মূল স্থাপত্যের পুরোটাই লাল ইট দিয়ে তৈরি। তাই স্থানীয় মানুষেরা আদর করে একে ডাকে ‘লাল গির্জা’ নামে। তবে এর আঙিনার পরতে পরতে আবার সবুজের সমারোহ। কম্পাউন্ডের ভিতরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩টি পুকুর। দক্ষিণ দিকে শানবাঁধানো একটি বড় পুকুর। সেই পুকুরের স্বচ্ছ-স্নিগ্ধ জলে প্রতিফলিত হয় গির্জার প্রতিবিম্ব। সে বড় মনোরম এক দৃশ্য।
এই গির্জার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির নাম। বলছি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। লোকমুখে শোনা যায়, কবির সাথে তাঁর প্রথম প্রেমিকা মনিয়ার দেখা হয়েছিল এই গির্জাতেই। কেননা এখানেই সেবিকা হিসেবে কাজ করতেন মনিয়ার মা। তাছাড়া এই গির্জা থেকে কবির নিজ বসতবাড়ির দূরত্বও খুব কম, মাত্র কয়েক কদমের।
এত কথা যে গির্জা নিয়ে, সেটি প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভাগীয় শহর বরিশালের বগুড়া রোডে (জীবনানন্দ সড়ক) অবস্থিত অক্সফোর্ড মিশন গির্জা। সুরম্য প্রাচীন এই স্থাপনার আরেকটি কেতাবি নামও আছে, যা মূল ফটকের উপরই বড় করে লেখা: এপিফানি গির্জা, বাংলাদেশ। তবে ওই যে শুরুতেই বলেছি, অন্য সব নামকে ছাপিয়ে ‘লাল গির্জা’ নামটিই পেয়েছে বেশি পরিচিতি।
নানা বৈচিত্র্য ও শিল্পসৌকর্যে নির্মিত এই গির্জাটি উচ্চতার বিচারে এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গির্জা। শুধু কি তা-ই? এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঘণ্টাটিও রয়েছে এখানেই, যা প্রতিদিন সাত বার প্রার্থনার পূর্বে বেজে ওঠে।
৪০টি খিলানের উপর দাঁড়িয়ে আছে গির্জাটি। ৩৫ একর জমির উপর উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ডের ভিতর পুকুরগুলো ছাড়াও আরো রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হোস্টেল, ফাদার ও সিস্টারদের আবাসন, লাইব্রেরি ও হাসপাতাল। চারদিকের সীমানাকে ঘিরে রয়েছে সুদৃশ্য পামগাছের সারি। ভেতরে আরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গাঢ় সবুজ আঙিনা, বৃক্ষশোভিত উদ্যান, মাঠ, ফুল ও ঔষধি বাগান।
কবি জীবনানন্দ দাশ এই অক্সফোর্ড মিশনের হোস্টেলেই থাকতেন ছাত্রাবস্থায়। সে সুবাদে এখানকার ফাদার ও মাদারদের সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছিল দারুণ ঘনিষ্ঠতা। গির্জা প্রাঙ্গনের পামগাছের ফাঁক গলে আসা রোদ্দুর আর বাতাসে পাতার দোল খাওয়ার দৃশ্য দেখে আলোড়িত হতেন কবি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কবির স্মৃতিকে অনুভবের উদ্দেশে যারা ছুটে যায় বরিশালে, তাদের কাছে ঠিক কতটা তাৎপর্যপূর্ণ এই গির্জা!
