Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নদীর বুকে জীবন যেমন: মানতা সম্প্রদায়ের অজানা কথা

আধুনিক জীবনধারার এই যুগে আধুনিকতার লেশমাত্র স্পর্শ করেনি তাদের। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অনেকটা দূরে তাদের বসবাস। নদীর বুকে তাদের জন্ম, নদীতে বেড়ে ওঠা, নদীতেই মৃত্যু। আবার মৃত্যুর পর এতটুকু জমি তাদের নেই যে শায়িত হবে চিরনিদ্রায়, লাশগুলো তাই ভেসে যায় নদীর জলে। নয়তো নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে তাদের অবদান যৎসামান্য, তবু নদী কিংবা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার সব উপকরণ নিয়ে তারা ছুটে চলে জীবনের তাগিদে।

আমাদের দেশের প্রধানত উপকূলবর্তী জেলাগুলোর নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা। প্রতিটি নৌকাতে একটি করে পরিবার, সে পরিবারের সমস্ত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশে আছে ঐ ছোট্ট নৌকাটিতে। ধর্মে তারা মুসলমান, তবু জীবন যাত্রা বিচিত্র ঢঙে তারা মানতা সম্প্রদায় নামে পরিচিত। জীবিকার প্রধান উপায় মাছ ধরা। জাল, মাইজাল, বড়শি নিয়ে মাছ ধরে পুরুষেরা। নারীরাও এ কাজে কম পটু নন। একটু বয়স হলেই সন্তানেরাও মাছ ধরায় সাহায্য করে বাবা-মাকে। স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগেরই। পেট না চললে বিদ্যা খুবই অনর্থক মনে হয় ওদের কাছে।

ওরা ভেসে চলে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মূলাদী, হিজলা, বানারীপাড়া, মাদারীপুরের কালকিনি, পটুয়াখালীর পানপট্টি, চরমনতাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, পাটুয়া, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিনাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে। সারাদিন মাছ ধরে আর দিন শেষে ব্যাটারিচালিত টেপ রেকর্ডার নিয়ে বসে ওরা, পুরোনো দিনের সিনেমার গান শোনে তন্ময় হয়ে। কোনো কোনো নৌকায় সৌরবিদ্যুৎ দেখা যায়, দু্ই তিনটা কম পাওয়ারের লাইট জ্বলে তা দিয়ে।

দুই নৌকা, দুই সংসার; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

তাদের জীবন যেমন, বিবাহরীতিও তেমনি অভিনব। পছন্দের কোনো মেয়েকে তার পিতার নৌকা থেকে নিজের নৌকায় তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়! আবার বনিবনা না হলে স্বামী তার স্ত্রীকে পিতার নৌকায় ফের পাঠিয়ে দেন, পিতার নৌকায় আসলেই হয়ে যায় তালাক! বর্তমানকালে কিছু কিছু বিবাহ অবশ্য সরকারী খাতায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে। কিন্তু মানতা জনপদের কারো জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন হয় না। আবার তাদের বসবাস বাংলাদেশের অসংখ্য নদীতে ছড়ানো ছিটানো বলে তাদের মোট সংখ্যা হিসেব করাও সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার পায় মানতা সম্প্রদায়। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো কি ঠিকভাবে পাচ্ছে তারা?

মানতা সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ গোষ্ঠির ভাসমান জীবনের সূচনা দেড়শো থেকে দুশো বছর পূর্বে। কোনো কোনো গোষ্ঠি আরো প্রাচীন। এতগুলো বছর পরও তারা পায়নি কোনো স্থায়ী ঠিকানা, এক টুকরো স্থলভূমি। স্থায়ী বাসস্থান তাই ওদের কাছে আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।

কয়েকটি পরিবার হতে এখন দুই শতাধিক পরিবারের বাস মুন্সীগঞ্জের ইছামতি নদীতে, দিনকে দিন যেন আরো অগোছালো হয়ে যাচ্ছে ওদের জীবন; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত মানতা সম্প্রদায়। খুব বেশি হলে শতকরা চার কি পাঁচ ভাগ ছেলেমেয়ে পায় প্রাথমিক শিক্ষা। বেশির ভাগই তাই অশিক্ষিত থেকে যায় আজীবন, বয়স দশ কি বারো হলেই বাবা মায়ের পেশা মাছ ধরাকে নিজের পেট চালানোর অবলম্বন করে নেয়। নয়তো খাবার জোটে না প্রতিদিন। রাষ্ট্রে অসাধারন রেজাল্ট নিয়ে বেড়ে উঠছে এক প্রজন্ম, অথচ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক বিশাল জনগোষ্ঠি যে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।

মানতা সম্প্রদায়ের বড় একটি সমস্যা খাবার পানি। বিশুদ্ধ খাবার পানির ভীষণ সংকট ওদের মাঝে। কারণ নদীর পানিতেই চলে রান্নাবান্না, বাসন আর কাপড় পরিষ্কার। মলত্যাগও সেখানেই। তাই নিয়মিত পানিবাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় সরকারী হাসপাতালমুখী হন মানতারা। কিন্তু চিকিৎসা সেবা মেলে না। আর শহুরে বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে সে ক্ষমতা ওদের কোথায়? তাই বাধ্য হয়ে নিজস্ব চিকিৎসায় আশ্রয় গ্রহণ করে তারা, যার ফলাফল হয় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু।

