‘সিঙ্গাপুর ডায়রি’
– তাসনিম আহসান
১.
এই মুহূর্তে আমার গুগলের সার্চবারে লেখা আছে, ‘উইটি বেগিং কোটস’ যেটা লেখার সরল উদ্দেশ্য হলো, কীভাবে লোকজনকে হালকা বিনোদন দেওয়ার মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি করা যায়। এই পোস্টটি লেখার আগে ইন্টারনেটে একরকম নিরুপায় হয়েই এই খুবই মজার অথচ আমার বাস্তবতার সাথে অসম্ভব প্রাসঙ্গিক জিনিসটা সার্চ দিচ্ছিলাম। সেখানে ভিক্ষাবৃত্তির কিছু ভালো ভালো নিনজা টেকনিক লেখা আছে। যেমন- ডোন্ট ব্র্যাগ, বি ডিরেক্ট, বি অনেস্ট, বি হাম্বেল, ইউজ সেলেব্রিটিস ওয়াইজলি, নো ওয়ান রিয়েলি কেয়ারস, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই নিনজা টেকনিকগুলো আমি যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করব এখন থেকে। এছাড়া তেমন কোনো উপায়ও আমার অবশিষ্ট নাই। দেখা যাক এই লেখায় কতটুকু টেকনিকগুলো মেনে চলতে পারলাম। যদিও ইন্সট্রাকশন ফলো করার ব্যাপারে আমি বরাবরই কাঁচা যেটা আমার চুয়েটের কম্পিউটার প্রকৌশলে করা গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেটে লাল কালিতে বড় বড় করে সিজিপিএর ঘরে লেখা আছে।
প্রতিটা থিসিস পেপারে যেমন একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট থাকে, আমি চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, আমার এই ভিক্ষাবৃত্তি প্রজেক্টেও একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট থাকা জরুরি। মুভিপ্রিয় সমাজের জন্য এটাকে ফ্ল্যাশব্যাকও বলা যায়। ঝির ঝির শণৈঃ শণৈঃ বাতাস ভিত্তিক ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর কল্পনা করে নিন ভাইয়া – আপারা, সাঁই করে আমরা বলিউড ড্রামার মত ঠিক গত বছরের মে মাসের ২২ তারিখে চলে যাব।
২.
২০১৮ সালের মে মাসের বাইশ তারিখে ধানমণ্ডির আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেলের সামনে একটি রমজানের বিকেলে ৫ টি মানুষকে কল্পনা করুন। আমি, আমার স্ত্রী – বাবা – মা ও বোন।
আমাকে ঐদিন বাংলাদেশের মেডিসিন জগতের দিকপাল প্রফেসর আযিযুল কাহহার এর চেম্বার জানাচ্ছেন যে আমি টি টাইপ অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকিমিয়ায় (T – ALL) আক্রান্ত।
এটি হুমায়ূন আহমেদের বদৌলতে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজে একটি হিট রোগ। এইসব দিনরাত্রি নাটকের টুনী নামের ৭/৮ বছরের চরিত্রটি এই রোগে মারা গিয়ে এই রোগকে বিখ্যাত করে গেছেন। এইসব দিনরাত্রি অবশ্য আজকে থেকে ৩৫ – ৪০ পুরোনো মেডিকেল বাস্তবতায় লেখা। উপন্যাসের সেই ছোট্ট টুনী জার্মানি একটা হাসপাতালে তার চাচী শারমিনের কোলে মারা যায়। যদিও আমার বাবা কাজী নজরুল ইসলামের একজন পরম ভক্ত হওয়ার কারণে হুমায়ূনের টুনী নির্ভর বাস্তবতায় তীব্র অসম্মতি জানাবেন সেটা ধর্তব্যই ছিল। সেই ঘটনাক্রমে তিনি তাঁর সমস্ত অর্থনৈতিক প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাকে নিয়ে জুনের ১১ তারিখেই সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হস্পিটালে চলে আসেন।
