“চন্দনেরি গন্ধভরা,
শীতল করা, ক্লান্তি-হরা
যেখানে তার অঙ্গ রাখি
সেখানটিতেই শীতল পাটি।”
‘খাঁটি সোনা’ কবিতায় বাংলার মাটিকে অনেকটা এভাবেই শীতল পাটির সাথেই তুলনা দিয়েছিলেন ‘ছন্দের জাদুকর’ খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই আদিকাল থেকেই শীতল পাটির কদর সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিলো। অনেকটা ঢাকাই মসলিনের মতো সিলেটের শীতলপাটির কারুকার্যেও মুগ্ধ ছিলো সারা বিশ্ব। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের শীতলপাটি জায়গা করে নিয়েছিলো মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজসভায়। মুঘল রাজদরবারেও বেশ কদর ছিলো শীতল পাটির। মৌলভীবাজার জেলার দাসের বাজারের রূপালি বেতের বাহারী কারুকাজ করা শীতল পাটি মুর্শিদ কুলি খাঁ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে আমন্ত্রিত হয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন বেতের উপর কারুকার্যশোভিত এই শীতল পাটি দেখে। শান্তিনিকেতনে ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি কলকাতায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই শিল্পের বাতি নিভু নিভু করে জ্বলছে। সুলভ মূল্যের প্লাস্টিকের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্লান্ত শীতপাটির ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে আরেকটি অনন্য সম্মাননা। ৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ‘ইউনেস্কো’ শীতলপাটির বুনন শিল্পকে ‘Intangible Cultural Heritage’ এর তালিকায় স্থান পেয়েছে সিলেটের শীতল পাটি। এই সম্মাননা পাওয়ায় বাউল সংগীত, জামদানী আর মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে একই তালিকায় স্থান করে নিলো সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি।
শীতল পাটি কী?
মাটির ঘরে কিংবা মেঝেতে আসন পেতে বসতে পাটির ব্যবহার করেননি এমন মানুষ হয়তো বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। গ্রাম অঞ্চল তো বটেই, শহরেও পাটির কদর লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সাধারণ বেত নির্মিত পাটির চেয়ে শীতল পাটি একটু আলাদা। সাধারণ বেত নির্মিত পাটিতে কোনো নকশা থাকে না। বেতের বুননে নির্মিত এই সাধারণ পাটির স্থায়িত্বও বেশ কম। কিন্তু শীতল পাটিতে বেশ মনোহর কারুকাজ থাকে। পাশাপাশি এই পাটিতে গরমের দিন পাওয়া যায় ‘শীতল’ অনুভুতি। আর এভাবেই নকশা করা এই পাটির নাম দাঁড়িয়েছে ‘শীতল পাটি’।
কীভাবে নির্মিত হয় এই শীতল পাটি?
শীতল পাটি তৈরী হয় মুর্তা বা পাটিবেত থেকে। এই পাটিবেত সাধারণভাবে মোস্তাক নামেও পরিচিত। অনেকটা সরু বাঁশের মতোই দেখতে এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Schumannianthus dichotomus।
জলাবদ্ধ বনগুলোতে এই মুর্তাসহ বেশ কয়েক ধরনের বেত এবং নলখাগড়ার আধিক্য দেখা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ করা হলেও সিলেটের বনাঞ্চলগুলোতে এই উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবেই পাওয়া যায়। তাই সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মুর্তা বন থেকে সংগ্রহ করার মাধ্যমেই পাটি তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়।
