একবার ভাবুন তো, ‘সাইদা খানম’ নামটি কি আপনার পরিচিত?
যারা ফটোগ্রাফির জগতের খোঁজখবর রাখেন, তাদের হয়তো সাইদা খানমের নাম শোনার কথা। তবে প্রচারবিমুখ এই মানুষটির কথা খুব বেশি আলোচনায় উঠে আসেনি। আপনি কি স্মৃতি হাতড়ে খুঁজছেন তাঁকে? পেয়েছিন কি? হয়তো পেয়েছেন, হয়তো পাননি। তবে এটুকু নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন যে, সাইদা খানম ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত।
ঠিকই ধরেছেন। সাইদা খানম বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী। এ থেকে হয়তো তার একটি পরিচয় পাওয়া যায়, তবে তিনি যে এই ক্ষেত্রে অনন্য একজন- সেটা বোঝা যায় না। সেটা বোঝার জন্য আপনাকে আরেকটি তথ্য জানতে হবে। সাইদা খানম সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি সিনেমাটোগ্রাফার নন, তাই চলচ্চিত্রে সরাসরি কাজ করেননি। কিন্তু সত্যজিতের ছবির শুটিংয়ে উপস্থিত থেকে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তা-ও একটি নয়, তিন তিনটি ছবিতে!
১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় জন্ম। মায়ের নাম, নাছিমা খাতুন। আর বাবা আব্দুস সামাদ খান কাজ করতেন শিক্ষা বিভাগে। বারো বছর বয়স থেকে ছবি তোলা শুরু। সে সময় মুসলিম পরিবারের নারীরা পড়াশোনা করার সুযোগই ঠিকমতো পেতেন না। ছবি তোলা তো দিল্লী বহুদূর! অথচ বাবার আপত্তি ছিল কেবল দুটো জায়গায়! বিয়ের আসরে আর স্টেডিয়ামে গিয়ে ছবি তোলা যাবে না। প্রথমটি মানলেও দ্বিতীয় কথাটি রাখতে পারেননি। ছবি তুলেছেন, আসলে কাজের খাতিরে তুলতে হয়েছে।
ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন ১৯৪৯ সালে। তবে পেশাদারীত্বের শুরুটা হয়েছে ‘বেগম’ পত্রিকার হাত ধরে, ১৯৫৬ সালে। মেজ বোন একটা ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। সেটি দিয়ে কিশোরী কাজের মেয়ের ছবি তুলেছিলেন সাইদা। পত্রিকায় ছবি প্রকাশিত হবার পর যা হওয়ার কথা, তা-ই হলো। একে তো নারী আলোকচিত্রী, তার উপর ছবির বিষয়বস্তুও এক কিশোরী- এলাকার মানুষ প্রবল বিক্রমে বিরূপ মন্তব্য করতে শুরু করল। তবে, সাইদার পরিবার তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
সবচেয়ে বড় সুযোগটি করে দিয়েছিলেন ‘জায়েদী স্টুডিও’র মালিক জায়েদী। ঢাকায় সেসময় ছবি তোলার স্টুডিওর সংখ্যা হাতেগোনা। এর মধ্যে জায়েদী স্টুডিওর ডাকনাম ছিল বেশ। জায়েদী সাহেব সাইদাকে শুধু যে ছবি নিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তা-ই নয়, তিনি এ সম্পর্কিত প্রচুর বইপত্র-ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগও করে দিয়েছিলেন। ফটোগ্রাফির বিভিন্ন খুঁটিনাটি, অ্যাপারচার, এক্সপোজার, এমনকি ছবির কম্পোজিশন ইত্যাদি বিষয় এভাবেই শিখতে শুরু করেন সাইদা। একজন সত্যিকারের আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার পেছনে জায়েদী সাহেবের অবদান তিনি সবসময় স্বীকার করেন। তার ভাষ্যমতে,
জায়েদী সাহেবই আমার ফটোগ্রাফির প্রথম শিক্ষক।
ছবি তোলার পাশাপাশি পড়াশোনার দিকেও দারুণ মনোযোগী ছিলেন তিনি। যে সময় মেয়েরা সাধারণত ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলত, সেসময় দু-দুটো মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন, ভাবা যায়? ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স করার পর ১৯৭২ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। তারপর ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সঙ্গে প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
তবে, ১৯৫৬ সালেই ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন তিনি। সে বছরই জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন পুরষ্কার পেয়ে যান। মানুষ তাকে ততদিনে চিনতে শুরু করেছে। ‘অবজারভার’, ‘ইত্তেফাক’সহ বেশ কিছু দেশি পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়। দুটো জাপানি পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল তার ছবি। তারই সূত্র ধরে জাপান, ফ্রান্স, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে তার ছবি দেখা যেতে থাকে। ১৯৬০ সালে ‘অল পাকিস্তান ফটো প্রতিযোগিতা’য় প্রথম হয়েছিল তার ছবি। সে সময় বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। পাকিস্তানের মতো একটি গোঁড়া দেশে একজন নারী আলোকচিত্রী প্রথম হয়ে গিয়েছেন, ব্যাপারটা হেলাফেলা করার মতো ছিল না মোটেও।
