গল্পটা দেশের একটি স্থলবন্দরসমৃদ্ধ প্রান্তীয় জেলার। এখানে বছরের একটা সময় রঙমশাল জ্বালিয়ে উঁকি মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সাম্প্রতিক অতীতে চা বাগানও গড়ে উঠেছে এখানে। কমলা চাষেও পিছিয়ে নেই। অত্যাধুনিক এবং মনোরম এশিয়ান হাইওয়ে এ শহরের বুকের ওপর দিয়ে চলে গেছে। হিমালয়ের আশীর্বাদপুষ্ট বলে ভৌগোলিক উপনামে ‘হিমালয়কন্যা’ বলেও পরিচিতি আছে।
বাংলাদেশের সাথে সড়কপথে সুদূর চীনের যোগাযোগ স্থাপনকারী সর্বপ্রাচীন সড়কটি এ জেলা দিয়েই দেশে ঢোকে, যার যোগ ছিল সম্রাট শেরশাহকৃত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সাথে। সেটা এখন নদীগর্ভে বিলীন। নিকট অতীতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় এ জেলাতেই (২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। এমন হাড়কাঁপানো শীতেও নাকি অতিথি আপ্যায়নে ওদিককার মানুষের জুড়ি মেলা ভার! কঠিন শীতের রাতে আশ্রয়প্রার্থী গেলেই তারা পিঠাপুলির পসরা সাজিয়ে বসে বলে কথিত আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বও কম নয় জেলাটির।
এত কিছুর পরও পঞ্চগড় কী কারণে যেন আন্ডাররেটেড রয়ে গেছে!
বাঙলা গদ্যের ইতিহাস অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। চোখ-কান-মন খোলা রেখে পড়লে বোঝা যায়- গদ্যধর্মী বাঙলা সাদরেই গ্রহণ করেছে পঞ্চগড়কে।
১৫৫৫ সাল। বাঙলা সাহিত্যের যুগবিভাগে স্পষ্টতই মধ্যযুগ। আরো স্পষ্ট করে বললে চৈতন্য-পরবর্তী যুগ। বাঙলা গদ্যের তখনও সূচনা হয়নি। মোটাদাগে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত কাব্যেই নিহিত ছিল বাঙলা সাহিত্য। গদ্যধর্মী লেখা আসে আরো বহুদিন পর। মানুষের জীবনাচরণেও তার আগে কাব্যধর্মী ভাষা ব্যবহৃত হতো বলে ধরা যেতে পারে। তাহলে ১৫৫৫ সালে কী এমন ঘটনা ঘটে? গদ্যের সূচনা না হলেও সেই বিশেষ ঘটনাটি হলো ভাষায় গদ্যের আভাস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সেকালের দুটো চিঠি এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ দলিল। প্রথমটি কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ ভূপ অহোমরাজ চুকুম্ফাকে পাঠান। জবাবে অহোমরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে নরনারায়ণকে ফিরতি চিঠি লেখেন।
নরনারায়ণ ভূপের চিঠি অহোমরাজকে,
লেখনং কার্য্যঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্চা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বর্দ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমারো এ গোট কর্তব্য উচিত হয়। না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম্। সতানন্দ কর্ম্মী, রামেশ্বর শর্ম্মা, কালকেতু ও ধুমাসদ্দার উদ্ভণ্ড চাউলিয়া, শ্যামরাই ইম্রাক পাঠাইতেছি। তামরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা। অপর উকীল সঙ্গে ঘুড়ি ২, ধনু ১, চেঙ্গা মৎস্য ১, জোর, বালিচ ১, জকাই ১, সারি ৫ খান এই সকল দিয়া গইছে। আরু সমাচার বুজি কহি পাঠাইবেক। তোমার অর্থে সন্দেশ গোমচেং ১, ছিট ৫, ঘাগরি ১০, কৃষ্ণচামর ২০, শুক্লচামর ১০।