স্পেয়ারিং দ্যা রেটরিকাল জিবরিশ অ্যাসাইড, গত দেড় বছরে আমি আমার ব্লাড ক্যান্সারের ফুল ব্লোন চিকিৎসা নেই। জুন মাসের ২০ তারিখ থেকে শুরু করা হয় হাইপার সি- ভ্যাড প্রটোকলের কেমোথেরাপি, যেটা চার সাইকেল সম্পন্ন করে শেষ হয় সেপ্টেম্বর নাগাদ। এরপর চিকিৎসার শেষ ধাপ হিসেবে গত বছরের অক্টোবরে করা হয় অ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট।
গত বছরের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সব কিছু বেশ স্বাভাবিকই চলছিল, যদিও প্রতি সপ্তাহে করা অবজারভেশনের খাতিরে আমি এর মধ্যে একবারও দেশে যেতে পারি নাই। আমার ইম্যুন সিস্টেম সম্পূর্ণ জিরো থাকার কারণে আমার ডাক্তার আমাকে কখনোই আসলে দেশে যাওয়াটা পারমিট করেন নাই।
৩.
গুগলে স্মার্ট বেগিং এর প্রথম শর্তই ছিল ডোন্ট ব্র্যাগ। অনিবার্য কারণবশত নিজের মিডিওক্রিটির ইফেক্ট স্বরুপ নিজেকে অবশ্য এখন পর্যন্ত এই ভিক্ষাবৃত্তি পোস্টে ব্র্যাগ করতেই দেখছি। আমার জীবনের ভয়াবহতম দুঃসময়ে আপনারা এই ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে কেন যেন মনে হচ্ছে বলেই এই সুযোগটা বোধহয় অবচেতন ভাবে নিয়ে ফেললাম।
এনিওয়ে, লেটস জাম্প টু দ্যা অ্যাবস্ট্রাক্ট’স কনক্লুশন। গত কিছুদিন আগে আমার ডাক্তার আমাকে জানাচ্ছেন যে, আমার গত দেড় বছরের চিকিৎসার ফলাফল স্বরুপ আমার আসলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবার কথা থাকলেও সেটা আসলে হচ্ছে না।
আমার গতকালকে করা পেটস্ক্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, ব্লাড ক্যান্সার বাবাজী আমার কিডনী ও চেস্টের কিছু এরিয়া বেয়ে সূঁচ হয়ে ঢুকে বেশ একটা পিলার হয়ে অবস্থান করার এক মহান মতলব ফেঁদে বসেছেন।
সুতরাং আমাকে আসলে সেইম ট্রিটমেন্ট কোর্সের ভিতর দিয়ে আরেক দফা যেতে হবে।
আজকে সকালেই ডাক্তার আমাকে বললেন, আমার আবার কেমোথেরাপি ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যাওয়াই সম্ভাব্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান। দুই – একদিনের ভিতরেই আমি ফ্ল্যাগ – আইডিএ নামক কেমোথেরাপি প্রটোকল নেওয়া শুরু করব।
যেহেতু এটি একটি ফেরত আসা ব্লাড ক্যান্সার ফেনোমেনন বা রিল্যাপ্সড কেস তাই যৌক্তিক ভাবে আমার এবার কম্পলিকেশন অথবা ডোনার ম্যাচিং একটি নেক্সট টু ইম্পসিবল ধরণের প্রক্রিয়া হবে। পুরনো ডোনার ব্যবহার করাও এখন স্কোপের বাইরে বিকজ অফ টেকনিকাল রিজন্স।
৪.