তারপর এলো মুক্তিযুদ্ধ। ওলটপালট হয়ে গেল সমস্ত কিছু। বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিকদের মতো তিনিও যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ছবি তুলেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর একটি তুলেছিলেন ঢাকার আজিমপুরে। যুদ্ধ শুরুর আগে অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণরত একদল নারীযোদ্ধার ছবি তুলেছিলেন সাইদা খানম। ১৬ ডিসেম্বর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সেনাদের গোলাগুলির খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন ছবি তুলতে। শেষ পর্যন্ত গোলাগুলির প্রচন্ডতা ডিঙিয়ে ছবি তোলা আর হয়নি। তবে, উপস্থিত অনেকেই চমকে গিয়েছিল তার সাহস দেখে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন ছবি তোলা থেকে একটু দূরে ছিলেন। তারপর আবার হাতে তুলে নিয়েছেন ক্যামেরা। ১৯৭৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘অল ইন্ডিয়া ফটো জার্নালিজম কনফারেন্সে’ যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯৮২ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ এশিয়ান গেমসে বেগম পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্ণাঢ্য এবং বিশাল এক কর্মজীবন পার করেছেন সাইদা খানম। ক্যামেরার সঙ্গে তাঁর প্রায় ৬৪ বছরের সংসার। বিয়েও করেননি। ৮২ বছর বয়সী এই মানুষটি এখনো ক্যামেরা নিয়েই দিন কাটান। নিজের তোলা মাদার তেরেসার ছবি নিয়ে তিনি একটি একক প্রদর্শনীও করেছিলেন!
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব- ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়- কার ছবি তোলেননি! সেই সাথে রানী এলিজাবেথ, মাদার তোরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্ন- এর মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরো তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন সাইদা খানম।
১৯৬২ সালে ‘চিত্রালী’ পত্রিকার হয়ে এক কাজে গিয়েছিলেন সাইদা খানম। এর আগেও নানা কাজে কলকাতায় এসেছেন। উত্তম-সুচিত্রাদের ছবি তোলার সুযোগও হয়েছে৷ কিন্তু সত্যজিতের সঙ্গে তখনও দেখা হয়নি তাঁর। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সাইদা খানমের ভাষাতেই শোনা যাক তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প:
এর মধ্যে অনেকবারই ভেবেছি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে। কিন্তু সেভাবে সময়-সুযোগ হয়নি। একবার পত্রিকা থেকেই আমাকে বলা হলো সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কাজ করতে। তো আমি একদিন গেলাম তার বাড়িতে। এটি ছিল লেক টেম্পল রোডে অবস্থিত। একবার ভাবলাম চলে যাই। তিনি হয়তো ব্যস্ত আছেন, বিরক্ত হতে পারেন। আবার কী মনে করে গেলাম তার বাসায়। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কী চাই? সে সময়টাতে অল্প সময় হয়েছে তিনি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমাটি শেষ করেছেন। ওই সিনেমাটি নিয়েই আমি কথা বললাম। তারপর কথায় কথায় আমি একফাঁকে তার কাছে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। পরে শুনেছিলাম তিনি আমার ছবি তোলার প্রশংসা করেছিলেন।
ঘটনার পরবর্তী অংশও সাইদা খানমের মুখ থেকেই শুনবো আমরা। এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে বণিকবার্তায়। সাইদার ভাষ্যমতে,
কয়েক দিন পর আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। মানিকদা আমাকে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র কয়েকটি স্টিল ছবি দিয়েছিলেন। সেই ছবি, আমার নিজের তোলা মানিকদার ছবি এবং সাক্ষাত্কার লিখে যখন পারভেজ ভাইকে দিলাম, তিনি বিস্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী করে এই অসাধ্য সাধন করলেন!’
সেটা কেবল শুরু। পরে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সঙ্গে তাঁর বেশ ঘনিষ্টতা হয়ে যায়। সত্যজিতের স্ত্রীও তাঁকে বেশ স্নেহ করতেন। নানা সময় দুজনেই তাঁকে চিঠি লিখেছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাসায়, ছবির শুটিংয়ে। ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’- এই তিনটি ছবির শুটিংয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন সাইদা খানম। যাঁরা পেশাদার আলোকচিত্রী, তাঁদের জন্য এরকম সুযোগ আসলে চাঁদের বুক ঘুরে দেখার চেয়ে কিছু কম না।
ক্যামেরা ছাড়াও, কলম হাতে বেশ কিছু কাজ করেছেন সাইদা খানম। এর মধ্যে ‘ধুলোমাটি’, ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’ উল্লেখযোগ্য।
সাইদা খানম বাংলা একাডেমি এবং ইউএনএবির আজীবন সদস্যা। সেই সাথে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সঙ্গেও যুক্ত আছেন।
ইতিহাসের ছবি ধরে রাখার প্রত্যয়ে যে মানুষটি কাজ শুরু করেছিলেন, বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসে তিনি এখন পরিণত হয়েছেন এক অনস্বীকার্য অংশে। সম্প্রতি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন এই গুণী আলোকচিত্রী।