তবে মুর্তা গাছ সিলেট ছাড়া বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা আর চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল আর বনগুলোতে দেখা যায়। তবে সে অঞ্চলগুলোতে তেমন পাটিয়াল না থাকায় এই শিল্পটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সিলেটের কিছু পরিবারেই সীমাবদ্ধ। জাতীয় জাদুঘরের হিসেবানুযায়ী সিলেট বিভাগের একশত গ্রামের প্রায় চার হাজার পরিবার এই শিল্পের হাল ধরে আছেন। বংশ পরম্পরায় এই কারুশিল্পকে তারা একশত বছরের বেশি সময় ধরে লালন করে আসছেন।
মুর্তা সংগ্রহের পর তা থেকে পাটি তৈরি করার জন্য প্রথমে এর ডালপালা ছেঁটে ফেলে কান্ডটিকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পাটি বুননের কাজে যারা জড়িত থাকেন তাদের মূলত ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মূলত ভেজা কান্ড থেকেই পাটিয়ালদের পাটি তৈরির কাজের প্রথম ধাপ শুরু হয়। শীতল পাটির ধরন অনুযায়ী পাটিকর মুর্তার ছাল থেকে ‘বেতি’ তৈরি করেন। ‘বেতি’ যত সূক্ষ্ম আর পাতলা হবে, শীতল পাটি ততই মসৃণ আর আকর্ষণীয় হবে।
বেতি তৈরির পরের কাজ এদেরকে আঁটি বেঁধে নেওয়া হয়। সেই আঁটিকে পানিতে ভাতের মাড়ের সাথে আমড়া, জারুল, তেতুল আর কাউপাতা সহ বেশ কয়েক ধরনের গাছের পাতা দিয়ে সিদ্ধ করে নেওয়া হয়। এতে একদিকে যেমন পাটির সহনক্ষমতা বাড়ে, পাশাপাশি এটি বেশ চকচকে হয়ে উঠে। ফলে অন্য যেকোনো পাটির চেয়ে এই পাটি একদিকে যেমন দীর্ঘস্থায়ী, ঠিক তেমনি শীতল পাটিতে করা কারুকাজ বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। নানান রঙের নকশা ফুটিয়ে তোলার জন্য রঙ মেশানো পানিতেও সিদ্ধ করে নেওয়া হয়ে থাকে আঁটিগুলোকে।
এরপর দক্ষ হাতের ছোঁয়া পেয়ে বেতির পর বেতি সাজিয়ে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা শীতল পাটিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শীতল পাটির নকশায় গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্য দেখা যায়। সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, পালা-পার্বনের ছবিগুলো দক্ষ হাতের বুননে জীবন্ত হয়ে ওঠে পাটির গায়ে। নকশা, বুনন, বেতির মসৃণতার ভিত্তিতে শীতল পাটিকে ভাগ করা হয় বেশ কয়েকটি ভাগে। আর শীতল পাটির নামগুলোও বেশ অদ্ভুত। ‘সিকি’, ‘আধুলি’, ‘টাকা’, ‘নয়নতারা’, ‘আসমানতারা’- এই নামগুলো শীতল পাটির একেকটি ধরন। পাটিগুলো সাধারণত দৈর্ঘ্যে সাত ফুট আর প্রস্থে পাঁচ ফুটের মতো হয়ে থাকে।
সিকি
শীতল পাটির মধ্যে সবচেয়ে মসৃণভাবে তৈরি পাটিগুলোকে সিকি হিসেবে নামকরণ করা হয়। লোকমুখে প্রচলিত আছে, সিকি এতই মসৃণ যে এর উপর দিয়ে সাপ পর্যন্ত চলাচল করতে পারে না। প্রতিটি সিকি বুনতে পাটিয়ালদের সময় লাগে প্রায় চার থেকে ছয় মাস।
আধুলি
আধুলির মসৃণতা বেশ কম, তবে কারুকাজে সিকি থেকে কম যায় না এই পাটির পাটিয়ালেরা। সাধারণ ব্যবহারের জন্য এই পাটির বিপুল চাহিদা থাকায় এই পাটির উৎপাদনও বেশি। সিকি তৈরির চেয়ে আধুলি তৈরিতে সময়ও কম লাগে। তিন থেকে চার মাসে একেকটি আধুলির কাজ শেষ করে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়।
টাকা
টাকা আকারে বেশ বড়সড় আর নকশাদার হয়ে থাকে। একেকটি টাকা তৈরিতে ছয় মাসের অধিক সময়ও লাগে। আর এই টাকা এতই মজবুত হয় যে বিশ থেকে পঁচিশ বছর অনায়াসে ব্যবহার করা যায় একেকটি টাকা। সাধারণত ফরমায়েশের ভিত্তিতে পাটিয়ালরা টাকা বুনে থাকেন।
সাধারণ নকশি পাটি
