এই শহর ভালো না থাকলে, দেশটা ভালো না থাকলে আমরা নিরাপদে থাকি কী করে?
পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রতি এমন বিশ্বাস থেকেই মিশন সেভ বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল দুই মাস আগে।
শুরুর কথা
শুরুটা হয়েছিল লকডাউনের মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়া দিনমজুর মানুষজনকে সাহায্য করার জন্যে। তখনও কোনো প্ল্যাটফর্মের জন্ম হয়নি। মার্চ মাসের তেইশ তারিখে আলাপের শুরুটা হয়েছিল তিনজনের মধ্যে। অসহায় মানুষের পাশে কীভাবে দাঁড়ানো যায়- এ নিয়ে আলোচনা করছিলাম আদনান ইমতিয়াজ, তাজদিন হাসান ও আমি। সেই ভাবনাকে কাজে লাগাতেই পরিকল্পনা, আর একে বাস্তবে রূপ দিতে পথে নামা। এভাবেই শুরু হয়েছিল মিশন সেভ বাংলাদেশের কাজ, মহামারির সময়ে দেশকে বাঁচানোর এক লড়াই। এই লড়াইয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই সংবাদ মাধ্যম দৈনিক সমকাল ও দ্য ডেইলি স্টার এবং সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সেবা এক্সওয়াইজেড।
ছাব্বিশ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হবার গুঞ্জন বাতাসে ভাসছে তখন। আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি দুই হাজার শ্রমজীবী মানুষকে অন্তত দশ দিনের খাবার কিনে দেওয়ার। সেটার জন্য প্রয়োজন প্রায় বিশ লক্ষ টাকা, অথচ হাতে সময় আছে মাত্র তিন দিন! এর মধ্যে এই বড় অঙ্কের টাকা ম্যানেজ করা যাবে তো?
যোগাযোগ শুরু করা হলো কর্পোরেট হাউজগুলোর সঙ্গে। কেউ রাজি হলো, একদম নতুন উদ্যোগ হওয়ায় কারো তরফ থেকে আবার সাড়া মিলল না। কিন্তু হাল ছাড়ার কোনো সুযোগ নেই!
মার্চের ২৩ তারিখে উদ্যোগটা নেয়া হয়েছিল, আর ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হবার কথা। ২৬ তারিখে দেখা গেল, ২২ লক্ষ টাকা জোগাড় হয়ে গেছে! একে একে যুক্ত হতে থাকল আরও প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তি। জন্ম হলো ‘মিশন সেভ বাংলাদেশ‘- এর। ব্র্যান্ডগুলো এই দুর্যোগের সময়ে পেল ভরসা করার মতো একটি জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে কাজ করা যায় মানুষের জন্য।
টিকে থাকার ছোট ছোট গল্প
শুরুটা নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও, আমরা ধীরে ধীরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর কষ্টের দিকে বেশি মনোযোগী হই। এর মাঝে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সরকারি ও অন্যান্য সংস্থার সাহায্যও বাড়তে থাকে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হয়তো চাকরি হারিয়েছেন, কিংবা বেতন আটকে আছে, এদিকে বাড়িওয়ালা চাপ দিচ্ছে বাসা ভাড়া দেওয়ার জন্য। পকেটে টাকা নেই, বাসায় বাজার নেই, কারও কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো অবস্থাও নেই, আত্মসম্মানের কথা ভেবে ত্রাণের জন্য কোথাও লাইনেও দাঁড়াতে পারছেন না- এমন মানুষগুলোর চেয়ে অসহায় অবস্থায় করোনা হয়তো আর কাউকে ফেলেনি। মিশন সেভ বাংলাদেশ এমন সব পরিবারের খোঁজ করেছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তাসলিমার কান্না
