নির্মাণে। মূল ভবনে প্রবেশের জন্য দুটি ঝুলবারান্দা রয়েছে। কাঠের তৈরি সিঁড়িও আছে উপরে ওঠার জন্য। তবে বেশিরভাগ সময়েই সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশপথের পরের দরজা বন্ধ থাকে। এ ধরণের কাঠামো ইন্দো-ইউরোপীয় সময়ের স্থাপত্য রীতিকেই নির্দেশ করে।
বর্তমানে এটি ‘লস্করপুর ডিগ্রি কলেজ’ নামে পরিচিত। এলাকাবাসীর মুখ থেকে শোনা যায় প্রাসাদটির মাটির নিচেও কক্ষ আছে, যেগুলোতে পূর্বে কলেজের ক্লাসও নেয়া হতো। বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তা বন্ধ আছে। আরো রয়েছে গোপন, সুরঙ্গ যেগুলোতে প্রবেশ নিষেধ। কথিত আছে, সুড়ঙ্গপথ নাকি পাশের দিঘীগুলোর নিচ দিয়ে চলে গেছে অপরপাড়ে, যাতে কখনো আক্রমণের শিকার হলে সহজেই পালিয়ে যাওয়া যেত। যদিও তথ্যগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবুও আপাতত এসব মেনে নিতেই যেন ভাল লাগে!
গোবিন্দ মন্দির
পুঠিয়া পাঁচআনি রাজবাড়ির ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা প্রবেশপথ আছে। ভাঙাচোরা কাঠের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে গেলে হয়তো একটু বিরক্ত হবেন। কিন্তু প্রবেশের পরে প্রেম নারায়ণ কর্তৃক নির্মিত গোবিন্দ মন্দিরটির সৌন্দর্য দেখে আপনার বিরক্তি নিমেষে উবে যাবে। এখানে নিয়মিত পূজা অর্চনা হয়। লোকের আনাগোনাও ভালও। সব সময় একজন পুরোহিতকে দেখতে পাওয়া যায় মন্দিরে।
মন্দিরটির মাঝখানে রয়েছে প্রশস্ত ঘর, যেখানে গোবিন্দ মূর্তি রয়েছে। তার চারপাশে রয়েছে চারটি ছোট কক্ষ। বারান্দা দিয়ে প্রবেশপথ ৩টি এবং মূল প্রবেশপথ পশ্চিমে হলেও মন্দিরটির চারপাশেই ৪টি খিলান দরজা রয়েছে। উপরতলায় ওঠার জন্য সিঁড়ি রয়েছে। মন্দিরের দেয়াল খুব সুন্দর করে খোদাই করা। পোড়ামাটির দেয়ালগুলোয় বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, পালকি, ঘোড়া, ধনুক, তীর, হাতি, ফুল ইত্যাদির নকশা খোদাই করা রয়েছে।
চারআনি রাজবাড়ি
এর গঠনশৈলীর জন্য এবং ভেতরের ঘরগুলোর প্রবেশপথে মোটা মোটা লোহার গারদ থাকার জন্য অনেকেই একে জমিদার বাড়ির জেলখানা মনে করে ভুল করে থাকেন। পাঁচআনি রাজবাড়ির পশ্চিমে অবস্থিত এই রাজবাড়িটির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। কাছারি এবং কোষাগার ভবন কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে।
তবে ধরা হয়, জমিদার বাড়ির বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য এটি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে রাজবাড়ির কর্মচারীরা থাকতেন এবং হাতি-ঘোড়া রাখারও ব্যবস্থা ছিল। ভবনটি ১৯০০ সালের দিকে নির্মিত বলে মনে করা হয়।
আহ্নিক মন্দির
চারআনি রাজবাড়ির পর আরেকটু সামনে হাঁটলেই তিনটি মন্দির পাশাপাশি দেখতে পাবেন। গোপাল মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির এবং বড় আহ্নিক মন্দির। দেখে মনে হবে এই তিনটি স্থাপনাই হয়তো সবচেয়ে যত্নে রাখা হয়েছে। কারণ অন্য নিদর্শনগুলোর ক্ষয়ক্ষতি হলেও বা বয়সের ছাপ পড়লেও এই মন্দিরগুলোকে চিরযৌবনা বলে মনে হবে।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পরে নির্মিত আহ্নিক মন্দিরটিতে মোট তিনটি কক্ষ আছে একটির সাথে অপরটি লেগে। মাঝেরটি বড়, এতে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ, পাশের দুটো কক্ষে একটি করে রয়েছে। তবে প্রবেশপথগুলো খুবই ছোট এবং সরু। মন্দিরের সামনের দেয়াল ব্যতীত অন্যান্য দেয়ালে কোনো নকশা নেই। সামনের দেয়ালে বিভিন্ন যুদ্ধের কাহিনী এবং দেব-দেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে।
কীভাবে যাবেন
রাজশাহীগামী যেকোনো বাসের টিকিট কেটে “পুঠিয়ায় নামবো” বললেই হবে। পুঠিয়া থেকে রাজশাহী শহর আরো ৪০ মিনিটের পথ। তাই আপনাকে রাজশাহী পর্যন্ত যেতে হবে না যদি শুধু পুঠিয়া রাজবাড়ী ঘুরতে যান। তবে ট্রেনে করে আসলে আপনাকে আবার রাজশাহী টার্মিনাল থেকে একটি বাস ধরে পুঠিয়ায় আসতে হবে। পুঠিয়ায় নেমে যেকোনো ভ্যান বা অটোতে উঠে জনপ্রতি ৫ টাকা ভাড়া দিয়ে সহজেই ৭-৮ মিনিটের ভেতরে পৌঁছে যাবেন শিব মন্দির। তারপর পায়ে হেঁটেই একে একে বাকি নিদর্শনগুলো দেখতে পাবেন।