নিশ্চয়ই জানতে মন চাইছে, কীভাবে গড়ে উঠল এই গির্জা। সেজন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে উনবিংশ শতকের শেষ দিকে। প্রাচীন নদী-বন্দর শহরটির আকর্ষণে তখন এখানে এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে ইউরোপীয় বহু খ্রিস্টান মিশনারি। তেমনই একটি মিশনারি হলো অক্সফোর্ড মিশন। তাঁদের উদ্যোগেই নির্মিত হয় গির্জাটি।
গির্জাটির নকশা ঠিক কেমন হবে, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই ভাবনাচিন্তা করছিলেন ফাদার স্ট্রং এবং সিস্টার এডিথ। এক পর্যায়ে মূল নকশাটি করেন ফাদার স্ট্রং, এবং সেটিকে স্কেচের মাধ্যমে কাগজের উপর ফুটিয়ে তোলেন সিস্টার এডিথ। সেই স্কেচ অনুসরণ করেই বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্রে গির্জাটি গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন ইংল্যান্ডের স্থপতি ফিলিপ থিকনেস ও প্রকৌশলী ফ্রেডরিক ডগলাস।
প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয় ১৯০৩ সালে। ১৯০৩ সালের ২৬ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয় গির্জাটি। ওই দিনই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এপিফানি গির্জা ভগ্নী সমাজ’-ও। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। ফাদার স্ট্রংয়ের তদারকিতে গির্জার দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলতে থাকে, এবং তা পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয় ১৯০৭ সালের দিকে।
গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর আদলে নকশা করা মূল গির্জা ভবনটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় বুঝি এটি চার বা পাঁচ তলা ভবনের সমান (প্রায় ৫০ ফুট)। কিন্তু বাস্তবিক এটি মাত্র এক তলা। এর প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল ও নান্দনিক প্রার্থনা কক্ষটি। প্রার্থনা কক্ষটির ভেতরের ছাদ কাঠ দিয়ে আচ্ছাদিত, আর তার মেঝেতে সুদৃশ্য মার্বেলের টালি। মূল বেদির উপর রয়েছে একটি বড় ক্রুশ।
গির্জার ভেতরে আরো আছে পাথরের তৈরি চৌবাচ্চা, ব্যাপ্টিজম বাথ বেসিন। মূল দরজাটি দক্ষিণমুখী হলেও তিন দিকে আরো অনেক গুলো দরজা রয়েছে। ভবনের উপরে পূর্ব দিকে আছে কালো গম্বুজ। ভবনের কাঠামোকে মজবুত করার লক্ষ্যে রয়েছে ৪০টি খিলান, এবং সেই সুবাদে অনেকগুলো করিডোরও।
গর্বের বিষয় হলো, এই গির্জার নির্মাণকাজে ব্যবহৃত প্রায় সকল উপাদানই বাংলাদেশের নিজস্ব। দেশীয় মাটি দিয়ে তৈরি আস্তনে পোড়া লাল শক্ত ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল ভবনটি। সেই সঙ্গে রড, বালু, সিমেন্ট ও কাঠের মালিকানা যেমন ছিল বাংলাদেশের, তেমনই নির্মাণ শ্রমিকরাও সকলে ছিলেন এই দেশেরই। শুধু ভিতরের চারটি বেদির মার্বেল পাথর আর বড় ক্রুশটি আনা হয়েছিল বাইরে থেকে। মার্বেল পাথরগুলো আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে, আর ক্রুশটির প্রাপ্তিস্থান বেথেলহাম।
১১৬ বছর বয়সী গির্জাটি এখনো দারুণ ঝকঝকে তকতকে। দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন, হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে এটির সংস্কার করা হয়েছে, করা হয়েছে নতুন করে রঙ। কিন্তু আসলে তা না। যা দেখবেন, তার পুরোটাই গির্জার আদি ও অকৃত্রিম রূপ। কেননা এটি নির্মাণ করাই হয়েছিল এমনভাবে যেন কোনো প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এর স্থাপত্যশৈলীর তিলমাত্র ক্ষতি না হয়। তাই তো ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল অঞ্চলের ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও, ঠিকই অক্ষত অবস্থায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল গির্জাটি।
মূল গির্জার পাশে ঠিক এর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি টাওয়ার, যার নাম বেল টাওয়ার। সেখানে গির্জার অফিস কক্ষ ছাড়াও রয়েছে সেই সুদৃশ্য ঘণ্টাটি, যা দিনে সাতবার বেজে ওঠে। এবং এই ঘণ্টাধ্বনি শুনেই ভক্তরা এসে সমবেত হন প্রার্থনার জন্য। কথিত আছে, ঘণ্টাটি স্থাপনের যাবতীয় খরচ একাই বহন করেছিলেন ফাদার স্ট্রং। তিনি ছিলেন সেকালের একজন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ। বিভিন্ন খেলায় সম্মানী হিসেবে যেসব পুরস্কার পেতেন, সেগুলোর অর্থ দিয়েই তিনি স্থাপন করেছিলেন ঘণ্টাটি।