পঞ্চাশের কোঠায় বয়স। রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় ফুল বিক্রি করে যে কয় টাকা আয় হতো, তা দিয়েই সংসার চালাতেন তিনি। কিন্তু এখন আর রাস্তায় গাড়ি নেই। ফুল কেনার মতো মানুষও নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেও তার কোনও উপার্জন নেই। কঠিন হয়ে পড়েছে জীবন বাঁচানো। এর মাঝে হঠাৎ খবর পেলেন- রায়েরবাজার এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। গরীব মানুষকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। ছুটে গেলেন সেখানে, কিন্তু ত্রাণ মিলল না। ভেবেছিলেন সেখানে গিয়ে দু’দিনের খাবার জোগাড় হবে; কিন্তু পেলেন না। তখনই কান্না চলে আসে তার, কাঁদতে থাকেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তাসলিমার কান্নার সেই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভিডিওটি দেখে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালায় ‘মিশন সেভ বাংলাদেশ’। এরপর মিশন টিম পৌঁছে যায় রায়েরবাজার লোহারগেইট এলাকায় তাসলিমার বাড়িতে। তাকে দেওয়া হয় কয়েকদিনের নিত্যপণ্য। ত্রাণ পেয়ে মুখে হাসি ফোটে তাসলিমার। এমন বহু মানুষের মুখে এই মহামারির সময়ে হাসি ফোটাতেই কাজ করছে আমাদের মিশন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব
“একসময় সবই ছিল- নিজের গাড়ি, ফ্ল্যাট। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা ছিল। কিন্তু গত ছয় বছরে আমি একে একে সব হারিয়েছি।” এমনই কিছু কথা আমাদের কাছে লিখেছিলেন নটরডেম কলেজের এক প্রাক্তন ছাত্র। উবারে গাড়ি চালাতেন তিনি। পুরো পরিবারের দায়িত্ব ছিল তার উপর। একসময় ভালো চাকরি করলেও এখন দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষের কাতারে তিনিও। গাড়ি চালিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে জীবন চলছিল। পরিবারে দুটো ছেলে, দুজনেই পড়াশোনা করছে।
লকডাউনের ফলে সবকিছু যখন স্থবির, তখন বন্ধ হয়ে যায় এই মানুষটির আয়ের পথও। নিজের না খেয়ে থাকা নিয়ে যতটা না বিচলিত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি অসহনীয় ছিল সন্তানদের অনাহারী মুখ দেখাটা। যেকোনো বাবার জন্যই সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে এটি। একরকম নিরুপায় হয়েই তিনি যোগাযোগ করেন মিশন সেভ বাংলাদেশের সাথে। এরই মধ্যে ক্লাব নটরডেমিয়ান আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে, আমি নিজেও নটরডেম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, অসুবিধায় থাকা নটরডেমিয়ানদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি আমরা। মিশন সেভ বাংলাদেশ প্রথমে এই পরিবারকে দুই সপ্তাহের খাবার পৌঁছে দেয়। শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভাইয়া আবার ফোন করেন। বললেন, “সবার কাছে তো মুখ ফুটে বলতে পারি না, তোমাদের কাছে যখন বলেই ফেলেছি, খাবার কি আরেকবার পাঠানো সম্ভব?” পৌঁছে দিয়েছি আমরা।
চার দিন পর বাসায় জ্বলল চুলা
জীবনে একদিন এরকম সময় আসবে, যখন ঘরে টানা চার দিন চুলা জ্বলবে না। এটা অনেকের মতো সামাদ সাহেবও চিন্তা করেননি। সাত সন্তানের জনক তিনি; হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করে স্বচ্ছলভাবেই জীবন চলছিল, চট্টগ্রামের বনেদী এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। কিন্তু ঘরে তিন বেলা খেয়ে বাঁচার মতো কোনো খাবার থাকবে না, এমন কথা কখনও চিন্তাও করেননি তিনি। লকডাউনের পর থেকেই উপার্জনের সব পথ বন্ধ, সাথে ঋণের কারণে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, সবমিলিয়ে একেবারে নিরুপায় হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সারাজীবন মাথা উঁচু করে বাঁচা মানুষটি কারও কাছে যে সাহায্য চাইবেন, সেটিও হয়তো মেনে নিতে পারছিলেন না। এই অবস্থায় সাহায্য পাওয়ার সব পথ বন্ধ বলে এই বয়সে এসে ঘরের মধ্যে একরকম না খেয়েই দিন কাটাচ্ছিলেন তারা।
