রাস্তার এক পাশের হাঁটার পথে সারি দিয়ে বসে আছে ছোট-বড় নানা বয়সের মানুষ। তরুণ বয়সী একজন প্রত্যেককে দুটো প্রশ্ন করছেন, “আপনার নাম?“, “আজ আপনি কী ভালো কাজ করেছেন?” উত্তর জেনে টুকে রাখছেন হাতে থাকা ক্লিপ বোর্ডের কাগজে। এই কাজ শেষে সকলকে দেয়া হচ্ছে খাবারের প্যাকেট। রাজধানীর কমলাপুরে দেখা মিললো ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার পাওয়ার ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের।
অনুপ্রেরণা যখন ভালো কাজ
সময়টা ২০০৯ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কয়েকজন তরুণের ভাবনাকে নাড়া দিয়েছিল অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির গল্প। তাদেরই একজন আরিফুর রহমান। তিনি বলছিলেন সে সময়কার কথা, “সে সময় আমরা এক অসহায় বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়ের চিকিৎসা করাতে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার জন্য পথে পথে ঘুরছিলেন তিনি।” ছোট্ট এই কাজ বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছিল তরুণদের জীবনে। এরপর থেকে সামাজিক নানা কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে থাকেন তারা। এরই অংশ হিসেবে কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকায় বাস করা ছিন্নমূল শিশুদের নিয়মিত পড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন এই তরুণেরা। স্কুলে আসতে উৎসাহিত করার চেষ্টায় বিনামূল্যে খাবারও দিতেন তারা।
সময়ের সাথে তাদের পড়াশোনা শেষ হয়, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেদের পেশাগত জীবন নিয়ে। কিন্তু ভালো কাজ করার প্রচেষ্টায় দমিয়ে রাখা যায়নি তাদের। সামাজিক কাজগুলোর বিস্তৃতি ঘটাতে এবং সাংগঠনিক একটি রূপ দেয়ার পরিকল্পনা থেকে ২০১২ সালে তারা ফেসবুকে ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি পেইজ চালু করেন। শুরু হয় তাদের দেশব্যাপী কার্যক্রম। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে এই তরুণরা সময়ে সময়ে সাহায্য নিয়ে ছুটে যেতে থাকেন দেশের নানা প্রান্তে।
ভালো কাজের হোটেলের ভাবনা
“ছোটবেলায় একটি নাটক দেখেছিলাম, হুমায়ুন আহমেদের নাটক হবে। এবং ওটাতে জাহিদ হাসান অভিনয় করেছিল। প্রতিদিন একটা ভালো কাজ বলতো। এই ব্যাপারটা আমাকে নাড়া দিত।“, বলছিলেন ইয়ুথ ফর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা স্বেচ্ছাসেবক আরিফুর রহমান। এই ভাবনা থেকে গত বছরের (২০১৯) ডিসেম্বর থেকে ছিন্নমূল মানুষদের সপ্তাহে একবেলা খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন সংগঠনটির সদস্যরা। করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে লোক জড়ো করে খাওয়ানোর ব্যাপারটি এড়িয়ে নিজেরাই একটি ভ্যানের মাধ্যমে ছিন্নমূল মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়া শুরু করেন। এই বছরের ২৯ আগস্ট থেকে রাজধানীর কমলাপুরের আইসিডি কাস্টম হাউসের কাছের ফুটপাতে ‘ভালো কাজের হোটেল’ নামে হতদরিদ্র এবং ছিন্নমূল মানুষদের প্রতিদিন একবেলা খাবার খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরু করে সংগঠনটি।
বিনামূল্যে এই খাবার মিললেও পূরণ করতে হয় একটি শর্ত, একটি ভালো কাজ করতে হবে। খাবার খেতে এসে যদি কেউ সেদিন কোনো ভালো কাজ করার কথা বলতে না পারেন, তাকেও ফিরিয়ে দেয়া হয় না। ভালো কাজ করার জন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়, উৎসাহিত করা হয় পরদিন দুটি ভালো কাজ করতে। তারপর হাতে তুলে দেওয়া হয় খাবারের প্যাকেট।
সংগঠনসূত্রে জানা গেল, এই হোটেল চালুর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, ভালো ও নেক কাজের চর্চায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। আর দ্বিতীয়ত, ক্ষুধার কষ্ট কমিয়ে ক্ষুধামুক্ত এক বাংলাদেশ গড়া। আরিফুর বলছেন, “প্রতিদিনের একটি ভালো কাজের যোগফল আমাদের জীবনটা কিন্তু পাল্টে দিতে পারে।“
ইয়ুথ ফর বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবক সাকিব হাসান শাওন জানিয়েছেন, “এই হোটেল চালু করার পর প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ মানুষকে খাবার দেয়া হচ্ছে।” তারা শুরুর এক মাসে নয় হাজারের বেশি মানুষকে একবেলা খাইয়েছেন।
ডেইলি টেন