এই ঘটনা মোটামুটি দিকে দিকে রাজ্য করা আমার বর্তমান বাস্তবতায় আসলে খুবই জরুরি, কেননা, গত দেড় বছরের শুধুমাত্র চিকিৎসা খরচ বাবদ আমার পরিবারের প্রায় ৩ লক্ষাধিক সিঙ্গাপোরিয়ান ডলার ফস করে বের হয়ে গেছে, বাংলা টাকায় যেটা দুই কোটি প্লাস ধরণের একটা অসম্ভব অ্যামাউন্ট। থাকা – খাওয়া – বাসা ভাড়া এগুলোর হিসাব তো বাদই দিলাম।
লেখার এই পর্যায়ে আমি আমার লিস্টে যারা ফেসবুক ইনফ্লুয়েন্সার আছেন, তাঁদের করজোড়ে অনুরোধ করব, যেন তারা আমার এই লেখাটি তাঁদের বিরাট ফলোয়ারদের মাঝে একটু সারকুলেট করেন অথবা বন্ধুরা কপি করে হোক অথবা শেয়ার করে হোক নিজস্ব পরিমণ্ডলে ক্যাম্পেইন করেন। যদিও জানি এই ধরনের অর্থ চাই সংক্রান্ত পোস্টে নানা ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ মোটেও নতুন নয় ও খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার এই কেসটি মোটেই ফ্রড কেস নয় সেটা হলফ করে বলতে পারি। মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলার কোনো সুযোগ আসলে আমার নেই। আমার অসুস্থতা প্রমাণ করা আমার জন্য জটিল কিছু নয়।
কাটিং ব্যাক টু দ্যা মোমেন্ট, আমার বোকা বাবা – মা ও পিতা – মাতা তুল্য পরিবারের মুরুব্বিরা অবশ্য এই অবশ্যম্ভাবী অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সামনে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন এবং তারা এই যুদ্ধ আরেকবার চালিয়ে যাবেন বলে ভাবছেন। আমি যদিও যখন তাদেরকে মানি সোর্স জিজ্ঞেস করছি অথবা কীভাবে এটা সম্ভব হবে জানতে চাচ্ছি তখন তারা আমাকে ধমক ধামক দিয়ে আগের বারের মতই থামিয়ে দিচ্ছেন। যদিও তাদের ধমকের জোর এবার খুব একটা নিনজা ধরনের হচ্ছে না, কারণ আমি তাঁদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে বেশ একটা পরিস্কার আইডিয়া করতে পারছি।
৫.
স্মার্ট বেগিং এর একটি কথা আমি মোটেই বিশ্বাস করি না যে নো ওয়ান রিয়েলি কেয়ারস৷ পিপল ডু কেয়ার। এর প্রমাণ আপনারা আগের বার আমার পরিবারকে বেশ স্ট্রংলি দিয়েছেন। আরেকবার এই ধরণের মেডিকেল ক্যাম্পেইন রিভাইভ করা অবশ্যই জটিল একটা ব্যাপার, যেটা চাইলেই আপনারা খুব সহজেই সফল করতে পারবেন। যদিও এই ডিলেমা আপনাদের মনে আসা খুবই স্বাভাবিক যে, একই মানুষ কেন দুবার আপনাদের দানের অথবা মহানুভবতার সুযোগ পাবে? এটা অত্যন্ত যৌক্তিক একটা জিজ্ঞাসা, যৌক্তিক একটা প্রশ্ন।
এর খুব সুন্দর যৌক্তিক উত্তর দেওয়ার মত বুদ্ধি আসলেই আমার নেই। এর উত্তরে আমি সরাসরি কোনো উত্তর দিতে না পারলেও একটা গল্প হয়তো শেয়ার করতেই পারি।
আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন অথবা অনেকেই জানেন না, আমি ও আমার বন্ধু তমা আলম দীর্ঘ নয় বছর ঘটঘট শেষে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই যার মাত্র নয় মাসের মাথায় আমার এই ক্যান্সার ধরা পড়ে৷ প্রথমবার ধরা পড়ার পরে সে প্রচণ্ড ধরনের সাহস দেখিয়ে আমার পাশে দিন-রাত আক্ষরিক অর্থেই দাঁড়িয়ে থেকেছে, কিন্তু এবার ক্যান্সারের খবর শোনার পর সে ‘সেভেন সেভেনে’ দুটি গুটি লাগিয়ে নয়-নয় আঠারো হাজার টাকা পাওয়া সেই লোকটির মত প্রায় ‘দেড় মাস পাগল আছেলাম’ পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। তার চিন্তা ভাবনায় আমি কোনো প্রকার স্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছি না।