ইতি শঁক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়।
পত্রবাহকের সাথে উপঢৌকন পাঠানোর রেওয়াজ বহু পুরোনো। তবে এক্ষেত্রে কোচবিহারের রাজার পাঠানো উপঢৌকন চুকুম্ফার জন্য অপমানজনক।
প্রতিক্রিয়ায় ক্রুদ্ধ অহোমরাজ লিখলেন,
আমি শুনিছিলোঁ কোচর দেশেত মানুতে মানুহর ভুরুর গারুত শোবে(,) সেই দেখি আমার দেশলৈকো এইটো মানুহর ভুরুর গারু দিছে হবলা। আমার দেশত কিন্তু কাউরি শকুনেহে মরাশ ব্যবহার করে। এই মাছ যে আনিছে তাক আমার মানুহে ব্যবহার ন করে। কোচর নিচিনা হারাম খোরহে তার সোবাদ জানে। আরু এই সারী কেইখন যে পঠাইছে তাক আমার দেশর খারচাইহঁ তেহে পিন্ধে। জকাই দিছে জকাইরো তিনটা চুক। পৃথিবীরো তিনটা কোন্। কিন্তু ঠাই পানিতহে জকাইবার পারি অঠাই। পানিতে জকাই বারলৈ গলে বুরি মরিব লাগে।
প্রথম চিঠির বিদায় গ্রহণের অংশে শকাব্দের হিসেবে তারিখ লেখা। শকাব্দের শুরু খ্রিস্টের জন্মের ৭৮ বছর পরে। সেই অনুসারে, ১৪৭৭ শকাব্দের আষাঢ় মাস প্রকারান্তরে ১৫৫৫ সালকেই নির্দেশ করছে। দুটো চিঠির ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পাওয়া যায় অহমিয়া ভাষার ঘ্রাণ।
বিশেষ করে দ্বিতীয় চিঠির ভাষায় অহমিয়ার বৈশিষ্ট্য প্রকট, অহোমরাজের লেখায় যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোচবিহারের রাজার চিঠির ভাষারীতিতে পুরোপুরি অহমিয়ার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেনি।
বিবেচ্য হচ্ছে, কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের জেলা, আর অহমিয়া অহোমরাজ্যের ভাষা। আজকের পঞ্চগড়সহ সমগ্র প্রান্ত-উত্তরবঙ্গ, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি- এসব অহোমরাজ্যের সাথে লাগোয়া ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবেশ, শব্দ, বাক্য, এমনকি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ভাষারীতি আত্মীকরণ পাশাপশি অবস্থিত দুটো ভিন্ন এলাকার মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। সে কারণেই বোধকরি পঞ্চগড়সহ প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের (নির্দিষ্টভাবে রংপুর, গাইবান্ধার) লোকভাষায় হিন্দির প্রভাব আছে, প্রভাব আছে অহমিয়া ধ্বনিতত্ত্বের- কীভাবে সে কথায় পরে আসা যাবে।
অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে চিঠি দুটো পড়লে প্রথমটিতে সংস্কৃত (কৃষ্ণ, শুক্ল, বর্দ্ধিতাক, কর্ম্মী প্রভৃতি) প্রভাবের অস্তিত্ব মেলে। অহমিয়ার চেয়ে বাংলা অধিক পরিমাণে সংস্কৃতঘেঁষা। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিতে সংস্কৃতের প্রভাব নেই, বরং হিন্দির সামান্য প্রভাব দেখা যায়। আর শেষ বাক্যটিতে রাজনৈতিক শাসানির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দূরতম ভাবনার বিষয় হচ্ছে- যে যুগে গদ্যের প্রচলনই ছিল না, সে যুগের একটা পাল্টা চিঠির ভাষায় এমন একটা বিশিষ্টার্থক বাক্য থাকাটা। বাঙলা কাব্যের অলঙ্কারতত্ত্বের বিকাশও ঐ সময়ে হয়নি ঠিকমতো, অথচ একটা চিঠিতে গদ্যের শক্তি কতটা ভাবা যায়!