সাধারণ কিছু পাটি আছে যা নিত্যদিনের ব্যবহারে জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। এগুলো তৈরি করতে দক্ষ পাটিয়ালদের সময় লাগে এক থেকে দুই দিন। তবে নকশা কিংবা সাধারণ পাটি যা-ই হোক না কেন, তার দাম নির্ভর করা বুনন, রঙ, বেতির মসৃণতা আর কারুকার্যের নকশার উপর। দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে একেকটি শীতল পাটির দাম ঠেকতে পারে পঞ্চাশ হাজারে।
এই শিল্পের সমস্যা আর চ্যালেঞ্জ
শিল্পায়নের সাথে সাথে শীতল পাটির বাজার দখল করে নিচ্ছে সুলভ প্লাস্টিক নির্মিত পাটি। হাতে বোনা পাটির চেয়ে অনেক কম দামে তৈরি এই পাটির সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত এই পাটির কারিগরেরা হারিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পাটি তৈরির এই শিল্প বৃহত্তর সিলেট এলাকার হাজারখানেক পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে পাটির বাজার হারিয়ে যাওয়ার কারণে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। ফলে দক্ষ পাটিয়াল আর তৈরি হয়ে উঠছে না। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও আগে বিপুল পরিমাণ পাটির চাহিদা ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের জীবনধারাও অনেকাংশে পরিবর্তনের কারণে সেই বাজারটিও ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে।
মুর্তা চাষ
শীতল পাটির কাঁচামাল হিসেবে মুর্তার ভূমিকার কথা বলাই বাহুল্য। দীর্ঘদিন যাবৎ পাটিয়ালরা মুর্তার জন্য প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঝোপঝাড় দখল করে ঘরবাড়ি তৈরির ফলে হারিয়ে যাচ্ছে মুর্তা গাছ। তাই মুর্তা চাষ করে একে টিকিয়ে রাখতে না পারলে শীতল পাটি হয়তো চিরদিনের মতো জাদুঘরে স্থান করে নিবে।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ও হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার লড়াই
দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ইউনেস্কোর সম্মেলনে সিলেটের শীতল পাটিকে ঘোষণা দেওয়া হয় বিশ্বের ‘নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ বা ‘Intangible Cultural Heritage’ হিসেবে। ইউনেস্কোর দ্বাদশ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শীতল পাটিকে সবার সামনে তুলে ধরেন সিলেটের দুই বিখ্যাত পাটিয়াল গীতেশ চন্দ্র দাশ ও হরেন্দ্র কুমার দাশ।
তাই শত বছর ধরে চলে আসা এই শিল্পের ঝুলিতে সম্মান আর পুরষ্কারের অভাব নেই। কলকাতার কারুশিল্প প্রদর্শনীতেও বালাগঞ্জের শিবরাম দাসের হাতে উঠেছে স্বর্ণপদক। ১৯৯১ সালে ইতালির রোমও জয় করে এসেছেন শীতল পাটির কারিগরেরা। বালাগঞ্জের মনিদ্র নাথের শীতল পাটি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেছে পুরো বিশ্ব। পৃথিবীজুড়ে বাংলাদেশের শীতল পাটির বেশ ভালো সুনাম থাকায় এই খাত থেকে আসছে বৈদেশিক মুদ্রাও। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই যুগে প্লাস্টিকের মাদুরের ভালো বিকল্প হতে পারে এই শীতল পাটি। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব উপায়ে তৈরি এই শীতল পাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই দরকার বাংলাদেশের মানুষের একটু সচেতনতা আর এর মাধ্যমেই হয়তো সারা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হবে।
ফিচার ইমেজঃ fms.portal.gov.bd