এছাড়া মানবসৃষ্ট জঞ্জালেরও শেষ নেই। এ সমস্যাগুলোই মানতাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবার পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। আর সে সমস্যার মূলে আছে মহাজন আর জলদস্যূরা।

পুলিশের নানা হয়রানির হাত থেকে সারা বছর মানতাদের রক্ষা করেন মহাজনেরা। নদীতে যখন মাছ থাকে না, মহাজন তাদের কিনে দেন চাল, ডাল আর লবণ। মহাজন তাই হয়ে যান বিপদের বন্ধু। বিপদের সময় বন্ধু সেজে মহাজন সওদার নামে ওই জেলেদের দাদন দিয়ে থাকেন। আর ওই দাদনের বিনিময়ে নিজেকে জিম্মি করেন জেলেরা। কিংবা নৌকা বা জালের প্রয়োজনে মানতারা হাত পাতেন মহাজনের কাছে। আর তাতে আজীবনের জন্য বাঁধা পড়েন সুদের কঠিন শিকলে। দিনান্তে যেটুকু মাছ ধরতে পারেন তার সবটুকু মহাজনের আড়তে দিলেও সে দায় থেকে মুক্তি মেলে না। অন্যদিকে জলদস্যুর আক্রমনে প্রায়ই সর্বস্ব হারাতে হয় তাদের। জান-মালের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই ওদের।

অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে রুস্তম মিয়া আর হাজেরার নৌকায় একত্র বসবাসের, এ জীবন থেকে কবে মুক্তি মিলবে- জানেন না তারা; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

মানতা সম্প্রদায়ের মানুষদের আজন্ম প্রেম নদীর সাথে, বেঁচে থাকার লড়াইটাও সেই নদীর সাথেই। সামান্য ঝড়ো হাওয়া ওদের মুখ শুকিয়ে দেয়, আগত ঝড় ওদের সামনের দিনগুলোকে বিশাল এক প্রশ্নের মুখোমুখি করিয়ে দেয়। তবুও সেই নদীই তাদের অবলম্বন হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। এ জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে তারা। আর দশ জন স্বাভাবিক মানুষের মতো ডাঙায় বসবাস করতে চায় মানতা সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষ।

দিনের পর দিন এভাবেই ভেসে যায় ওদের জীবন; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

ইছামতি নদীর এক বাসিন্দা লতা বেগম। বয়স সত্তরোর্ধ্ব। ভাসমান পাড়াটির সবচে’ বয়স্ক তিনি। তার জন্মও নৌকাতে। তিনি ঠিক মনে করতে পারেন না, তার দাদা নাকি দাদার বাবা প্রথমে স্থল ছেড়ে নদীর বুকে নামেন। তবু ছোটবেলা থেকে তার আজন্ম লালিত সাধ, একদিন তিনি তার পরিবার নিয়ে ফের ডাঙায় উঠবেন। কিন্তু আফসোস তার কন্ঠে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলাতে সে আশা বুঝি আর পূরণ হবার নয়।

আক্ষেপ করেন লতা বেগমের প্রতিবেশী খালেক। বলেন, “এ পর্যন্ত আমরা সরকারের কাছ থেকে ১০ কেজি চালও সাহায্য হিসেবে পাইনি। আমরা যে সরকারের কাছে আমাগো সমস্যার কতা কমু, এমন মানুষও পাই না। তয় সাম্বাদিকরা যদি আমাগো সমস্যার কতা সরকারের কাছে তুইল্যা ধরে, তাইলে আমাগো অনেক উপকার অইব।

পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন চর মন্তাজ। দ্বীপ ইউনিয়ন চর মন্তাজকে চারিদিক থেকে জড়িয়ে আছে তেঁতুলিয়া নদী। সে নদীর কোনো এক নৌকায় আজ থেকে বিশ কি বাইশ বছর আগে আক্কেল সরদারের কন্যা কোহিনূরের জন্ম। শৈশব, কৈশোর পার করে কোহিনূর বাপের নৌকা ছেড়ে এখন সংসার পেতেছে স্বামী বসারের নৌকায়।

স্বামীর নৌকায় কোহিনূর; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

কোহিনূরের এক ছেলে, নাম সুজন। ডাল ভাতের আয়োজন দুপুরে। বিকেলে যদি মাছ ধরা পড়ে আর তা বিক্রির পর যদি কিছু বাচে, তবে রাতে মাছ রান্না হবে। ছেলে সুজন আড়ই মাছ খেতে ভালোবাসে।

কোহিনূরের দুপুরের ডাল ভাতের আয়োজন; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

কোহিনূরের ছেলে সুজন; ছবিসত্ত্ব: চ্যানেল আই অনলাইন

কোহিনূরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার ছেলে কি হবে ভবিষ্যতে?

দপ করে নিভে যায় কোহিনূরের চোখের জ্যোতি, পান খেয়ে রাঙা করা মুখখানা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে, “জানি না।

তথ্যসূত্র

১) channelionline.com/মান্তা-জলে-ভাসে-যাদের-জীব/

২) dailynayadiganta.com/detail/news/161504

৩) cnnbd.tv/2017/03/09/জলে-ভাসা-জীবন-ওদের-নৌকায়-জ/

৪) dainikazadi.org/details2.php?news_id=3518&table=may2015&date=2015-05-31&page_id=1&view=

৫) bangla.samakal.net/2016/06/28/221256

Related Articles