প্রথম চিঠির তারিখ নির্দেশে ব্যবহৃত ‘শঁক’ এবং দ্বিতীয় চিঠির ‘শুনিছিলোঁ’, ‘খারচাইহঁ’, ‘ঠাই’ শব্দগুলোতে চন্দ্রবিন্দুর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের বাঙলায় এমন প্রবণতা স্বাভাবিক। যেমন- তাঁহ, কুঁকিলা, বাঁশ, খোঁজ প্রভৃতি।
আবার দ্বিতীয় চিঠিতে ‘দেশলৈকো’, ‘বারলৈ’ শব্দ দুটোর ‘ঐ’ ধ্বনি অহমিয়া প্রভাবিত। এতদাঞ্চলের বাঙলা এ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। যেমন- কথা হৈছে মোর কথা তো মুই বাদু দিছু।
পঞ্চগড় একসময় কামরূপ এবং কামতা রাজ্যভুক্ত ছিল। কামতাপুরী, কামরূপী প্রভৃতি নামে এতদাঞ্চলের বাঙলার উপভাষা পরিচিত ছিল সে সূত্রেই। কামতা নামটি বহু আগেই বিলুপ্ত হয়। আর কামরূপ বর্তমান আসাম রাজ্যের একটি জেলা। আবার রাজবংশী ভাষাও বলা যাচ্ছে না, কারণ একই নামে একটি সম্প্রদায় রয়েছে। যদিও রাজবংশীদের নিজস্ব ভাষাশৈলীর অনুসৃতিও পঞ্চগড়ের ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। নামকরণের বেলায় দেখা যায় বুধবারে যার জন্ম, লোকায়তভাবে তাকে বুধাই ডাকা হয়। তা সত্ত্বেও সার্বিক বিবেচনায় প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের ভাষা নামটিই যুক্তিযুক্ত।
বাঙলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগে (প্রাচীন ও মধ্যযুগের সন্ধিক্ষণের দেড়-দুশো বছর) যদিও কোনো লিখিত উপাদান পাওয়া যায়নি, এই সময়ে ভাষা থেমে ছিল- এমন বলারও উপায় নেই। বর্তমান বাঙলায় অপ্রচলিত কিছু ভাষাগত বিশেষত্ব এখনও প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের ভাষায় বিদ্যমান রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। পঞ্চগড়ের ভাষাও যে এসব বিশেষত্ব ধারণ করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাচীন বাঙলা ভাষার নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কার যে হিমালয়ে হয়, সে হিমালয়ের পাদদেশে উত্তরবঙ্গ নিকটবর্তী বাংলাদেশ ভূখণ্ড। সেই বিচারে এ এলাকায় চর্যাপদের ভাষার চর্চা থাকাটা স্বাভাবিক।
ড. সুকুমার সেন বলেন, বাংলা ভাষার অসহায় শৈশবকালেই কোচবিহার, আসাম, কাছাড় ও ভুটানে এ ভাষা স্বমহিমায় পরিচালিত হতো। ভুটানের দেবরাজা বাঙলা ভাষায় অভিজ্ঞ মুন্সি রাখতেন।
এশিয়ান হাইওয়ের মতো প্রাচীন বাঙলা ভাষা পঞ্চগড়ের হাত ধরেই এই ব-দ্বীপে প্রবেশ করেছে- এটা কোনো অত্যুক্তি নয়। বাঙলার প্রাণভোমরা বাঙলা ভাষা। শুরুর দিকে বলা হয়েছে, এত কিছুর পরও পঞ্চগড় কী কারণে যেন আন্ডাররেটেড রয়ে গেছে। চর্যাপদের সান্ধ্যভাষাকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে নিজ দায়িত্বে রাস্তা দেখিয়ে আমার মায়ের ভাষা বানানোর কৃতজ্ঞতায় পঞ্চগড়কে আর যা-ই হোক আন্ডাররেটেড ভাবতে ইচ্ছে করে না।