মিশন সেভ বাংলাদেশের কাছে মেসেজ দেন তার পরিবারেরই একজন। জানান তাদের দুরবস্থার কথা। কিন্তু সারাজীবন সংগ্রাম করে যে সম্মান ও সামাজিক অবস্থায় নিজেদের নিয়ে গিয়েছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে ত্রান সামগ্রী গ্রহণ করাটা অনেক কঠিন। প্রথম যখন আমাদের টিম থেকে ফোন করলাম, তিনি বললেন, আমি ভালো আছি, কোনো সাহায্য লাগবে না। বলেই ফোন রেখে দিলেন। পরে আমাদের টিম থেকে আবার ফোন দিলাম। তাকে বুঝিয়ে বলা হলো, এটা সাহায্য না, আমরা রমজান উপলক্ষে কিছু ভালো ব্যবসায়ীকে গিফট প্যাক পাঠাচ্ছি, তাই আপনার জন্যও পাঠাতে চাই। কারণ আপনার অবদান, আপনার কাজকে আমরা সম্মান জানাই। তিনি রাজি হলেন।
বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার দশ মিনিট পর সত্তরের কাছাকাছি এই আংকেলের ফোন, “বাবা, কিছু মনে করো না, সত্য কথা হচ্ছে বাসায় গত চার দিন ধরে কোনো খাবার ছিলো না, শুকনো খাবার খেয়ে ছিলাম আমরা। আজ চার দিন পর বাসায় চুলা জ্বলেছে…। আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুক বাবা।”
এমন অজস্র গল্প জমা হয়েছে গত দুই মাসে।
আমাদের অগ্রযাত্রা
মিশন সেভ বাংলাদেশ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তি থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৬৭ লাখ ৫২ হাজার ৮৭২ টাকা অনুদান হিসেবে পেয়েছে। যা দিয়ে আমরা দেশের ১৪টি জেলার ১১,৩১৫টি পরিবারের ৫০,৯১৮ জনকে দুই সপ্তাহের খাদ্য সহায়তা দিতে পেরেছি। ৪০৪টি পরিবারের ১৮১৯ জন মানুষ পুরো রোজার মাসজুড়ে পেয়েছেন সেহরি ও ইফতার। করোনার কারণে অসুবিধায় পড়া এক হাজার মধ্যবিত্ত পরিবারকে আমরা খাবার পাঠিয়েছি ‘ঈদ শুভেচ্ছা’ হিসেবে।
এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ১৬টি হাত ধোয়ার বেসিন বসানো, ২০,০৯৫টি মাস্ক বিতরণ, ৪৮১টি স্থান জীবাণুমুক্তকরণ, ১৭০টি নিত্যপণ্যের দোকান ও ফার্মেসির সামনে নিরাপদ দূরত্ব চিহ্ন দেওয়া, ৩৭০ জন চিকিৎসককে পিপিই প্রদান এবং একটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর উদ্ভাবনী প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন করা হয়েছে মিশন সেভ বাংলাদেশের উদ্যোগে। করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা যাতে অনুদান ও ঋণ সহায়তা পান সেই লক্ষ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিকম অপারেটর রবি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসিকে সাথে নিয়ে গঠন করা হয়েছে ৪০ কোটি টাকার মুলধন সহায়তা তহবিল। সেইসাথে ট্রাই ফাউন্ডেশনকে সাথে নিয়ে ৪০০ জন ব্যবসায়ী ও ২০টি টেইলর প্রতিষ্ঠানকে ব্যাবসায়িক রি-স্ট্রাকচার ফান্ডিং করা হচ্ছে এই মিশনের উদ্যোগে।
যাত্রার পর থেকে আজ পর্যন্ত হিসেব করলে, আড়াই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ সমর্থন পেয়েছি আমরা এই সময়ে, এখনও পাচ্ছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- এই পৃথিবী, এই দেশ, এই শহর বসবাসের জন্য উপযোগী করার পেছনে যে দায়িত্বগুলো আছে, আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেই দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা আমাদের সবার, এই দেশটাও আমাদের সবার। একা বেঁচে থাকাটাকে বাঁচা বলে না, সবাইকে নিয়ে আমাদের এই বেঁচে থাকার প্রয়াসের নামই মিশন সেভ বাংলাদেশ। আর এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পগুলোই আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অণুপ্রেরণা।
লেখক: মিশন সেভ বাংলাদেশের সহ-প্রতিষ্ঠাতা