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এই হোটেল কার্যক্রমের আর্থিক উৎস কী? সংগঠনসূত্রে জানা গেল, তারা কারো কাছ থেকে ডোনেশনও নেন না। তাহলে! ইয়ুথ ফর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানকালীন স্বেচ্ছাসেবক শিহানুর রহমান জানালেন, তারা ‘ডেইলি টেন’ নামে একটি বিশেষ তহবিলের মাধ্যমে এই কার্যক্রমটি এগিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলছেন, “রোজ যারা সংগঠনের তহবিলে ১০ টাকা করে জমা দেন, তাঁরাই এই বিশেষ সদস্য।” সংগঠনটির পেইজে কয়েক হাজার সদস্য যুক্ত থাকলেও সর্বশেষ তথ্যমতে ডেইলী টেনের সদস্য সংখ্যা ৩১০ জন। মাসশেষে তাদের প্রত্যেকের থেকে পাওয়া ৩০০ টাকাই এই কার্যক্রমের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে৷
ডেইলি টেন তহবিল থেকে আসা অর্থ দিয়ে পুরো মাস খাওয়ানো যায় না। সংগঠকরা বলছেন, সর্বোচ্চ ১২ কি ১৩ দিন খাওয়াতে পারেন তারা। কিন্তু বাকি দিনগুলো? সংগঠক এবং স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকের বিশেষ দিন উদযাপনের উপলক্ষ থাকে। সেই উদযাপনের অর্থ দিয়ে তারা বাজার করে দেন। কয়েকদিন যায় এভাবেই। আবার সদস্যদের অনেকেই উদ্যোগী হয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেন। সব মিলে ২০ দিনের মতো অসহায় মানুষদের খাবার সরবরাহ করা যায়। এ মাস থেকে সংগঠকরা চেষ্টা করছেন পুরো মাস খাওয়ানোর।
দুপুর দেড়টা ঘিরে ব্যস্ততা
রাজধানীর বাসাবোতে ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ সংগঠনটির একটি স্কুল রয়েছে। সেখানে তারা অসহায়, ছিন্নমূল, পথশিশুদের শিক্ষাদান করে থাকেন। আছে বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থাও। করোনাকালে স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও বেশ সরব স্কুল প্রাঙ্গনটি। ভালো কাজের হোটেলটির রান্নার কাজটি এই স্কুলেই করা হচ্ছে। এই রান্নার কাজটিও স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেরাই করেন। প্রতিদিন সকাল থেকেই মহাব্যস্ততা শুরু হয় স্কুলের আঙিনায়। কেউ হয়তো ধোয়ার কাজ করছেন, কেউ ব্যস্ত কাটাকুটিতে। কেউ আবার রান্না শেষে প্যাকেজিংয়ের কাজ করছেন।
সংগঠনটির ব্যাটারিচালিত একটি ছোট্ট ভ্যানগাড়ি আছে। রান্না শেষে এই ভ্যানগাড়ির মাধ্যমেই খাবারের প্যাকেট নিয়ে যাওয়া হয় ভালো কাজের হোটেলে, যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় শতাধিক অসহায়-ছিন্নমূল মানুষ। তাদের কাছে খাবারের বিল দেয়ার মতো হয়তো অর্থ থাকে না কিন্তু সংগঠকদের ভাষায় তার চেয়েও বড় কিছু নিয়ে তারা অপেক্ষা করে থাকেন প্রতিদানের। সেই বড় কিছুটা একটা ভালো কাজ। কেউ হয়তো বৃদ্ধ কাউকে রাস্তা পার করে দিয়েছেন, কেউ বা বৃষ্টির পানিতে রাস্তায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছেন। একজনের কাছ থেকে জানা গেল, সে তারই এক অসুস্থ বন্ধুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। তারপর নিজেরা কিছু কিছু টাকা জমিয়ে তার জন্য ওষুধ কিনে এনেছে। এমন করেই প্রতিদিন ভালো কাজের ফিরিস্তিতে ভরে যায় স্বেচ্ছাসেবকদের ক্লিপবোর্ডে সাটানো কাগজটি।
শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন দুপুর দেড়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত চলে এই হোটেলের কার্যক্রম। শনিবারেও চলে, তবে ভিন্ন সময়ে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। আর খাবার যদি বেঁচে যায় তাহলে ভ্যানের মাধ্যমে রাস্তার পাশে বসবাস করা অসহায় মানুষদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় খাবার।
শুক্রবারও অবশ্য রান্না হয় বাসাবোর স্কুলটিতে। তবে সেদিন আর ভালো কাজের হোটেলে যায় না সেই খাবার। রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও এতিমখানায় সেই খাবার নিয়ে যান সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবকরা। মসজিদের সামনে আসা নিম্ন আয়ের মানুষ কিংবা এতিমখানায় গিয়ে এতিমদের হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে দেয়া হয়।
খাবারের মেন্যুতে কখনও থাকে খিচুড়ি ও ডিম ভুনা, কখনও বা মুরগীর বিরিয়ানি। ভালো কাজ করে খাবার পেয়ে আবারও ভালো কাজের অনুপ্রেরণা পান এই হোটেলের গ্রাহকেরা। আরেকটি ভালো কাজ করে ফিরে আসেন পরদিন। এমন করেই সমাজের এক ইতিবাচক বদলের আশায় থাকেন এর উদ্যোক্তরা।