আমি শুধু এইটুকু জানি, আপনারা একটা পজিটিভ সিদ্ধান্তের বশবর্তী হয়ে যদি মেহেরবানি করে আমার ও আমার পরিবারের পাশে একটু দাঁড়ান, তাহলে আমি হয়তো আরেকবার আমাদের স্বপ্নগুলো নিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে গল্প করার সুযোগ পাব। আমার অসহায় মা – বোন ও অভিমানী বাবা হয়ত ‘আবার তাঁদের একমাত্র ছেলে ও ভাই কে শীঘ্রই বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন’ সেই সাহস টুকুন ফেরত পাবেন।
এর চেয়েও বড় কথা, আমি আসলে অত্যন্ত অভিমানী ধরনের বোকাসোকা একটা মানুষ। আমি খুব চাচ্ছি যেন আপনারা আমার পাশে দাঁড়ান। একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর এইটুকু আশা আপনারা পূরণ করবেন।
এইটা কি খুব বেশি চাওয়া? আমার পরিচিতজনদের কাছে এইটুকুন চাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?
আমি জানি, এই টুকু স্বার্থপরের মত চাওয়ার অধিকার আমার অবশ্যই আছে।
থাকতেই হবে।
আপনাদের কে আমি ভালোবেসেছি, এখন আপনারা বাসবেন, এটাই কি সুন্দর ও শোভন নয়?
আল্লাহ চাইলে সমস্তই হতে পারে। আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখছি।
যেটা হবে সেটা আল্লাহ ভাল মনে করবেন বলেই হবে। আমার জন্য আপনারা দুয়া করবেন। আপনাদের বাসার মুরুব্বী দের বলবেন দুয়া করতে।
অনেক মানুষের সাথে অন্যায় করেছি। তাঁরা দয়া করে দাবি রাখবেন না।
আপনাদের সবার জন্য ভালোবাসা।
—————————————————
আমি ব্যাংকের বিবরণটাও এখানে লিখে দিচ্ছি সুবিধার জন্য:
Name: Sayed Tasneem Ahsan
A/C Number: 1221260069449
EASTERN BANK LIMITED, Pragati Sarani Branch
(For Foreign Transfer)
Name: Sayed Tasneem Ahsan
A/C Number: 1221260069449
EASTERN BANK LIMITED
Swift Code: EBLDBDDH
Routing Number: 095264093
Name: Halima Khatun
Sonali Bank, Lalmatia Dhaka
A/C Number: 4416434093686
Swift Code: BSONBDDH
Routing Number: 200262835
Bkash:
880 172 010 5989 (Tasneem’s Mother)
880 171 300 7073 (Tasneem’s Father)
880 177 883 8487
Contact Point:
Joshim Sir: 880 171 114 5643
Shafayat: 880 172 093 9150 (bkash)
Bappy: 880 191 841 14553 (Rocket)
Pavel: 880 170 845 3328
Emergency Contact: 880 171 939 7728
ক্যান্সার আক্রান্ত তাসনিম আহসান এর ‘সিঙ্গাপুরের ডায়রি’ শিরোনামের এই লেখাটি আমরা সরাসরি প্রকাশ করছি রোর বাংলার পাঠকদের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী তাসনিম এই মায়াভরা পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা পাবেন, এটাই আমাদের আশা। – সম্পাদনা পর্ষদ।