বাংলাদেশি নির্মাতাদের মধ্যে যারা নিজেদের নির্মাণের একটা নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য নিঃসন্দেহে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। আপনি ফারুকীর সিনেমা দেখুন, নাটক দেখুন, নির্মাতার নাম দেখার আগেই আপনি বুঝে যাবেন, এই কন্টেন্টের নির্মাতার আর কেউ নন, ফারুকী। এমনকি সামান্য দৈর্ঘ্যের বিজ্ঞাপনেও তিনি নিজের সিগনেচার স্টাইলটা তৈরি করে ফেলেছেন। আপনি যদি মনযোগী দর্শক হয়ে থাকেন, তাহলে পরিচালকের নাম চোখে না পড়লেও আপনার মনে হবে- ‘এই জিনিস বোধহয় ফারুকীই বানাইছে!’ যেকোনো দৈর্ঘ্যের কন্টেন্ট নির্মাণে নিজস্ব ছাপ তৈরি করে ফেলাটা নিশ্চয়ই দারুণ এক গুণ, আর সেটা ফারুকী বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছেন।
সবশেষ সেই ধাঁচটা দেখা গেল স্কয়ার গ্রুপের জন্য মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বানানো বিউটি অ্যান্ড টেস্ট অফ বাংলাদেশ নামের দুটো প্রমোশনাল ভিডিওতে। ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন না বলে এটাকে বরং বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বলাই ভালো। প্রথম ভিডিওটির বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের সৌন্দর্য, যেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিউটি অফ বাংলাদেশ’। ভিনদেশী এক তরুণীর চোখে তুলে আনা হয়েছে অপরূপ এক বাংলাদেশকে, যে বাংলাদেশ ছবির মতো সুন্দর, নৈসর্গিক।
বাংলাদেশী তরুণী জুঁই পড়ালেখার সূত্রে দেশের বাইরে থাকে। তার রুমমেট লরা ভিনদেশী এক তরুণী। বড়দিন এবং নতুন বছরের ছুটিতে সবাই যখন যার যার ঘরের পানে ছুটছে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে ব্যাকুল হয়ে আছে; লরা তখন স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যস্ত। তার জীবনেও বড়দিন আছে, আছে নতুন বছরের উন্মাদনা। কিন্তু এই উৎসবগুলো উদযাপন করার জন্য ফেরার মতো কোনো ঘর নেই তার। লরার পেছনের গল্পটা এই স্বল্প সময়ে জানা হয় না আমাদের, সেটা সম্ভবও নয়। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে লরার মতো এমন পরিবারবিহীন মানুষ অজস্র পাওয়া যাবে। উৎসবে পার্বনে যারা প্রিয়জনের সান্নিধ্য পায় না, যাদের অপেক্ষায় কেউ থাকে না।
লরার গল্প শুনে জুঁইয়ের মন খারাপ হয়। জুঁই এমন একটা দেশ থেকে এসেছে, যেখানে প্রায়োরিটি লিস্টে ‘ফ্যামিলি কামস ফার্স্ট’ নিয়মটা অলিখিতভাবে প্রচলিত। ঈদ হোক, পূজা হোক, নববর্ষ হোক কিংবা হোক শীতের ছুটি- যেকোনো আনন্দের মুহূর্ত পরিবারের সাথে কাটানোটা আমাদের সবচেয়ে বড় চাহিদা। একারণেই ঈদের সময় লঞ্চে গাদাগাদি করেও মানুষ নাড়ির টানে বাড়ির পথে ছোটে, বাসে-ট্রেনের ভিড় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আপনজন আমাদের কাছে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আত্মীয়-বান্ধব ছাড়া নিজেদের অস্তিত্ব কল্পনা করতে না পারা আমাদের তো লরার গল্প শুনে মন খারাপ হবেই। জুঁই তাই লরাকে বাংলাদেশের নববর্ষ উৎসবের গল্প শোনায়। আইপ্যাডের স্ক্রিনে লরা দেখে রঙে রঙে রাঙানো মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি। জুঁইয়ের আমন্ত্রণে লরা পা রাখে বাংলাদেশের মাটিতে। ভিনদেশী এই তরুণীর অবশ্য তখন ধারণাও ছিল না, স্মৃতি আর মায়ার অবিচ্ছেদ্য এক বাঁধনে সে বাঁধা পড়বে এই দেশ আর এদেশের মানুষের সাথে, এখানকার রসনাবিলাস আর প্রকৃতির সাথেও।
বিউটি অফ বাংলাদেশ ভিডিওটির মূল প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের সৌন্দর্যে অবগাহন। সেই সৌন্দর্য শুধু প্রাকৃতিক নয়, নির্মাতা এবং পুরো টিম সৌন্দর্যের খোঁজে ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। প্রকৃতির পাশাপাশি ভিডিওচিত্রে তুলে আনা হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, উৎসব, পার্বণ, আতিথেয়তা, লোকসঙ্গীত থেকে শুরু করে বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা পর্যন্ত- সবকিছু ঠাঁই পেয়েছে সেই সৌন্দর্যের কাতারে। অচেনা এক দেশে ভিনদেশী এক তরুণীর জার্নিতে আমরাও যেন অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করি বাংলাদেশকে।