একজন বিশেষ মানুষের নাম না বললেই বরিশালের লাল গির্জার বৃত্তান্ত পূর্ণতা পাবে না। তিনি লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। ৮৮ বছর বয়সী এই মানবদরদী ব্রিটিশ নাগরিকের জন্ম যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে, ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৩০ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ড মিশন গির্জায় যোগ দেন, এবং তারপর থেকে প্রায় ছয় দশক বাংলাদেশেই বাস করছেন তিনি।
১৯৬০ সালে মিশনের কাজে বাংলাদেশে আসার পর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। কথা ছিল দুই বছর বাদেই নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য ও এখানকার মানুষকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেন যে, তাদের ছেড়ে দেশে আর ফেরা হয় না তাঁর। বিগত ৫৯ বছর ধরে তিনি ঘুরে ঘুরে কাজ করেছেন যশোর, খুলনা, নওগাঁ, ঢাকা ও গোপালগঞ্জে। তবে জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন অক্সফোর্ড মিশন গির্জাতেই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী সিস্টার হল্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গির্জা বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখান থেকে লোকজনকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু সিস্টার হল্ট চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ মানুষদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন। এ কাজের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে অবস্থান করেন।
২০০৪ সালে অবসর গ্রহণ করা সিস্টার হল্টের ইচ্ছা, বরিশালের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন তিনি। ২০১৮ সাল পর্যন্তও মনে হচ্ছিল তাঁর এই শেষ ইচ্ছা বুঝি পূরণ হবার নয়। কেননা বাংলাদেশে অবস্থানের জন্য প্রতি বছর ভিসার মেয়াদ বাড়াতে ৩৮ হাজার টাকা ব্যয় করতে হতো তাঁকে। প্রতি মাসে অবসর ভাতা হিসেবে যে ৭৫ পাউন্ড (সাড়ে সাত হাজার টাকা) পেতেন, তা থেকে একটু একটু করে জমিয়ে ভিসা নবায়নের অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খেতেন তিনি। তাই সরকারের কাছে বারবার তিনি অনুরোধ জানাতেন তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের। অবশেষে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের নাগরিত্ব লাভ করেন তিনি।
বরিশালের লাল গির্জা শুধু যে একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, তা কিন্তু নয়। এটি ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্তও বটে। এখানকার দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৫০। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে আরো ৩০০ জন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পড়াশোনার সুযোগ পায় এখানে। এছাড়া এখানকার ছাত্রীনিবাসে বাস করছে বিভিন্ন কলেজে পাঠরত ২৫ জন শিক্ষার্থী। মা ও শিশুরা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পেতে পারে মিশনের চিকিৎসাকেন্দ্রে।
পরিশেষে এ কথা বললে এতটুকুও অত্যুক্তি হবে না যে, বরিশালের এই লাল গির্জা স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে গোটা বাংলাদেশেরই সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তিগুলোর একটি। এদেশে আরো অনেক ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন রয়েছে যেগুলো প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তাদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও মর্যাদা হারাতে বসেছে। সেদিক থেকে বরিশালের লাল গির্জা এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গির্জা কর্তৃপক্ষ যেভাবে যথাযথ সংরক্ষণের মাধ্যমে আজো এর আদি-অকৃত্রিম রূপ অটুট রেখেছে, সেজন্য তাঁরা বড়সড় ধন্যবাদের দাবিদার।
বরিশাল সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল নির্যাতন ও গণহত্যা
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/