স্কুলের সঙ্গেই লাগোয়া খেলার মাঠ ও তার পাশে বুড়ো বটগাছ। সেই গাছের নিচে আমাদের গানের নিয়মিত আসর জমত টিফিনের ছুটিতে। …গাইতাম খোলা মাঠে, পাশে ধর্মসাগর দিঘি- বড় বড় গাছের তলায়, রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে, বাদলে, শীতে, কী আনন্দই না পেয়েছি প্রকৃতির কোলে মাটির গান গেয়ে দিন কাটিয়ে।
বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীতজ্ঞ শচিন দেব বর্মণ তাঁর ছোটবেলার স্কুলটি নিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণ করে গেছেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেট্রিক পাশ করেন শৈশবের স্কুল কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে।
কুমিল্লা জিলা স্কুল; কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে প্রায় পৌনে ছয় একর জমিতে শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
১৮৩৭ সালের ২০ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কুমিল্লা সরকারি স্কুল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ভারত সরকার ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে স্কুলটিকে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের রূপ প্রদান করে এবং ‘কুমিল্লা জিলা স্কুল’ নামকরণ করে। ১৮৫৪ সালে এই বালক বিদ্যালয়টি ত্রিপুরার জনশিক্ষা দপ্তরের আওতায় আসে এবং ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
শুরুর দিকে ত্রিপুরার মহারাজ ধর্মমানিক্যের খননকৃত নগরীর ধর্মসাগরের পূর্ব পাড়ে ছোট্ট বাংলো ঘরে ৩৭ জন ছাত্র, ৪ জন শিক্ষক নিয়ে এই স্কুলের পাঠদান শুরু হয়। সেসময় পাঁচজন ইউরোপিয়ান, একজন হিন্দু ও তিনজন মুসলিম শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির একটি কমিটি এই স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। ১৮৩৯ সালের ৬ মে তৎকালীন কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের প্রধান করণিক জনাব হেনরি জর্জ লেচিস্টারকে এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৮৭০ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।
১৮৬২-তে ঝড়ে বাংলো ঘরটি বিধ্বস্ত হলে স্থানীয়দের আর্থিক সহায়তায় স্কুলে বিল্ডিং তৈরি করা হয়। আশির দশকে বর্তমান প্রশাসনিক ভবনটি নির্মাণের আগপর্যন্ত সেই বিল্ডিং টিকে ছিল। বিগত ১৮৩ বছরে ৫৩ জন শিক্ষক এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
যারা দেশ সেরা এই স্কুলের আঙ্গিনায় নিজেদের শৈশব কাটিয়েছে তাদের এই স্কুল নিয়ে গর্বের শেষ নেই। এই স্কুলের ছাত্রদের ঐতিহাসিক নানা সাফল্যের গল্প বারবার উচ্চারিত হয়েছে দেশজুড়ে।
আবু জাহিদ ও আবদুল্লা-হিল-বাকী- একাত্তরে দুজনই ছিলেন কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র। জাহিদ পড়তেন নবম শ্রেণীতে আর বাকী দশম শ্রেণীতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার চারগাছ বাজারের এক যুদ্ধে আবু জাহিদ শহীদ হন। কুমিল্লা জিলা স্কুলের ফোরাম ‘৭৩ উদ্যোগী হয়ে স্কুলের মিলনায়তনটির নামকরণ করেছে ‘শহীদ আবু জাহিদ মিলনায়তন’। বেঁচে থাকলে আবু জাহিদও ১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতেন। এই স্কুল থেকে ১২২ জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে শহীদ হন ১০ জন। এমন করে যুগে যুগে নানা সংকটের সময়ে এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাম গর্বের সাথে উচ্চারিত হয়েছে।
এ প্রতিষ্ঠানের অনেক কৃতী ছাত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী ও দেশবরেণ্য আলোকিত মানুষ হিসেবে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণ, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সহ দেশবরেণ্য অনেক ব্যক্তিত্ব ৫.৬৯ একরের এই ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করেছেন। এই স্কুলের ১৯৬৩ ব্যাচের ছাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রথম নকশাকার শিব নারায়ণ দাসকে ‘৬২ এর ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় পাকিস্তান সরকার স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছিল।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের একাডেমিক সাফল্যের গল্পটা বরাবরই ঈর্ষা জাগানিয়া। স্কুলের স্বর্ণযুগের স্থপতি জনাব নূর আহম্মদ খানের নাম এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর চৌকস মেধা ও শ্রমে স্কুলের শৃঙ্খলা ও শিক্ষার মানকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে সারা বাংলায় ‘কুমিল্লা জিলা স্কুল’ ১৯৬৯-৭০ সালে ‘শ্রেষ্ঠ স্কুল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেই সাথে সত্যনিষ্ঠ ও কঠোর সংগ্রামী এই কিংবদন্তী তাঁর কর্মকুশলতার পুরস্কার হিসেবে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক স্কুলের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক সম্মানে ভূষিত হয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদক (স্বর্ণ পদক) লাভ করে তদানীন্তন পাকিস্তানে আলোড়ন তোলেন।
২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বছরই শতভাগ পাশের হারের গৌরব রয়েছে স্কুলটির। সমান তালে এসএসসিতেও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখছে এই স্কুলের ছেলেরা, আছে টানা বেশ কয়েকবার বোর্ড সেরা হওয়ার কৃতিত্বও।
জিলা স্কুলে যারাই শিক্ষা গ্রহণ করে গিয়েছে তাদের কারো কাছেই ক্যাম্পাসটি একটা গৎবাঁধা পড়াশোনার জায়গা ছিল না। বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব, জীবনের পাঠ কিংবা নিয়মের মাঝেই নিয়ম ভাঙার যত গল্প- সবকিছুরই শুরুটা এই স্কুল থেকেই। জিলা স্কুল তাই বর্তমান-প্রাক্তন সকলের কাছে সবসময়ই আবেগের কিংবা পরম শ্রদ্ধার জায়গা।
স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বহু বছর পরও তাই স্কুলটা ঠিক আগের মতোই টানে এখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের। এখনও নানা শহরে চলতে-ফিরতে স্কুলের বন্ধুদের খুঁজে ফেরে সবার আগে। নানা ব্যস্ততার পর ছুটি পেয়ে কুমিল্লায় আসলে এখনও প্রাক্তন ছাত্ররা ছুটে আসে স্কুলের আঙিনায়, জমে আড্ডা, চলে খেলা কিংবা পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ।
জিলা স্কুল নিয়ে গর্বের জায়গাটা একটি গোল্ডেন জিপিএ-৫, বোর্ডে প্রথম হওয়া থেকে আরও অনেক উঁচুতে। এক জিলা স্কুলের জীবন থেকে যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায় বোধহয় মানুষ হওয়ার মানবিক শিক্ষা। এই শিক্ষাটাই কাজে দেয় সারাজীবন। জিলা স্কুলকে গর্বের বিদ্যাপীঠ বলার কারণ তো এখানেই।