ঢাকা থেকে সুন্দরবন, কক্সবাজার, গ্রামের মেঠোপথ কিংবা মেঘে ঢাকা পাহাড়ের কোল- ক্যামেরা হাতে শেখ রাজিবুল ইসলাম অসাধারণ পারদর্শিতায় তুলে এনেছেন বাংলাদেশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে। বাংলাদেশে লরার যাত্রা চলতে থাকে, আর সেই যাত্রায় শামিল হয়ে দর্শকও আবিষ্কার করে অদেখা এক বাংলাদেশের অস্তিত্ব। মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার যে দেশে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তাটাই দিনশেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে ভালোবাসা আর সম্প্রীতির কাছে হেরে যায় ঘৃণা।
দুটো গানের অংশবিশেষ ব্যবহৃত হয়েছে বিউটি অফ বাংলাদেশের এই ভিডিওতে। ‘যতনে রাখিব, মায়ায় বাঁধিব, রাখিব নয়নে নয়ন’ শিরোনামের গানটি হৃদয়ের কোথাও গিয়ে আলতো করে টোকা দেয়, তাতে মন আর্দ্র হয়। লঞ্চের ডেকে বৈঠকী আয়োজনে ‘সহজ মানুষ’ গানটিও মন কেড়ে নেয় কয়েক সেকেন্ডেই। পরিচ্ছন্ন উপস্থাপনে খুব সামান্য সময়েও যে সঙ্গীত মনে জায়গা করে নিতে পারে, তারই যেন উদাহরণ হয়ে রইলো এই দুটো গান। বিদেশী তরুণীকে শাড়ি পরানোর চিরায়ত ফর্মূলায় ফারুকী হেঁটেছেন ঠিকই, তবে নজরকাড়া উপস্থাপনের কারণে তাতে খুঁত হবার উপায় নেই।
বিউটি অফ বাংলাদেশ ভিডিওর শেষটা হয়েছে কক্সবাজারে। বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে থাকা লরার হাতে একটি বড়সড় ঝিনুক তুলে দিয়েছে স্থানীয় এক শিশু। সেই ঝিনুকের বিনিময় মূল্য সে নেবে না, অচেনা এক বিদেশী তরুণীর জন্য এটি তার উপহার। সেই উপহার লরার চোখে জল আনে, নিজের জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশটাকে তার ঘর বলে মনে হয়। কাউকে নিজের ঘরের অনুভূতি উপহার দিতে পারাটা বড্ড ‘স্পেশাল’। বাংলাদেশ আর এদেশের মানুষ লরাকে সেই অনুভূতি উপহার দিতে পেরেছে।
বাংলাদেশী তরুণী জুঁইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিদ্রা দে নেহা, অন্যদিকে বৃটিশ তরুণী অ্যালেক্স ডবসনকে দেখা গেছে লরার চরিত্রে। প্রোজেক্টের কো-ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন গোলাম কিবরিয়া ফারুকী, আর ক্যামেরার পেছনে ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফিতে ফারুকীর বিশ্বস্ত সহচর শেখ রাজিবুল ইসলাম। ছবিয়াল টিমের পাশাপাশি এই দুটো ভিডিও নির্মাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আরও কিছু মানুষ, যাদের গল্পটা হয়তো অজানা রয়ে যাবে। স্থানীয় জনসাধারণ, প্রশাসন, পুলিশ, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা, মন্ত্রী থেকে শুরু করে শুটিং স্পটগুলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান- সবার সহায়তাই পেয়েছে ছবিয়াল টিম। নইলে এই ক্যাম্পেইন নামানোটা অসম্ভব হতো, সেটা ভিডিওর আয়োজনের বিশালত্ব দেখলেই অনুমান করা সম্ভব। পুরো টিমেরও দম বেরিয়ে গেছে দুটো ভিডিও বানানোর জন্য গোটা বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে গিয়ে। সেই পরিশ্রমের ফলটা যে যথেষ্ট মিষ্টি হয়েছে, তা তো বলে না দিলেও চলছে।
বিউটি অফ বাংলাদেশের পরবর্তী অংশটির নাম টেস্ট অফ বাংলাদেশ। এই দুটো ভিডিও বানানো হয়েছে বিউটি অ্যান্ড টেস্ট সেলেব্রেশনের এই ক্যাম্পেইনে। দ্বিতীয় ভিডিওর গল্প নাহয় অন্য কোনোদিন হবে। প্রথমটার রেশ কাটতেই তো সময় লাগবে খানিকটা। গোটা বাংলাদেশকে উপস্থাপন করার মতো এমন বড়সড় আয়োজন তো রোজ রোজ হয় না!